Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

রাষ্ট্রভাষা ও রাষ্ট্র

Icon

আবুল কাসেম ফজলুল হক

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২১:৪৬

রাষ্ট্রভাষা ও রাষ্ট্র

ছবি: সংগৃহীত

আদিতে মানুষের ভাষা ছিল না, মানুষই ভাষা সৃষ্টি করেছে। আদিম মানুষ যৌথ জীবনযাত্রার ও প্রকৃতির সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, নিজেদের প্রয়োজনে, নিজেদের জৈবিক সামর্থ্যরে বলে, নিজেদের ভাষা সৃষ্টি করেছে এবং প্রয়োজনের তাগিদেই তাদের ভাষাকে বিকশিত ও উন্নত করে চলছে। কেবল বাকযন্ত্রের ক্রিয়া দিয়ে ভাষার মর্ম বোঝা যায় না। ভাষার সঙ্গে মানুষের গোটা অস্তিত্ব ও পরিবেশ জড়িত থাকে। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনপ্রয়াসে মানুষের ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি একসঙ্গে কাজ করেছে ভাষা সৃষ্টিতে। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, রুশ, চীনা, জাপানি, সংস্কৃত, হিব্রু, লাতিন, আরবি, ফারসি, বাংলা, উর্দু প্রভৃতি ভাষার ইতিহাস যতই সন্ধান করা যায় ততই এটা বেশি করে বোঝা যায়। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীরই ভাষা সৃষ্টি করার মতো জৈবিক সামর্থ্য নেই। মানুষের মতো ক্রমাগত নিজেকে এবং নিজের পরিবেশকে উন্নত করার সামর্থ্যও আর কোনো প্রাণির নেই।

গোটা ঐতিহাসিক কালব্যাপী সর্বত্রই দেখা যায়- মানুষের জীবনের সঙ্গে তার ভাষার, কিংবা নিজের ভাষার সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ভাষা ছাড়া জীবনযাপন চলে না। মানুষের আত্মবিকাশের এক পর্যায়ে তার জীবনের বিমূর্ত অঙ্গরূপে দেখা দিয়েছে ভাষা। সৃষ্টির ধারায় জীবন আগে না ভাষা আগে, এ প্রশ্নে অবশ্যই জীবনকে আগে পাওয়া যায়। দেখা যায়, জীবন যেখানে উন্নত ভাষাও সেখানে উন্নত এবং ভাষা যেখানে উন্নত জীবনও সেখানে উন্নত। ভাষার উন্নতি সাধিত হয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি এবং জাতীয় উন্নতির মধ্য দিয়ে। নিজের ভাষাকে উন্নত না করে কোনো ব্যক্তি কিংবা জাতি উন্নতি করতে পারে না। যে ব্যক্তি ভাষায় নিপুণ, সমাজে তার সাফল্য ও মর্যাদাও বেশি।

চিন্তা আগে না ভাষা আগে এ নিয়ে বিতর্ক আছে ভাষা তাত্ত্বিকদের মধ্যে। আমার ধারণা এ বিতর্ক অমীমাংসেয়; কারণ চিন্তা ও ভাষা অবিচ্ছেদ্য, একটিকে আগে অন্যটিকে পরে বলার উপায় নেই। মানুষের সব কর্মকাণ্ডেরই মর্মে কাজ করে চিন্তা বা ভাষা। কাজের বেলায় শ্রমশক্তি পরিচালিত হয় চিন্তাশক্তি দ্বারা। চিন্তা ও ভাষা অভিন্ন, অবিভাজ্য।

জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতির সঙ্গে ভাষার উন্নতি কিংবা ভাষার উন্নতির সঙ্গে জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতি অবিচ্ছেদ্য। কোনো জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতি আর ভাষার উন্নতিও অবিচ্ছেদ্য। ভাষাকে উন্নত না করে আত্মনির্ভর স্বাধীন আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতি সম্ভব হয় না। মানুষের জীবন ও পরিবেশ বিকাশশীল, ভাষাও বিকাশশীল। উন্নত জাতিগুলো তাদের ভাষার উন্নতির জন্য পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কাজ করে। সাম্রাজ্যবাদীরা তৎপর থাকে নিজেদের ভাষার উন্নতি সাধনে এবং দুর্বল জাতিগুলোকে ভাষার দিক দিয়েও নির্ভরশীল রাখতে।

ভাষা ও মানুষের জীবন এবং মানুষের জীবন ও ভাষা নিয়ে যতই চিন্তা করা যায়, তথ্যসুন্ধান ও বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়, ততই দুয়ের অবিচ্ছেদ্যতা ও উন্নতি সম্পর্কে ধারণা গভীর থেকে গভীরতর হয়। এসব লক্ষ্য করে বলা যায়, ভাষাকে নতুনভাবে জানা এবং ভাষায় আমরা যতটা গুরুত্ব দেই তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া আমাদের কর্তব্য।

মানুষ ভাষা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, ভাষা আয়ত্ত করে। ভাষা আয়ত্ত করার এবং বিকশিত করার সামর্থ্য মানুষের আছে। গোটা ইতিহাসজুড়ে মানুষকে এক অবস্থায় দেখা যায় না। মানুষ হয়ে-ওঠা প্রাণী। এই হয়ে-ওঠার বা উন্নতির প্রক্রিয়া চলমান। পরিবেশের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার, সেই সঙ্গে সমাজের অভ্যন্তরীণ বিরোধের মধ্য দিয়ে মানুষ বর্তমান অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছে। মানুষের এই হয়ে ওঠার বা উন্নতির মূলে আছে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনের ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি। 

পৃথিবীতে দুইশো ভাষায় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এসব ভাষা বিকাশমান। এগুলোর মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের দিক দিয়ে বাংলা ভাষার স্থান এখনো ওপরের দিকেই আছে। এগুলো ছাড়া বিভিন্ন মহাদেশে কয়েক হাজার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আছে; তাদেরও আলাদা আলাদা ভাষা আছে; তাদের ভাষা বিলীয়মান। বাংলাদেশে পঁয়তাল্লিশটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর পঁয়তাল্লিশটি বিলীয়মান মাতৃভাষা আছে। এই পঁয়তাল্লিশটি জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের সামান্য বেশি। এরা জন্মের পর থেকেই নিজেদের ভাষার মতো বাংলা ভাষাও শেখে। এদেরকে বলা যায় দ্বিভাষিক (নরষরহমঁধষ)। বাংলা ভাষাকেই তারা উন্নতির অবলম্বন মনে করে। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের লোকেরা জীবনযাত্রার ও উন্নতির প্রয়োজনে নিজেদের ভাষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রভাষা শিখছে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের উন্নতির সম্ভাবনা। বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সমূহের উন্নতির ও মানবজাতির মূল ধারায় আসার সুযোগ সর্বত্র বাড়াতে হবে। 

আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা ও উদ্দেশ্য থেকে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এর দ্বারা রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হচ্ছে এবং রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও নষ্ট হচ্ছে। নতুন ভবিষ্যত সৃষ্টিতে আমাদের এগোতে হবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারা ধরে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন, এনজিও ও ইউনেস্কো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নয়নের জন্য যে পথ প্রদর্শন করে, যেসব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম চালায়, অনেক সময় সেগুলো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নতির অন্তরায় হয়। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে নিজেদের উন্নতির জন্য পার্শ্ববর্তী বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে রাষ্ট্র গঠন করতে হয় এবং রাষ্ট্রভাষা শিখতে হয়। তারা যদি বাইর থেকে কিছুই গ্রহণ না করে এবং কেবল নিজেদের বিলীয়মান মাতৃভাষা ও নিজেদের অভ্যস্ত জীবনযাত্রা নিয়ে চলে, তাহলে তারা কোনোকালেই উন্নতি করতে পারবে না। যে কোনো জনগোষ্ঠীর জন্যই না-নিয়ে, না-দিয়ে নিজেদেরকে নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে রাখার ফল খারাপ হয়। আত্মবিকাশের ও উন্নতির জন্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে বাইরে থেকে ভালো জিনিস গ্রহণ করতে হবে। নিজেদের উন্নতির প্রয়োজনে রাষ্ট্রভাষাকে নিজেদের মাতৃভাষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে তাদের জীবনব্যাপী আয়ত্ত করা ও বিকশিত করে চলা সমীচীন। 

মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রভাষা বলতে কেবল অফিসের ভাষা বোঝায় না, বোঝায় তার সঙ্গে আরো অনেক কিছু। রাষ্ট্রভাষার মধ্যে অফিস চালানোর ভাষা আছে, সেই সঙ্গে আছে জাতীয় জীবনে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা; আছে কোনো জাতির আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভাষা। রাষ্ট্রভাষার উন্নতি হলে রাষ্ট্রের অন্তর্গত জাতির সভ্যতা উন্নত হয়। কোনো ভাষার অর্থনৈতিক ভিত্তি বিকাশশীল থাকলে সে ভাষা বিকাশশীল থাকে। আমাদের উপলব্ধি করা দরকার যে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার অস্তিত্ব ও উন্নতি অপরিহার্য। চলমান বহু ঘটনা আছে যেগুলো দেখে বলা যায়, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা না টিকলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ টিকবে না। দেশ থাকবে, মাটি মানুষ গাছপালা পশু-পাখি নদীনালা ও আকাশ-বাতাস থাকবে, কিন্তু রাষ্ট্র থাকবে না। যারা বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার বদলে ইংরেজির প্রচলন চান তারা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে রক্ষা করবেন কী?

ভৌগোলিক বাস্তবতা ও বাঙালি-চরিত্র লক্ষ করে, ১৯৭৩ সাল থেকেই কোনো কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি বলে আসছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার মতো নয়। তারা জোর দিয়েছেন বাঙালি-চরিত্রের নিকৃষ্টতায়। তাদের যুক্তি ও মত কখনো আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তারা অনেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিকত্ব নিয়েছেন এবং প্রায় সকলেই তাদের সন্তানদের ওইসব রাষ্ট্রে নাগরিক করেছেন। আমি সব সময় বাঙালি-চরিত্রের উন্নতি সম্ভব বলে মনে করেছি। আমি সব সময় মনে করেছি এবং এখনো মনে করি, বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রগতিশীল রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলা যাবে। সে লক্ষ্যেই আমাদের চিন্তা ও কাজ। জাতীয় হীনতাবোধ বাংলাদেশের ধনী-গরিব, শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাবঞ্চিত সব মানুষকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে। জনসাধারণ ঘুমন্ত। হীনতাবোধ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে। অবস্থার উন্নতির জন্য যা কিছু করা দরকার সবই আমাদের করতে হবে।

উচ্চ ও উচ্চমধ্য শ্রেণির লোকেরা, সরকারি ও সরকারবিরোধী উভয় মহল- তাদের ছেলেমেয়েদের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের নাগরিক করে চলছেন। মন্ত্রিপরিষদ, জাতীয় সংসদ, প্রশাসন ব্যবস্থার উচ্চপর্যায়, বিচারব্যবস্থার উচ্চপর্যায়, শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চপর্যায় লক্ষ করলেই এটা দেখা যায়। এই ব্যক্তিরাই বাংলাদেশে রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্তৃত্বে আছেন। বাংলাদেশে একদিকে আছে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ব্রিটিশ কাউন্সিল ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত ও-লেভেল, এ-লেভেল এবং অপরদিকে আছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নব-প্রবর্তিত ইংলিশ ভার্সন। এ-সবই বাংলাদেশের ভূভাগে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি।


আবুল কাসেম ফজলুল হক

প্রাবন্ধিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫