Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে বিএনপির ২৭ দফা

Icon

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৪৫

রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে বিএনপির ২৭ দফা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ। ফাইল ছবি

রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিএনপির বক্তব্য অনুযায়ী বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, তাই এই কাঠামোর মেরামত দরকার।

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রকাঠামোয় কী কী পরিবর্তন আনবে, কীভাবে সরকার পরিচালনা করবে তা ব্যাখ্যা করেছে এই ২৭ দফায়। এই ২৭ দফা বিএনপির নির্বাচনী ইস্তেহার হিসেবেও গণ্য হতে পারে। ক্ষমতায় গেলে কে কী করবে তার লিখিত প্রতিশ্রুতি থাকা প্রয়োজন, যাতে পরবর্তীকালে যে কোনো বিচ্যুতি জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়। 

বিএনপির প্রতিটি দফার বিচার-বিশ্লেষণ করা আমার একটি লেখায় সম্ভব নয়। প্রথম দফায় তারা ‘অবৈধ’ আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলো পর্যালোচনা করে তা রহিত বা সংশোধন করবে। বিএনপির এই কথার মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে; কারণ এই ‘অবৈধ’ সরকারের আমলে তারা সংসদে যোগ দিয়ে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে, এই ‘অবৈধ’ সরকারের কাছেই তারা ইতিপূর্বে ১০ দফা দাবি উত্থাপন করেছে। প্রথম দফার কর্মসূচি অনুযায়ী সংবিধানে পরিবর্তন আনতে গেলে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে হবে; বিএনপি কি নিশ্চিত নির্বাচনে তারা দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাবে। আওয়ামী লীগ সরকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে।

সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারা-উপধারা বাতিল করার ক্ষমতা সংবিধানই সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছে। এই ক্ষমতা বলে জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনামলের সকল আদেশ-নির্দেশ-আইন-বিধি সংবলিত সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করেছে। সংবিধানের গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল করেছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে সংবিধানে এগুলোর পুনঃস্থাপন কীভাবে সম্ভব তা কিন্তু বিএনপি আজ পর্যন্ত কোথাও ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করেনি। 

দ্বিতীয় দফায় ‘রেইনবো নেশন’ গঠনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রেও জাতির বিভাজন ঠেকানোর কোনো প্রয়াস নেই; কারণ বিএনপি বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ‘রেইনবো নেশন’ থেকে বাদ দিয়েছে। এই বাদ দেওয়ার কারণে মাও সেতুং-এর শত ফুল আর ফুটল না। তৃতীয় দফায় তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিএনপি এই দফা সংযোজনে প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়নি। বিএনপি বলছে তারা ক্ষমতায় গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে; তাই যদি হয় তাহলে আসন্ন নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে? তাহলে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করছে কেন? কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো তারাই প্রতিষ্ঠা করবে।

চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। বিএনপি চলে দলের চেয়ারম্যানের একক নেতৃত্বে, দলের গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানকে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া আছে যে রাজনৈতিক দল চেয়ারম্যানের হাতে দলের সকল ক্ষমতা অর্পণ করেছে সেই দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনবে কী করে। প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার মানসিকতা বিএনপির থাকলে রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হতো না । 

পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী পরপর দুইবারের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। কিন্তু ক্ষমতার মোহ মারাত্মক, মালয়েশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাহাথির মোহাম্মদ তার ৯৭ বছর বয়সে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। ‘পরপর’ শব্দটি ব্যবহার করে বিএনপি রাশিয়ার কৌশল অবলম্বন করেছে; রাশিয়ায়ও একই নীতি বিদ্যমান। ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় থাকার বাসনায় কখনো প্রেসিডেন্ট পদে, কখনো প্রধানমন্ত্রীর পদে প্রার্থী হয়েছেন। ১৯৯৯ সালে তাকে প্রথমে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। ২০০০-২০০৮ মেয়াদে তিনি ছিলেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, ২০০৮০-২০১২ মেয়াদে হলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১২ সালে আবার প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে যান এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আবার প্রেসিডেন্ট হন। বিএনপিও হয়তো রাশিয়ার মতো তাদের দলীয় নেতাকে পরপর দুইবার প্রধানমন্ত্রী করে তৃতীয় টার্মে প্রেসিডেন্ট করবে এবং চতুর্থ ও পঞ্চম টার্মে আবার প্রধানমন্ত্রী। 

ষষ্ঠ দফায় রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন করার কথা বলা হয়েছে। উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট এই আইনসভা গঠনের কোনো রূপরেখা না থাকায় এই মুহূর্তে স্পষ্ট ধারণা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সপ্তম দফায় সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের প্রতিবন্ধক সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন বা বাতিলের কথা না বলে বিএনপি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা বলেছে। অষ্টম দফায় ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ সংশোধনের উল্লেখ রয়েছে। নবম এবং দশম দফায় সাংবিধানিক পদে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে নিয়োগ এবং বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এই সকল সংশোধনী অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন। 

প্রশাসন ও মিডিয়ার সংস্কারের জন্য কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে একাদশ ও দ্বাদশ দফায়। এগুলোর সংস্কারের জন্য কমিশন গঠনের প্রয়োজন নেই, সত্য কথা বলার স্বাধীনতা দিলেই সংস্কার হয়ে যাবে। ত্রয়োদশতম দফার বক্তব্য বেশ ইন্টারেস্টিং; এই দফায় বলা হয়েছে বিএনপি দুর্নীতির ক্ষেত্রে আপস করবে না এবং অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। পৃথিবীর কোনো শ্বেতপত্রে নিজ দলের লোকদের অপকীর্তির কথা বলা হয় না। শ্বেতপত্র প্রকাশ করলে জাতির লাভ হবে না, যদি দুর্নীতিবাজদের বিচার করে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সম্ভব না হয়। সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ করার কথাও এই দফায় যোগ করা হয়েছে। সংবিধানে থাকা সত্ত্বেও ন্যায়পালের নিয়োগ কোনো সরকার দেয়নি, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বিএনপি বলছে দেবে। 

চতুর্দশ দফায় সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কঠিন প্রতিজ্ঞা, আজ পর্যন্ত গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হলো না, আইনের শাসন হবে কী করে। যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মনোনয়ন বিক্রি হয়, দলীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পদ বিক্রি হয়, গঠনতন্ত্র মেনে কমিটি গঠিত হয় না, পরিবারের ইমেজে মনোনীত নেতার অভিমতে দল নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই দল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে বলে কেউ বিশ্বাস করে না। পঞ্চদশ দফায় অর্থনৈতিক সংস্কারে কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে।

ষোড়শ দফায় বিএনপি বলেছে, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। তারা বলেছে ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’- এটা ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি। কিন্তু রাষ্ট্র তো এখন ইসলাম ধর্মকে ধারণ করে আছে, এখন রাষ্ট্র তো সবার নয়, বিএনপি নিশ্চয় এবার ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম থেকে বাদ দেবে। সপ্তদশ দফায় বিরাজমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা কঠিন। ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার মতো অর্থ সরকারের কাছে নেই। মূল্যস্ফীতি রোধে শত শত আইটেমে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়, ধনী ব্যক্তিরা ঠিকমতো আয়কর দেয় না। অষ্টাদশ দফায় আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টদের আইন ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইন বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তবে হত্যাকারীদের রক্ষা করতে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামের সন্ত্রাসমুক্ত অভিযানের দায়মুক্তি আইন বিএনপি সরকারও করেছিল, সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় আদালত পরে এই আইন বাতিল করে দেয়। 

বিএনপি ঊনবিংশতিতম দফায় বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতর কোনো রকম সন্ত্রাসী তৎপরতা করতে দেওয়া হবে না মর্মে ঘোষণা দিয়েছে। বিংশতিতম দফায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে ত্রয়োবিংশতিতম দফায়। চতুর্বিংশতিতম দফায় নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করার উল্লেখ রয়েছে। পঞ্চবিংশতিতম ও ষষ্ঠবিংশতিতম দফায় চাহিদা ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের কথার উল্লেখ রয়েছে। শেষ দফায় কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা ছাড়াও কৃষিবীমা প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। 

ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কী কী করবে তার সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা এই সাতাশ দফায় উল্লেখ করা হয়েছে। ক্ষমতায় গেলে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে; এতে প্রমাণ হয় এবার তারা দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করবে। রাষ্ট্রকে ধর্মমুক্ত করার বিএনপির প্রতিশ্রুতিকে প্রশংসা করতে হয়। তবে তাদের রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের কথা না বলে সরকারকাঠামো মেরামতের কথা বলা উচিত ছিল।


লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫