
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ড. মশিউর রহমান, আমির হোসেন আমু, এ বি এম খায়রুল হক, অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন তা নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাজনের নাম আসছে। চলছে জল্পনা-কল্পনা।
সংবিধানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান থাকলেও যেহেতু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই পদে একাধিক ব্যক্তির নাম আসেনি এবং এবারও আসবে না বলেই মনে হচ্ছে, ফলে এই পদে নির্বাচনও হবে না। না হলেও রাষ্ট্রপতি পদ নিয়ে মানুষের আগ্রহ থাকে। থাকে বলেই রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগে থেকেই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হবেন তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
এবার সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর নাম। প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি ইতিহাস নির্মাণ করবেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর শিগগিরই জানা যাবে। যদিও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নামও এসেছিল। কিন্তু তিনি গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে মৃত্যুবরণ করেন।
আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর নামও শোনা যাচ্ছিল। তবে যেহেতু তিনি সম্প্রতি জাতীয় সংসদের উপনেতা হয়েছেন, ফলে তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে হচ্ছে।
কারণ তাকে রাষ্ট্রপতি বানানো হলে সংসদ উপনেতা পদে আবারও পরিবর্তন আনতে হবে। ফলে ধরেই নেওয়া যায় যে, তাকে রাষ্ট্রপতি বানানোর সম্ভাবনা থাকলে সংসদ উপনেতা করা হতো না।
এবার রাষ্ট্রপতি হিসেবে সম্ভাব্য নামের মধ্যে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা আমির হোসেন আমুও আছেন। কিন্তু তার সম্ভাবনাও কম। কারণ তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জোটকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং জোট বাড়ানোর কাজ অনেক ব্যাপক ও জটিল। রাষ্ট্রপতি হলে সেসব কাজ করা যাবে না।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানের নামও কোনো কোনো গণমাধ্যমে এসেছে। এবার সম্ভাব্য ব্যক্তিদের মধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নামও আছে। তবে শেষমেশ এই নামগুলোর মধ্য থেকেই কেউ রাষ্ট্রপতি হবেন নাকি এর বাইরে অন্য কেউ, সেটি জানতেও খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না।
তবে নির্বাচন হোক বা না হোক; পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে যাদের নামই আসুক এবং শেষমেশ যিনিই দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হোন না কেন, তার চেয়ে বড় কথা, যেহেতু বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রপতি পদটি আলঙ্কারিক; অর্থাৎ তার যেহেতু ওই অর্থে খুব বেশি ক্ষমতা নেই এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা মূলত প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক তথা সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু প্রধানমন্ত্রী, ফলে কে রাষ্ট্রপতি হলেন বা হবেন, সেটি দেশের রাজনীতিতে কতখানি জরুরি?
সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন এবং এই সংবিধান ও অন্য কোনো আইনের দ্বারা তাঁহাকে প্রদত্ত ও তাঁহার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করিবেন।’ কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন বলেও সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে।
এই বিধান পড়ে এটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। কেননা নির্বাচনে জয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানই যে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেটিই স্বীকৃত। রাষ্ট্রপতির পক্ষে এখানে অন্যথা করার সুযোগ নেই। প্রধান বিচারপতি কে হবেন, কার্যত সেটিও রাষ্ট্রপতি ঠিক করেন না। কারণ প্রধান বিচারপতি নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ার না হলেও এটি অনেক বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকারকে এখানে অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হয়। বিচারপতিরা যে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পান, সে কথা বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিবিদদের কথায়ও স্পষ্ট হয়েছে।
কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করা বা কারও সাজা মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার যে ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে, সেখানেও তিনি স্বাধীন নন। বরং প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়েই তিনি কাউকে ক্ষমা করেন। অর্থাৎ তিনি যা কিছু করেন তার সবই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে করেন।
জাতীয় সংসদে বছরের প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনী দিনে রাষ্ট্রপতি যে ভাষণ দেন, সেটিও মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হতে হয়। অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগ যেরূপ কথা বলার অনুমতি দেবেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি কেবল ততটুকুই বলবেন। ১৯৯৬ সালে একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে মন্ত্রিসভা একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে এই বিধান চালু করে। এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা নিয়ে অবশ্য কেউ চ্যালেঞ্জ করেছেন বলে মনে হয় না।
সাধারণ বিলের ব্যাপারে মতামত দিতে পারলেও অর্থবিলে রাষ্ট্রপতি কোনো ধরনের মতামত বা পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করে সংসদে ফেরত পাঠাতে পারেন না। সংসদ যা পাস করবে রাষ্ট্রপতি তাতেই সই দিতে বাধ্য। মানে হলো, সরকার রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করবে, কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতির কিছু বলার নেই।
সংসদে অনুমোদিত হওয়ার পর সব বিল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। তিনি মূলত সব বিলে সই করতে বাধ্য। কেননা তিনি যদি কোনো বিলে সই নাও করেন, তাহলে ১৫ দিন পরে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুমোদিত হয়ে যায়, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি সই করেছেন বলে গণ্য হবে। আবার রাষ্ট্রপতি যদি কোনো বিল সংশোধনের জন্য সংসদে ফেরত পাঠান, সেটিও সংশোধনে সংসদ বাধ্য নয়।
ফলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের রাষ্ট্রপতিগণ রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানীয় নাগরিক এবং একটি প্রতীক ছাড়া কিছু নন। সংবিধানই তার হাত পা বেঁধে দিয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জরুরি অবস্থা জারি করতে হলেও তাকে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে সরকার ও দলীয় প্রধান হওয়ায় দলের কোনো সদস্যকে কী পদ দেওয়া হবে; সংসদ নির্বাচনে কারা মনোনয়ন পাবেন; স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার পদে কারা নিয়োগ পাবেন; সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কারা মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাবেন; কারা সংসদে দলের চিফ হুইপ বা হুইপ নির্বাচিত হবেন- এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রী একক ক্ষমতা ভোগ করেন। তিনি চাইলে কারও সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন, না করলেও আইনত সেটি অবৈধ নয়।
সুতরাং এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি পদে থাকলেন কিংবা কে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হবেন, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য।
সংসদীয় পদ্ধতি চালুর প্রাক্কালে সংবিধানে যে ১২তম সংশোধনী আনা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এতটাই নিরঙ্কুশ করা হয় যে পুরো রাষ্ট্র ও সরকার কাঠামোয় রাষ্ট্রপতিকে একটি আলঙ্কারিক পদে পরিণত করা হয়েছে। অথচ ওই সময়ে যদি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য রাখার একটি বিধান যুক্ত করা হতো, তাহলে পরবর্তীকালে দেশে যেসব রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল, তার অনেকগুলোই এড়ানো যেত বলে মনে করা হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে, তখন রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে বটে, তখন রাষ্ট্রপতির আদৌ কিছু করার এখতিয়ার আছে কি না, সে প্রশ্নও সামনে এসেছে।
এরকম বাস্তবতায় বিএনপি সম্প্রতি ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ বা তাদের ভাষায় ‘মেরামতের’ জন্য যে ২৭ দফার রূপরেখা দিয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার কথা বলেছে। কিন্তু এটি করতে গেলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংশোধন করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের অনুমোদন লাগবে। তার আগে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে হবে।
সুতরাং ভবিষ্যতে কোনো দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে সংবিধান সংশোধন করবে কি না, সেটি এখনই বলা কঠিন। তবে রাষ্ট্রপতির পদটিকে নিছক আলংকারিক না রেখে এটিকে কার্যকর করার জন্য ভারসাম্য রক্ষার বিধান করা জরুরি।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা জরুরি এবং উভয়ের ক্ষমতা ও এখতিয়ার সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া দরকার। যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে রাষ্ট্রপতিকে যদি প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়, তাহলে সেখানে কোনো ভারসাম্য থাকে না।
বরং কিছু বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক ক্ষমতা থাকা উচিত। সেজন্য এই বিষয় নিয়ে একাডেমিক এবং রাজনৈতিক পরিসরে খোলামেলা কথা বলা উচিত এবং কথা বলতে দেওয়া উচিত।