ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন
‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ কিংবা ‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা’। এই দুটি প্রবাদের মূল হলো আত্মকেন্দ্রিকতা। ঘর বাঁচিয়ে তবেই পরকে নিয়ে ভাবা- ঠিক এমন আদর্শ প্রচার করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দুই মেয়াদেই তিনি ভোটারের মন কেড়েছেন ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ আদর্শ প্রচার করে। তার প্রথম মেয়াদ (২০১৭-২০২১) ছিল বাণিজ্যিক সুরক্ষা, কর কর্তন ও মার্কিন শিল্পকে উৎসাহিত করার দিকে যথেষ্ট মনোযোগী। এই নীতিগুলো তার দ্বিতীয় মেয়াদে আরো শক্তিশালী হতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, যার বিশাল প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর।
বাণিজ্যিক সুরক্ষা ও বাণিজ্য যুদ্ধ : ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র তার বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক দেশ, বিশেষ করে চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির বিরুদ্ধে সুরক্ষা নীতি গ্রহণ করেছিল। তিনি ভিনদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিলেন। এর ফলে বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।
ট্রাম্প এবারও চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক শুল্ক বাড়িয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দিয়েছে চীন। চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের জবাবে ৪ ফেব্রুয়ারি এমন সিদ্ধান্ত জানিয়েছে বেইজিং। পাল্টাপাল্টি এই শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এদিকে ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর তার প্রস্তাবিত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ এক মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। ৪ ফেব্রুয়ারি নতুন শুল্ক কার্যকর হওয়ার যে সময়সীমা ছিল তার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষা নীতির কারণে বাণিজ্যিক উত্তেজনা বাড়লে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। বিভিন্ন দেশ তাদের নিজেদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনরায় যাচাই করতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমতে পারে।
ডলার ও মুদ্রার মান : ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মার্কিন ডলারের মান অনেকটাই অস্থির ছিল, বিশেষ করে তার বাণিজ্যিক নীতির কারণে। এবারও যদি ট্রাম্প আগের নীতির পুনরাবৃত্তি কিংবা আরো কট্টর নীতি গ্রহণ করেন, তাহলে ডলারের মান ওঠানামা করতে পারে এবং মুদ্রাযুদ্ধ বাধতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন যদি অন্য একাধিক পরাশক্তির বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপ করে, তাহলে হয়তো ডলার শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু একই সময়ে যদি বাণিজ্য সম্পর্কের সংকট গভীরতর হয়, সে ক্ষেত্রে ডলারের মান কিছুটা নিম্নমুখীও হতে পারে।
আবার ট্রাম্প যদি তার বাণিজ্যিক নীতিতে আরো আক্রমণাত্মক হন, তবে মুদ্রা যুদ্ধের সূত্রপাত হতে পারে। অন্যান্য দেশ তাদের মুদ্রার মূল্য কমাতে পারে, যাতে তারা আমদানীকৃত পণ্যের দাম কমাতে পারে, যা বিশ্ব মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
কর সংস্কার : প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প কর কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, বিশেষ করে ব্যাবসায়িক ও করপোরেট করের ক্ষেত্রে। দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম সপ্তাহেই তিনি করপোরেট কর হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং এতে এরই মধ্যে মার্কিন পুঁজিবাজার চাঙা হয়ে উঠেছে। সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে ২৩ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্য দেওয়ার সময় ট্রাম্প স্বল্প সুদহারের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করা কোম্পানিগুলোর জন্য তিনি কর হ্রাস করবেন ও যারা বিনিয়োগ করবে না, তাদের শুল্ক বাড়াবেন। ট্রাম্পের এই নীতি মার্কিন ব্যবসায় ও ধনী শ্রেণির জন্য লাভজনক হতে পারে, বিশ্বে মার্কিন ব্যবসার প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে অন্যান্য দেশের করনীতি প্রভাবিত হবে। মার্কিন স্টার্টআপ ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো আরো দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে, যা অন্য দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পের এবারের প্রশাসনও বিশ্ব অর্থনীতির কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী তার নীতি এমন হতে পারে যে, কিছু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের রূপরেখা নতুন করে গড়তে পারে কিংবা অন্য পথ খুঁজতে চাইবে। ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতির কারণে কিছু দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চাইবে, যা বৈশ্বিক উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলকে প্রভাবিত করতে পারে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh