
সম্পাদকীয়। প্রতীকী ছবি
আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এমন এক মহামারি, যার কোনো নিরাময় নেই যেন। কেবল বেড়েই চলেছে। বিগত ৮ বছরের মধ্যে ২০২২ সালে দেশে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
গত বছর ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৯ হাজার ৯৫১ জন। আহত হন ১২ হাজার ৩৫৬ জন। এই ধারা বহমান বর্তমান বছরেও। প্রতিদিনই খবরের কাগজের শীর্ষস্থান দখল করে থাকছে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহত হওয়ার সংবাদ।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। যাদের ৮১ শতাংশই আবার ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ । যারা তাদের পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে এসব পরিবার আর্থিকভাবেও চরম সংকটে পড়ছে।
দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থ-সামাজিক যে ক্ষতি হচ্ছে, তার হিসাব তৈরি করেছে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। আর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে মানবসম্পদের যে ক্ষতি হয়, তার আর্থিক মূল্য ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
২০১৮ সালে সবার জন্য নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সড়ক নিরাপদ হয়নি। বরং দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে যত মানুষ মারা যায়, তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ শতাংশই ছিলেন শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো নিয়ে আলোচনা, পরামর্শ রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক হলেও গত বছর সারা দেশে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ২৭ শতাংশই হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এমনকি দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকার সড়কেই দুর্ঘটনা ও মৃত্যু- দুটিই এখন সর্বোচ্চ।
জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যারা অঙ্গীকার করেছে ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে কাজ করবে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে পারেনি বাংলাদেশ, বরং তা বেড়েছে।
চালকের অদক্ষতা ও বেপরোয়া যানবাহন চালানোর পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়ক ও সেতুর নাজুক অবস্থাও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী। মহাসড়কে অটোরিকশা, নসিমন-করিমন ও মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচল এবং ব্যস্ত সড়কে ওভারটেকিং, ওভারলোডিং তদারক না করা সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। ত্রুটিপূর্ণ মহাসড়কের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক নিরাপদ করার কথা সরকার মুখে বললেও বাস্তবে সেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হলেও এর প্রতিকারে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। দুর্ঘটনা রোধে সরকার আইন করলেও তার যথার্থ প্রয়োগ নেই। সাজা ও জরিমানার পরিমাণ যা-ই নির্ধারণ হোক না কেন, তা বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ বাস্তবায়ন না হলে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান থাকলেও কোনো লাভ হবে না। সেই সঙ্গে পুরো সড়ক ব্যবস্থাপনা বদলাতে হবে।