
শাহিন সামাদ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন গর্বিত শিল্পী। গান গেয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন আমাদের দেশমাতৃকার বীর সন্তানদের।
মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসের বিভিন্ন স্মৃতি ও বর্তমান সময়ের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের এত সময় পর কীভাবে দেখছেন স্বাধীন বাংলাদেশকে?
আমি স্বাধীন দেশের নাগরিকের চেয়ে বড় বিষয় আর কি হতে পারে। আমরা গর্ব করে বলতে পারি আমাদের দেশ স্বাধীন। আমাদের এই দেশ এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমারা আরো অনেক পথ পাড়ি দেব বলে বিশ্বাস করি।
একজন নারী হয়েও আপনি থেমে থাকেননি, যুদ্ধে ঠিকই অংশগ্রহণ করেছিলেন। এতটা শক্ত-মানসিকতা কোথায় থেকে পেয়েছিলেন?
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতের কথা আমি এখনো ভুলতে পারি না। কখনো ভুলতে পারব না। যতোদিন বেঁচে থাকব এই দিনটার কথা মনে থাকবে। সেই দিনেরগুলোর বিদীর্ণ শব্দ এখনো আমার কানে বাজে। চারদিকে আগুন, ধোঁয়া, থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। আমরা সবাই ভেঙে পড়েছিলাম আগত দিনগুলোর কথা ভেবে। তারপরেও মনোবল হারাইনি। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি দেশের জন্য কিছু একটা করব। অস্ত্র দিয়ে না পারি, কণ্ঠ তো আছে। এই কণ্ঠ দিয়েই যুদ্ধ করব। সেটাই করেছি মহান মুক্তিযুদ্ধে। প্রেরণাদায়ী গান গেয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ভাইদের সাহস জুগিয়েছি।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সঙ্গে আপনি যুক্ত হয়েছিলেন কীভাবে?
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে আমি ছিলাম বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শিল্পী সংস্থার সঙ্গে। এটি সেই সময় একটি শক্তিশালী সংগঠন ছিল। আমাদের কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করা এবং মনোবল বাড়িয়ে দেওয়া। পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে নিয়মিত যাওয়া হতো আমাদের।
এক সময় সমর দাদা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমাদের আমন্ত্রণ জানান। আমরা ৮ থেকে ১০ জনের মতো একটি দল গিয়েছিলাম। তখন আমাদের দিয়ে ৮টি গান রেকর্ড করা হয়। এভাবে স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গে যুক্ত হলাম। আমি বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শিল্পী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হই ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিলে। আর দেশে ফিরে আসি বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
সেই সময় কোন গানগুলোতে আপনি কণ্ঠ দিয়েছিলেন?
‘চল যাই চল যাই’, ‘শিকল পরার ছল’, ‘কারার ওই লৌহ কপাট’, ‘মানুষ হ মানুষ হ’, ‘পাক পশুদের মারতে হবে, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’ ও ‘এসো মুক্তিগানের সাথী’ ইত্যাদি।
যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পরিবারের সাপোর্ট পেয়েছেন?
আমার পরিবারে আমি ছিলাম সবার ছোট। তখন আমার বয়স ছিল ১৮ বছর। পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা বোধ করতো। দেশ কবে স্বাধীন হবে, দেশে ফিরতে পারব কিনা। তবে কোনো চাপ ছিল না আমার ওপর।
যুদ্ধকালীন সেই দিনগুলো মনে পড়ে?
ভাঙা একটা ট্রাকে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে গান করতাম আমরা। দিনের পর দিন নিজেদের নাওয়া-খাওয়া, পোশাক-আশাক কিংবা ঘুমানোর কোন ঠিক-ঠিকানা আমাদের ছিল না। এমনকি একবার টানা ১০ থেকে ১২ দিন কেবল শাক-ভাত খেয়ে কাটাতে হয়েছে।
বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে বিজয়ের চেতনা, চিন্তা-বোধ কতটুকু কাজ করছে বলে মনে করেন?
আমি তো মনে করি নতুন প্রজন্মদের মধ্যে একাত্তরের চিন্তা-চেতনা পুরোপুরিই কাজ করে। ওরা এখন সবকিছুই বুঝতে পারে, অনেকটাই প্রগ্রেসিভ। ওরা যা করছে ভালো বুঝেই করছে। এ ছাড়া ইন্টারনেটের যুগে তারা এখন সবকিছুই দেখছে, সচেতন হচ্ছে। আমি পুরোপুরি আশাবাদী।
এ প্রজন্মের নারীদের জন্য কিছু বলুন?
সারা বিশ্ব এখন অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের নারীদের বসে থাকলে চলবে না। নারীদের নিজের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা আছেন। আমি মনে করি এভাবে আমাদের নারীরা একদিন বিশ্ব জয় করবেন।