
প্রতীকী ছবি
নানান দেশের নানা ভাষা। বিনে স্বদেশীয় ভাষা পুরে কি আশা? সেই গানের সুর ধরেই বলা যায় এই যে এত দেশের এত অঞ্চলের এতরকম সুর, গীতিকবিতা বা গান। তার ভিড়ে আমরা পরম শান্তিটুকু পাই নিজেদের ভাষাতে গান গেয়েই। তৃপ্তির শেষ সীমানায় পৌঁছাতে পারি না যতক্ষণ না আমরা নিজেদের বুলিতে, নিজেদের বাণীতে সুর প্রক্ষেপণ করতে পারি। পৃথিবীর সামগ্রিক সংগীতের প্রকাশভঙ্গিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়-
ক) ব্যাকরণগত, খ) পরিবেশনগত।
প্রথমেই বলা যাক এর ব্যাকরণগত দিক নিয়ে। আমাদের এই প্রাচ্যের, মানে ইউরোপের পূর্বদিকের দেশগুলোর সংগীত বলতে আমরা প্রধানত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানকেই বুঝে থাকি। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের সংগীত শিখবার জন্য ‘সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি’ এই সাত স্বরের সঙ্গে প্রণয় অত্যাবশ্যক- এ কথা কে-ই বা অস্বীকার করতে পারেন? তা এই সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নিই বা এলো কোথা থেকে? ষড়জ, রেখব, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, দৈবৎ আর নিষাদের সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবেই আমরা পাই সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নিকে, যা সম্পূর্ণ ভারতীয় শব্দ। এই সা-রে-গা-মা...-এর উৎপত্তিও প্রাচীন ভারতেই। কবে? সে ইতিহাস পর্যালোচনা করে প্রবন্ধ দীর্ঘায়িত না করে বরং বলতে পারি আমাদের এই উপমহাদেশে, সংগীত শিখবার পিপাসা অনুভব করলে সা-রে-গা-মা ছাড়া পথ নেই। কণ্ঠের কারুকাজ, গঠনশৈলী, অলঙ্করণ, কণ্ঠ তৈরি করতে হলে এই জিনিসের বিকল্প নেই। যন্ত্রসংগীত শিখবার ক্ষেত্রেও সে কথা প্রযোজ্য। ওই সা-রে-গা-মা পরিবারেই ভরসা। এ ছাড়া পথ নেই। আর এই সা-রে-গা-মা সাধনাও করতে হবে দীর্ঘদিন এর জন্য। একটা একটা স্বর ধরে রোজ একটু একটু করে সামনে এগিয়ে ধীরে ধীরে কঠিন থেকে কঠিন স্তরে পৌঁছে যেতে হয়। তবেই মিলে সে অমৃতের সন্ধান। এর কোনো শর্টকাট নেই। সাময়িক অর্থপ্রাপ্তি বা খ্যাতি লাভ করা যেতে পারে; কিন্তু সংগীতের স্বরূপ ধরতে গেলে সেই সাময়িক সাফল্য আর অর্থপ্রাপ্তির স্থায়িত্ব ঠিক কচুপাতার পানির মতোই। যতই প্রযুক্তিগত সুবিধা আর আধুনিকতার আবির্ভাব ঘটুক।
আমাদের সংগীত জ্ঞানসীমানায় যতদূর জানা যায় যে, বৈশ্বিক সংগীতের প্রধানত দুটি ধারা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য। প্রাচ্যের আলোচনা তো করা হলো, পাশ্চাত্যের ব্যাপারেও কিছু কথা বলাটা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক বোধ করি। পাশ্চাত্য বলতে প্রধানত ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া বোঝানো হলেও আফ্রিকা মহাদেশ এবং এর আশপাশের অন্যান্য অঞ্চলেও সংগীত শিক্ষা পাশ্চাত্য ধারাতেই হয়ে থাকে। সেখানেও যারা কণ্ঠসংগীত কিংবা যন্ত্রসংগীত শিখবার মনস্থির করেন তাদেরও ওই একটাই রাস্তা। ডো, রে, মি, ফা, সোল লা সি/টি, ডো মানে আমাদের সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি আর কি।
এতক্ষণ পাওয়া গেলো সংগীতের ব্যাকরণগত দিক এর বর্ণনা, সংগীতের ভিত তৈরি ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধির নেপথ্যের গল্প। শিল্পী এখন তৈরি। এরপরেই আসবে পরিবেশন পর্ব। নিজের প্রাণ জুড়ানোর স্তর। এখন বলা যায়, পরিবেশনগত দিকের ব্যাপারে। এই যে সংগীতের শাস্ত্রগত আভিধানিক শিক্ষণ, চর্চা, আত্মস্থ করা- এর বাইরেও তো মনের প্রশান্তি, আবেগ প্রকাশ, হৃদয়ের আন্দোলন, প্রাণের স্পন্দন, অনুভূতি, সুরের অনুরণন এই ব্যাপারগুলো রয়ে যায়। তো কোথায় সেগুলোর প্রকাশের উপায়? সে সুর গতিই বা পায় কোন মুখে? তার প্রকাশেরই বা কী উপায়?...
সেগুলোর প্রকাশের উপায় ‘পরিবেশনে’। ব্যাপারটিকে অনেকটা রন্ধন সম্পর্কীয় দক্ষতার বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ইংরেজিতে যেটিকে আমরা বলে থাকি culinary skill। আপনি আলু-পোস্ত পেষণ থেকে শুরু করে উনুনে রান্নার পাত্রের সব উপকরণ দেবেন, তারপর সেটিকে আদর, ভালোবাসা ও মনোযোগ দিয়ে একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িয়ে, আষ্টেপৃষ্ঠে, কড়াইয়ে নুন-জল দিয়ে বারবার চেখে, পরখ করে রান্নার চূড়ান্ত পর্যায়ে টেনে তুলবেন। এ হলো আপনার রন্ধনের ব্যাকরণগত দিক। মানে রান্নায় কোনটা কী, কেন এবং কীভাবে তারই ব্যাখ্যা। রান্না তো হলো, এইবার আপনার তৈরিকৃত খাদ্যটির সর্বোচ্চ উপভোগ এবং আপনার নিজের দিক থেকে আত্মতৃপ্তির ব্যাপারটি তখনই ঘটবে, যখন আপনি পুরো খাদ্যপদটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্নভাবে পরিবেশন করতে পারবেন এবং অপরপক্ষের কাছ থেকে কোনো ভালোলাগা সুলভ হ্যাঁ বোধক প্রতিক্রিয়া (positive reaction) পাবেন। সংগীতের ক্ষেত্রেও বিষয়টি আসলে সেরকমই।
রাগ-রাগিনীর শুদ্ধতা রক্ষা করে, ব্যাকরণের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিরেট নিয়ম কানুন জেনে ও মেনে, নিয়মবদ্ধ চর্চা করে, গুরুর তালিম নিয়ে, মাস, বছর পেরিয়ে সংগীতের স্বরূপ তো পাওয়া গেল; কিন্তু নিজের মাঝে হারিয়ে যাওয়া, গানের রসে নিজেকে রসিয়ে নেওয়া কিংবা অন্যকে কল্পনার একটি স্তরে নিয়ে যাওয়া, অন্যের মাঝে ভাবনার উদ্রেক করানোর প্রসঙ্গ এলেই চলে আসবে পরিবেশনের ব্যাপারটি। সেই পরিবেশন হতে পারে এক বা একাধিক ব্যক্তির সম্মুখে কিংবা নিজের জন্য কেবলই একান্তে নিজের মনোজগতে হারিয়ে যেতে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে বলা যায় ‘সংগীতের মুক্তি’।
বিশ্বায়নের এই যুগে জীবনঘনিষ্ঠ সকল প্রয়োজনীয় বস্তুতেই লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। সংগীতও তার ব্যতিক্রম নয়। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায়, আধুনিকতার জোয়ারে নিত্যই সংগীতের নানারকম ধারার উৎপত্তি হচ্ছে। সংগীতের উৎপত্তির পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা গান এর পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে আরও যেসব ধারার সংগীত আমরা পাই সেগুলো হলো- পপ, ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল (ভোকাল এবং ইন্সট্রুমেন্টাল), কান্ট্রি, অপেরা, রক, জ্যাজ, ব্লুজ, পাংক, রক এন রোল, ডিস্কো, মেটাল, হার্ড রক, সফট রক, হেভি মেটাল, রেগে প্রভৃতি। এই প্রত্যেকটি ধারার আবার উপধারা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সংগীতের ধারা বা music genre এর ব্যাপ্তি ও কলেবর এত বৃহৎ যে শুধু মিউজিক জনরা শিরোনামেই শতাধিক পৃষ্ঠা লেখা সম্ভব হবে। আর তাছাড়া সংগীতে ভাষার ব্যবহারের যে ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় সেটি হিসেব করলে তো সংগীতের আরও বহু ধারার তালিকা প্রস্তুত করা যাবে। অঞ্চলভেদে, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষিদের রয়েছে তাদের ভাষায় রচিত নিজস্ব গান। সে হিসেবে বলা যায় পৃথিবীতে যতগুলো ভাষা আছে, ঠিক ততগুলো রকমের গানও রয়েছে। আবার কোনো কোনো দেশে দেখা যায় তারা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলেন। একই ভূখন্ডের হওয়া সত্ত্বেও, তাদের বিভিন্ন ভাষার সংগীতেরও আবার রয়েছে নানান রকম। যেমন ধরা যাক আমাদের পাশের দেশ ভারতের কথা। সেখানে রয়েছে ২৯টি প্রদেশ। প্রত্যকেটি প্রদেশের আবার রয়েছে নিজস্ব প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সংস্কৃতি। ভারতে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে ১২১ ধরনের ভাষায় ভারতীয়রা কথা বলে থাকেন। এ ১২১ ধরনের ভাষাতেই আলাদা আলাদা সংগীত রয়েছে। রীতিমতো চোখ ছানাবড়া হওয়ার মতো হিসেব। অথচ দেখুন কি আশ্চর্য, এত হাজার রকমের গানের মধ্যে প্রত্যকেটিকেই আলাদা আলাদাভাবে চেনা সম্ভব। প্রযুক্তির উত্তরাধুনিক উন্নতির ফলে সেসব শুনতে হলে কেবল আমাদের হাতে থাকা মোবাইল সেটটিই যথেষ্ট। এই যেমন কয়েক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে চলছে ইডিএম মিউজিকের (Electronic Dance Music) দাপট। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন কি রকম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারে এ সংগীত। উচ্চ ভলিউম এর রিদমিক বিট, ইলেক্ট্রো সিন্থেমাইজড টোন ও লো বেজ সাউন্ডে এই গানের কম্পোজিশন করা হয় সাধারণত। বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরে এর প্রচলন শুরু হয়েছে। ইডিএম এর পাশাপাশি বর্তমান সময়ে দর্শকপ্রিয়তার গ্রাফে একেবারে ঊর্ধ্বে অবস্থানকারী আরেকটি হটকেক সংগীত ‘কেপপ’ এর কথা বলা যায়। কোরিয়ান পপ সংগীতের একটি ধারাকে বলা হয় ‘কোরিয়ান পপ’। সংক্ষেপে কেপপ। এর প্রচলন ৯০ দশকে কোরিয়াতে শুরু হলেও ধীরে ধীরে এটি বৈশ্বিক দর্শকপ্রিয়তা পেতে পেতে এখন সমগ্র বিশ্বেই দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করছে। ইডিএম এর সঙ্গে বেশ কিছু দৃশ্যমান সাদৃশ্যের কারণে কেপপ (KPOP) কে ইডিএম এরই অন্তর্গত বলা যায়। তবে এই ধরনের কম্পোজিশনে কেবল কোরিয়ান শিল্পীদের দ্বারা আলাদাভাবে কিছু সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হওয়ার কারণে এটিকে কেপপ নামের ভিন্ন শিরোনামে অভিহিত করা হয়। বিটিএস, মঞ্চটা এক্স, ইকন প্রভৃতি দলগুলোর গান শুনলে আপনারা কেপপ সম্বন্ধে একটা ধারণা পেয়ে যাবেন।
বর্তমান এই ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক অগ্রগতির সময়ে আমরা প্রত্যেকেই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। সর্বদাই চলে পারস্পরিক লেনদেন, আদান-প্রদান এবং বিনিময়। তা সে ভাব বিনিময় হোক, হোক বস্তুগত কোনো উপকরণ কিংবা দুটি দেশের মধ্যে সংস্কৃতি বিনিময়। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে এবং টিকে থাকতে আমাদের সবাইকেই দেশি বিদেশি সবকিছুকেই অবলম্বন করতে হয়। আমাদের ইংরেজি-স্প্যানিস ভাষাও শিখতে হয়, আবার বাংলা ভাষাও জানতে হয়, বলতে হয়। বিদেশ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য একদিকে যেমন আমদানি করতে হয় তেমনি আমরা রফতানিও করে থাকি। বিদেশি ক্রিকেট, ফুটবল খেলা দেখে যেমন আমরা হাততালি দেই তেমনি দেশের জাতীয় দল এর খেলাতেও আমরা তার চেয়ে বেশি উৎসবে মাতি। সংগীতও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা যেমন এড শিরান, অ্যাডেল এর গান শুনে চিত্ত অনুরক্ত করি তেমনি আবার নিজের দেশের জেমস, আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনেও সিক্ত হই। এই যে এত এত ধারার সংগীত, তার আবার রয়েছে কত উপধারা। এতসব কিছুর ভিড়েও দিন শেষে আমাদেরও তো রয়েছে অগাধ সংগীত ভাণ্ডার।
আমাদের সংগীত বলতে আমি শুধু বাংলাদেশ ভূখণ্ডের নয়। বিশ্বব্যাপী সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর ‘বাংলা গান’ কেই বোঝাচ্ছি। এর শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে সহস্রাধিক বছর পূর্বে রচিত বাংলা গান তথা বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ রচনাবলির মধ্যে দিয়ে। উল্লেখ্য যে, চর্যাপদ শুধু বাংলা গানেরই নয়, সামগ্রিক ভারতীয় সংগীতেরই আদি নিদর্শন। বৌদ্ধ ধর্মের নানা শাখা-প্রশাখা প্রভাবিত গূঢ় লৌকিক সাধনতত্ত্ব অবলম্বনে চর্যাগীতিসমূহ রচিত। উপেক্ষিত দরিদ্র সমাজের ছবি পাওয়া যায় এ সমস্ত গানে। চর্যাপদ এর মধ্য দিয়ে বাংলা গানের এই যে সূচনাটা হয়ে গেল, তারপর থেকে বৈশ্বিক অন্যান্য সংগীতের মতো বাংলা গান এর নানান ধারা নানান রচয়িতাদের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করতে করতে আজ এ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। চর্যাপদের পর বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় সে যুগে রচিত আরও যেসব গীতিসাহিত্য আমরা পাই সেগুলো হলো- নাথগীতি, গীতগোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলি, মঙ্গল গান, মঙ্গলকাব্য। যার মধ্যে আবার রয়েছে মনসা মঙ্গল, চণ্ডী মঙ্গল, ধর্মমঙ্গল। তারপর রয়েছে শাক্ত গীতি বা শাক্ত পদাবলি, টপ্পা গান- নিধুবাবুর টপ্পা, কালীদাসের টপ্পা, ধ্রুপদ সংগীত, ব্রহ্মসংগীত, স্বদেশসংগীত। বিকাশ লাভের এই পথপরিক্রমার মাঝে রাজদরবারের শাসকদের সময়কালেও উচ্চাঙ্গ সংগীতের গায়নশৈলীর ভিতর দিয়ে বাংলা গান নানা ঢঙে, নান রঙে উৎকর্ষ লাভ করতে করতে যখন আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে শুরু করল, ঠিক সেই সময়ে তাতে আরও নতুন মাত্রা যোগ করতে লাগলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সংগীতকে দিলেন কাব্যের অলংকারে পশ্চিমা আবহ। রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী হয়ে সে বিপ্লব মিছিলে আমরা পাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেনের মতো মহান সংগীত রচয়িতাকে। তারই ধারাবাহিকতায়, রবীন্দ্রনাথের প্রজ্বলিত এই মশাল বহন করে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বীজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুল প্রসাদ সেন ও কাজী নজরুল ইসলামের গানকে আমরা একত্রে পঞ্চকবির গান নামে অভিহিত করে থাকি।
রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানে যে আধুনিকতার সূচনা করেছিলেন, ঠুমরী অঙ্গ, খেয়াল অঙ্গ, গজল অঙ্গ, রাগাশ্রয়ী, কাওয়ালি ধরনের গান রচনা ও সুরারোপ করে তাতে আবারও ভিন্ন মাত্রা যোগ করলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আর মাঝপথে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুল প্রসাদ সেন এই তিন কবির কাব্যসংগীত, ভক্তিগীতি, বেদনার্ত সংগীত, হাসির সংগীত সে মশালে দিয়েছে জ্বালানির জোগান। আর এই যাত্রাপথের শেষে কাজী নজরুল ইসলাম এসে যেন এক দমকা হাওয়ার ঝাপটা দিলেন। আর তাতে বাংলা সংগীত হলো আরও সমৃদ্ধ, আরও উত্তরাধুনিক। তারপরে ১৯ শতকে এলো গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি, যাদের বাংলা আধুনিক গানের পৃষ্ঠপোষকতার পথিকৃৎ বলা যায়। গ্রামোফোন কোম্পানির মাধ্যমে সাধারণ জনগণ তাদের প্রিয় শিল্পীর গান রেডিও ছাড়াও অন্য মাধ্যমে শোনার সুযোগ পেল, যা সেই যুগে প্রচারমাধ্যমে মাইলফলক বলা চলে। গ্রামোফোন কোম্পানির বাণিজ্যিকভিত্তিতে গানের রেকর্ড বাজারজাতকরণের ধারাবাহিকতাতেই পরবর্তীতে আমরা পাই বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, তালাত মাহমুদ, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, লতা মুঙ্গেশকর আরও কত নাম।
আধুনিক গানের এই গণজোয়ারের পাশাপাশি পথ চলেছে যুগ যুগ ধরে বহমান আমাদের বাংলাদেশের লোকগান। এই লোকগানের বিস্তৃতি অবশ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত। গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে মিশে থাকা এই লোকগানগুলো হলো জারিগান, সারিগান, ভাটিয়ালী গান, ভাওয়াইয়া গান, কবিগান, পালাগান, তরজাগান (কবিগানের ধারাতেই রচিত ও গীত হয়), লেটোগান, ঘাটুগান, মেয়েলি গীত, বিয়ের গান, ধামাইল গান (যার প্রভাবে এসেছে ধামাইল নৃত্য), দেহতত্ত্বের গান, মুর্শিদী গান, মরমি গান, গম্ভীরা গান, বাউল গান, পটুয়ার গান, ছাদপেটানির গান, বেদেদের গান, গাছ কাটার গান, শ্রমিকের গান, কাশিদা প্রভৃতি। এ ছাড়া রয়েছে ‘বিচ্ছেদি গান’ যা যুগ যুগ ধরে আমাদের বিভিন্ন কবি ও সংগীত গুণীরা রচনা করে এসেছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রসিদ্ধ সংগীতকার ‘বারি সিদ্দিকী’র কল্যাণে এই গান নতুন করে ব্যাপক আকারে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
অঞ্চল ভেদে উৎপত্তি লাভ করা কিছু গানও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যার দরুন সেই গানগুলোকে ওই অঞ্চলের নামেই ডাকা হয়। এই গানগুলোও লোকসংগীতের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাইজভাণ্ডারি দরবারের ভাণ্ডারি গান, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, নোয়াখালী অঞ্চলের গান, মানিকগঞ্জ অঞ্চলের গান, ময়মনসিংহ অঞ্চলের গান, সিলেট অঞ্চলের গান, যশোর অঞ্চলের গান, চাঁদপুর অঞ্চলের গান। এ গানগুলো সেসব অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাতেই রচিত ও গীত হয়ে থাকে।
আরও বলা যায়, আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে বাস করা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় রয়েছে সমৃদ্ধ সংগীত ভাণ্ডার। তাদের গানের বাণীও যেমন নিজেদের মাতৃভাষাতে রচিত, ঠিক তেমনি বাদ্যযন্ত্রেও রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্যতা। আদিবাসীদের রয়েছে নিজেদের তৈরি বাদ্যযন্ত্রের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ যা নৃতাত্ত্বিক গবেষণার ক্ষেত্রে হতে পারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
তাছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে লিখিত ও সুরারোপিত অসংখ্য গুণীদের গান রয়েছে যাকে আমরা লোকসংগীত বলতে পারি। যেমন- লালন ফকির এর গান, শাহ আবদুল করিমের গান, বিজয় সরকারের গান, জালাল শাহের গান প্রভৃতি।
লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট।
শেষে এসে বলব আমাদের ব্যান্ড সংগীতের কথা। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংগীতভাণ্ডারের মধ্যে সংগীতের এই ধারাটি একেবারেই নবীন বলা যায়; কিন্তু এই ধারাটি আলোকিত তারকার মতোই প্রজ্বলিত আছে এবং থাকবে সবসময়। আমাদের স্বাধীনতার ঠিক কিছু পূর্বে ঢাকার তৎকালীন ধনাঢ্য পরিবারের চর্চার মাধ্যমে এর সূচনা হয় সেই ৬০-এর দশকে। সে সময় সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত প্রথম এক ধরনের গানের খবর পাওয়া যায়। যেটি ছিল ব্যান্ড ধাঁচের। সেখানে ব্রিটিশ নাগরিক টেলফার জনসন গিটার বাজিয়ে ‘ক্লিফ রিচার্ড’ এর গান পরিবেশন করেন। একই স্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ফজলে রব, আলমগীর (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জনপ্রিয় গায়ক) রফিক ও সাব্বির ব্যান্ড দল গঠন করেন। বলা হয়, তাঁদের হাতেই জন্ম নেয় বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড ‘আইওলাইটস’। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও ঢাকা ক্লাবে নিয়মিত পারফর্ম করে ব্যান্ডটি। ১৯৬৫ সালে দেশের প্রথম ব্যান্ড হিসাবে বিটিভিতেও সংগীত পরিবেশন করে ব্যান্ডটি।
পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরে ব্যান্ডসংগীত বিকাশের প্রথম নায়ক বলা যায় ওমর খালেদ রুমিকে। তবে ব্যান্ডসংগীত মূলত জনপ্রিয়তা অর্জন করে পপসম্রাট আজম খানের ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ডের মাধ্যমেই ৭০ দশক থেকে। আজম খানের এই ব্যান্ডসংগীত মিছিলে আমরা আরও পাই পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ প্রমুখ গুণীদের। এই পাঁচজন একত্রে ‘পাঁচপীর’ নামে পারফর্ম করতে থাকেন মঞ্চে। ৯০ দশকে এসে ব্যান্ডের বিপ্লব রীতিমতো গণজোয়ারে পরিণত হয়, যার ফলে আমরা পাই বেশকিছু কালজয়ী ব্যান্ড দলকে।
বলা চলে, ইংরেজি গানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই দেশে ব্যান্ড এর সূচনা হয়েছিল। সে সময় এই ব্যান্ডগুলো মূলত ইংরেজি গানই পরিবেশন করত। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বাংলা গান গাওয়া শুরু হয়। যতদূর জানা যায় ‘জিংগা শিল্পীগোষ্ঠী’ নামের ব্যান্ড দেশের প্রথম বাংলা গানের ব্যান্ড।
আজ ৫০ বছর পর ব্যান্ডসংগীত বাংলাদেশের সংগীত জগতে এক অবিসংবাদিত নাম। বিশ্বের বহু দেশের বহু ব্যান্ডসংগীতের মধ্যে বেশ দাপটের সঙ্গেই রাজত্ব করবে আমাদের এই ব্যান্ডসংগীত ও ব্যান্ড দল। ব্যান্ডসংগীত ও শিল্পীদের প্রভাব এতই অগ্রগণ্য আমাদের সমাজে যে সম্প্রতি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে একটি গিটারের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে।
সব কিছুরই সমাপ্তি আছে। এই লেখারও তাই। এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমাদের বাংলাদেশের এই বিশাল সংগীতভাণ্ডারের কিয়দংশ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। হয়তো পরবর্তী কোনো লেখায় আরও বাকি অংশগুলোর ব্যাপারে বলা যাবে। এই আলোচনা থেকে আপনারা অন্তত এতটুকু আঁচ করতে পারছেন যে সমগ্র বিশ্বের এত ধারার এত সংগীতের মধ্যে আমাদের সংগীতেরও রয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র ধারা। বিশ্ব মানচিত্রের ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশ। অথচ সংস্কৃতিতে কতই না বিস্তৃত। শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় বাংলাদেশের রয়েছে অনবদ্য স্বকীয়তা। যুগ যুগ ধরে শত শত শিল্পী-কবি-সাহিত্যকরা করে গেছেন আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ। বলা হয় সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। এ দেশের মাটি, বায়ু, উদ্ভিদ, ফসল, জল, ফুল-ফল, পাহাড়-সমুদ্র, মেঘবৃষ্টি-রোদ, খাল-বিল নদী-নালা, শরতের আকাশ কিংবা শীতের ভোরের শিশির। এসবেই তো লুকিয়ে আছে সুর-সাহিত্য আর কবিতা। ভাবুন তো একবার, এই আপনি বসে আছেন প্রকাণ্ড এক বটবৃক্ষের ছায়ায়, আপনার পাশ দিয়েই নদী বয়ে যাচ্ছে। আপনার সামনে কোনো অচেনা বাউল নিবিষ্টচিত্তে একতারা হাতে, সামান্য যন্ত্রানুষঙ্গে অবিরাম গেয়ে চলেছেন পল্লী সুরের বিচ্ছেদি, ভাটিয়ালি, বা হৃদয় নিংড়ানো কোনো সুরের গান। কল্পনা করুন তো একবার কেমন লাগছে সে মুহূর্তটি!!