ক্যাপিটল ভবনে হামলা: প্রশ্নবিদ্ধ মার্কিন বিচার বিভাগ

অরুন্ধতী বসু
প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৫৪

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল ভবনে গত ৬ জানুয়ারির দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনায় তদন্তাধীন আছেন অন্তত ১৭০ জন। কিছুদিনের মধ্যে এ সংখ্যা কয়েকশ’ বাড়বে বলে ধারণা ওয়াশিংটন ডিসির কৌঁসুলিদের।
তারা বলছেন, এ ঘটনা শুধু ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। ঘটনাটি নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এফবিআই ও মার্কিন বিচার বিভাগ।
রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত ফৌজদারি মামলা পর্যবেক্ষক ওপেন-সোর্স রিসার্চ প্ল্যাটফর্ম প্রসিকিউশন প্রজেক্টের তথ্য অনুযায়ী, ৭ জানুয়ারি সকাল পর্যন্ত ক্যাপিটল কাণ্ডে সংশ্লিষ্ট থাকার জন্য অন্তত ১১১ জনকে গ্রেফতার করা বা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
ডিস্ট্রিক্ট কলম্বিয়ার ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি মাইকেল শেরউইন বলেছেন, ‘কৌঁসুলিরা দাঙ্গায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আনা ক্রমবর্ধমান অভিযোগের বিষয়টি বিবেচনা করছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ক্যাপিটল ভবন থেকে ডিজিটাল ডিভাইস চুরির মতো নগণ্য বিষয়ে অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়াও গুরুতর অভিযোগের মধ্যে রয়েছে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তার ওপর হামলা, রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্র ও অপরাধমূলক হত্যাকাণ্ড।’ সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে তিনি চিন্তিত কণ্ঠে জানিয়েছেন, ‘মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হতে কয়েক বছর লাগতে পারে। এ তো কেবল শুরু।’
আইন প্রণেতা ও অন্য কর্মকর্তারাও ক্যাপিটল ভবন হামলায় পৃথক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। এতে অনেক অজানা বিষয় উঠে আসতে পারে বলে ধারণা তাদের। এত জটিলতার মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ নিরপেক্ষভাবে ক্যাপিটল হামলাকারীদের বিষয়টি বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছেন অ্যালিস স্পেরি। ন্যায়বিচার, অভিবাসন ও নাগরিক অধিকার-বিষয়ক এই লেখক যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন পোর্টাল দ্য ইন্টারসেপ্টে লেখা এক নিবন্ধে বলেন, ‘এই তদন্ত নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। প্রশ্ন উঠছে বিচার বিভাগের কার্যক্রম ও এফবিআইয়ের তদন্ত নিয়ে। আছে বিচার ও প্রতিহিংসার বিষয়টিও।’
মিশ্র প্রতিক্রিয়া
প্রসিকিউশন প্রজেক্টের রেকর্ড ডিস্ট্রিক্ট আদালতে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ক্যাপিটল সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা ১১২টি মামলার মধ্যে অনেকগুলোই অপেক্ষাকৃত ছোটখাটো অপরাধ সংশ্লিষ্ট। আদালতে ৩৩ জনকে বেআইনি প্রবেশ ও ২৬ জনকে কারফিউ লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধীদের আর্থিক জরিমানা বা এক বছরেরও কম সময় কারাবাসের মতো দণ্ড হতে পারে।
১০ জনকে অস্ত্র বহন করার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কিত অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ জনের বিরুদ্ধে ক্যাপিটলে বেআইনি প্রবেশ, বিশৃঙ্খলামূলক আচরণ ও জনসাধারণের সম্পত্তি চুরি করার মতো ফেডারেল মামলা হয়েছে।
সমালোচকদের মতে, যে অভিযোগগুলো এখন পর্যন্ত উঠেছে তা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দায়ের করা অভিযোগের তুলনায় নগণ্য। এক্ষেত্রে তারা গত বছর জর্জ ফ্লয়েড হত্যা ঘিরে বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশি বর্বরতার প্রতিবাদে বিক্ষোভকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ দায়েরসহ ফেডারেল অভিযোগগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেন। যাদের অনেককেই ঘটনাস্থলে গ্রেফতার করার পাশাপাশি তাৎক্ষণিক দাঙ্গার মতো অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল। ক্যাপিটলের ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বেশিরভাগই পুলিশ বাধা দেওয়ার আগে ঘটনাস্থল ছেড়ে যেতে সক্ষম হয়। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার হয় মাত্র ১২ জন।
বিক্ষোভকারীদের যেভাবে গ্রেফতার ও এখনো পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে, তাতে একটি বড় গরমিল রয়েছে, মন্তব্য অ্যাটর্নি ও জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি ল’ সেন্টারের সহযোগী অধ্যাপক ভিডা জনসনের। তিনি বলেন, ‘এখানে বেশিরভাগই শ্বেতাঙ্গ, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। যারা কংগ্রেসে হামলার জন্য অভিযুক্ত হয়েছে। পরে আরও অভিযোগ আসতে পারে। এর পক্ষে কী যুক্তি থাকতে পারে বা মানুষ কেন এত ভীত তা বলা কঠিন। আর ইউএস অ্যাটর্নির কার্যালয় ঠিক কোন বিষয়টায় গুরুত্ব দেবে সেটিও বলা যায় না।’
প্রসিকিউশন প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মাইকেল লোডেনথাল পোষণ করেন ভিন্ন মত। তিনি জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘ফ্লোরিডায় মেক্সিকো থেকে আমদানি করা বোতলজাত মদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য সম্পর্কিত অপরাধে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনায় আইন ব্যবস্থা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল; কিন্তু ক্যাপিটলের ঘটনায় এসব কিছু নেই। এক্ষেত্রে নিম্ন পর্যায়ের অপরাধে অভিযুক্তদেরই দেখা যাচ্ছে।’
লোডেনথাল ক্যাপিটল সহিংসতার সাথে তুলনা করেন ‘জে-২০’ ঘটনারও। এই ঘটনায় তিনি নিজেও জড়িত ছিলেন। ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। সেদিন সাংবাদিক, আইনি পর্যবেক্ষকসহ গ্রেফতার করা হয় ২০০ জনকে। দাঙ্গার অভিযোগে গ্রেফতার করা হলেও পরে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলা হয় ও কারাগারে পাঠানোর হুমকি দেয়া হয়। মামলাটি পরে কৌঁসুলিদের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে নিষ্পত্তি হয়েছিল।
জে-২০ মামলার অন্যতম প্রতিরক্ষা অ্যাটর্নি ফিলিপ অ্যান্ডনিয়ান বলেন, ‘জে-২০ বিক্ষোভ ও ক্যাপিটলের ঘটনা আলাদা। জে-২০’র প্রতিক্রিয়া ছিল আরো জোরালো। বাস্তবিক অর্থে দুই ঘটনায় বৈষম্য উঠে এসছে স্পষ্টভাবে।’
পুলিশি ব্যর্থতা
এই হামলার পর যাদের ছবি ভাইরাল হয়েছিল তাদেরই গ্রেফতারে মনযোগী ছিল এফবিআই। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অনলাইন কর্মী রয়েছে। অথচ পুলিশ কর্মকর্তাদের মারধরসহ সংঘটিত সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কেবল একজনকে অভিযুক্ত করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাবেক এফবিআই কর্মকর্তা মাইকেল জার্মান মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টকে বলেন, ‘ক্যাপিটলে সংঘটিত সবচেয়ে নিকৃষ্ট সহিংসতা আগামী দিনগুলোর জন্য আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। এফবিআই এখন ৫০টি রাজ্যকে সতর্ক করেছে। তবে কর্মকর্তারা গত ৬ জানুয়ারি আসলে কী ঘটেছিল তা খতিয়ে দেখছেন।’
অ্যাডোনিয়ান প্রসিকিউটরদের আপাত সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি অতীতের যেকোনো আন্দোলনের চেয়ে আলাদা। এটি প্রশ্ন তোলে- আসলে কী হচ্ছে?’
এফবিআই পরিচালক ক্রিস্টোফার রেসহ অন্য শীর্ষ কর্মকর্তারা ক্যাপিটল রায়ট নিয়ে নীরব।
এ ঘটনায় প্রেসিডেন্টের সমর্থন ছিল বলেও বিশ্বাস অনেকের। মাইকেল জার্মানের ভাষ্য, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সমর্থনে এ ধরনের কাজে উৎসাহী হলে ও প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক শত্রুর বিরুদ্ধে সহিংসতা করলে পুলিশ হস্তক্ষেপ করে না। তখন অবশ্যই এটি অনুমোদিত।’
বিচার ও প্রতিহিংসা
ক্যাপিটলের ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর হয়ে বিচার বিভাগ নিজের ব্যর্থতাকে লুকানোর চেষ্টা করছে, এফবিআইর সাপ্তাহিক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। শেরউইন বলেছেন, তদন্ত পরিচালনায় জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও পাবলিক করাপশন কৌঁসুলিদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ক্যাপিটলের ঘটনাটির ষড়যন্ত্র বিষয়ে সুস্পষ্ট তদন্ত করা উচিত বলে ইন্টারসেপ্টকে জানিয়েছেন একাধিক অ্যাটর্নি।
তারা বলছেন, দাঙ্গায় অংশ্রহণকারীদের অনেকে কয়েক সপ্তাহ ধরে অনলাইনে তাদের কর্ম পরিকল্পনা জানিয়ে আসছিলেন। সেইসাথে প্রেসিডেন্টসহ অন্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
জর্জটাউনের অধ্যাপক জনসনের মতে, ‘কৌঁসুলিরা নিয়মিত বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে যে কৌশল ও কথিত দায়বদ্ধতার তত্ত্ব ব্যবহার করেন, তা বন্ধ করা উচিত। আমি অবশ্যই এখানে অপরাধমূলক হত্যার অভিযোগের পক্ষে সমর্থন করব না। কারণ আমি মনে করি, এই অপরাধী হত্যা বিষয়ক আইনটি ঠিক নয়।’
তবে অ্যানডোনিয়ান বলেন, ‘আমি অবশ্যই দোষের অতিরিক্ত-তাৎপর্য তত্ত্ব দিয়ে আরো বেশি লোকের বিরুদ্ধে বিচার দেখতে চাই না। কারণ তা হলে আগামীতে এর পরিধি আরো বাড়বে।’