
আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি
পছন্দ হোক আর নাই হোক ক্রিকেট আমাদের প্রধান জাতীয় খেলা। চোখের সামনে অন্য কোনো খেলা নাই যাতে আমরা আন্তর্জাতিক লেভেলে খেলতে পারি এই ক্রিকেট ছাড়া। অতএব অন্য খেলা খেললেও এটাই আমাদের মূল আন্তর্জাতিক ইজ্জত অর্জনকারী থাকবে।
আমাদের দেশে ফুটবল অনেক জনপ্রিয় পৃথিবীর অন্য সকল দেশের মতোই। কিন্তু ওই খেলায় আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। আমাদের ব্রাজিল আর্জেন্টিনার ভক্ত হয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হবে আরও বেশ কিছুদিন। কিন্তু খেলার কি আদৌ দরকার আছে?
দুই
দরকার এই কারণে যে ভালো করলে অর্জনের কাণ্ড সবার মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। খেলার জয় সবার। যেখানে দলীয় রাজনীতি সব কিছু ভাগ করে ফেলেছে, সেখানে খেলাধুলা এখনো কিছুটা হলেও সবাইকে এক করে। বাংলাদেশের জন্য স্পোর্টস মানসিকভাবে টিকে থাকার একটি হাতিয়ার। গণহারে সস্তায় মাথা উঁচু করে হাঁটার দাওয়াই। তবে আমরা মাথা উঁচু করে হাঁটার চেয়ে নিচু করে বেশি হাঁটি। তবু আগামীতে কিছু হওয়ার চান্স থাকে।
তিন
খেলাধুলা আগে ছিল কেবল ছেলে/পুরুষদের ব্যাপার। কিন্তু এখন ছেলে-মেয়ে উভয়েই খেলে। এতে অনেক লাভ। একজন খারাপ করলে, অন্যজন ভালো করে, একজন হারলে অন্যজন জেতে। এটা এক ধরনের মানসিক বীমা বলা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দুইটা স্রোতের মধ্যে কোনটা বেশি জোরে ছুটছে? তুলনামূলক অর্জনের নমুনা আছে কি? কার আগানোর রেকর্ড কেমন?
চার
ছেলেদের/পুরুষের টেস্ট অবস্থান বেশ খারাপ। টেস্ট তালিকায় ১০ জনের মধ্যে ৯ নম্বরে জাতীয় টিম। আমাদের মেয়েরা টেস্ট খেলে না। ওয়ানডেতে র্যাংকিং হিসেবে ছেলেদের অবস্থান ৭, আর মেয়েদের হচ্ছে ৭, সমান সমান। টি-২০ র্যাংকিং ছেলেদের হচ্ছে ৯ আর মেয়েদের হচ্ছে ৯। মানে গড় হিসেবে তফাত নাই ছেলে-মেয়েদের মধ্যে। সেই দিক থেকে দুই দলেরই অর্জন বা তার অভাব কম বেশি এক। আমরা নিম্ন মধ্য ক্রিকেট টিম।
পাঁচ
বিশ্বকাপের তালিকায় আমাদের কারও নাম নাই। তবে এশিয়া কাপ দেখা যেতে পারে। ছেলেরা ৩ বার ফাইনালে গেছে কিন্তু একবারও জিততে পারেনি- ২০১২, ১৬, ১৮-তে। অন্যদিকে মেয়েরা ২০১৮ সালে কাপ জেতে কিন্তু আর ফাইনালে যেতে পারেনি। তাই মেয়েদের শিরোপা জেতার একটি উল্লেখ আছে।
ছয়
অনূর্ধ্ব-১৯ ওয়ার্ল্ড কাপ জেতে বাংলাদেশের ছেলেরা অতএব বড় অর্জন। আর মেয়েরা এবার সুপার সিক্স পর্যন্ত যায়। রান রেটের কারণে উঠতে পারেনি সেমিতে। বলা যায় দুই দলেরই অর্জন ভালো, কেউ কারও থেকে তেমন ওপরে না। দুই দলই মধ্য কিসিমের। কারও দিকে পাল্লা ভারী করা যায় না।
সাত
এবার আসা যাক বর্তমান হালে। বাংলাদেশে এখন বিপিএল চলছে কিন্তু তেমন দর্শক চাহিদা তৈরি করতে পারেনি। পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা খেলেছে এবং সবার নজর কেড়েছে। এই প্রসঙ্গে স্পষ্টবাদী কোচ সালাহউদ্দিন (কুমিল্লা), যিনি অন্য এক মন্তব্যের কারণে এরই মধ্যে দণ্ডিত হয়েছেন, প্লেয়ারদের সম্পর্কে বলেন, “আমাদের ও অন্য দেশের প্লেয়ারদের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। আমাদের ব্যাটাররা বড় শট মারতে পারে না। এটা মেনে নিতে হবে। খুব কম প্লেয়ার বড় শট খেলতে পারে। মানসিক দিক থেকে টপ প্লেয়াররা একটু অন্য রকম হয়ে থাকে। আমাদের ২-৪ জন প্লেয়ার সবলমনা বলা যায়, অন্যরা তেমন নয়। পাকিস্তানের রিজওয়ানের কথা ধরা যাক। খেলার প্রতি তার মনোনিবেশ ও কমিটমেন্টের শেষ নাই। নিবেদিতপ্রাণ সম্পূর্ণভাবে। যেভাবে নিজকে সামলে, দলকে সামলে সবাইকে এগিয়ে নিয়ে যায়- তেমন নিবেদিতপ্রাণ আমাদের মধ্যে খুব কম।”
আট
টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশের খেলা নিয়ে ক্রিকেট মহলে অনেক কথা হচ্ছে। এত বেহাল অবস্থা আগে দেখা যায়নি। তবে মনে হয় না উন্নতি হবে সহসা। এত টাকা, এত ফ্যান, এত সব কিছু পেলে কেবলা ঠিক না থাকারই কথা। আর বাংলাদেশে যদি অন্য কারও কাজের জন্য জবাবদিহিতা না থাকে তবে ক্রিকেটারদের থাকবে কেন?
নয়
ইদানীংকার ফর্ম ভিত্তিতে ওয়ানডেতে আমরা কিছুটা ভালো, কিন্তু বড় শট মারতে পারি না এবং মনেও করি না এর দরকার আছে। ওয়ানডে দ্রুত গুরুত্ব হারাচ্ছে ক্রিকেট দুনিয়ায়। টি-২০ এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় ভার্সন। অতএব টিকতে হলে খেলতে হবে কিন্তু তার জন্য প্রস্তুতি দরকার। কিন্তু ছেলেরা সেটা পারছে এমন প্রমাণ নেই। মেয়েদের কী হাল?
দশ
অনূর্ধ্ব-১৯ ওয়ার্ল্ড কাপের খেলায় বাংলাদেশ সেমিতে উঠতে পারেনি, কিন্তু সেটা রানরেটের জন্য- পয়েন্টের অভাবের জন্য নয়। ইন্ডিয়া, অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ ও সাউথ আফ্রিকার সমান পয়েন্ট ছিল- ৬। প্রথম পর্বে বাংলাদেশ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো টিমকে হারায়। এ ছাড়া বিগ হিটার হিসেবে কয়েকটি মেয়ে সবার নজর কেড়েছে। এটা খুব উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী তথ্য। তবে আমরা এই অনূর্ধ্ব-১৯ লেভেলে ভালো করলেও পরে আর তেমন সচল সবল না। এমনকি আমাদের সিনিয়র নারী দল ইদানীং ভালো করছে না। গত ২৫ ম্যাচে জয় পায়নি ওয়ার্ল্ডকাপে। অতএব গলদ এক জায়গায় নয়, অনেক স্থানে।
এগারো
শেষ কথা হচ্ছে আমরা শুরুতে- আন্ডার-১৯-এ বেশ ভালো থাকি, কিন্তু তারপর নিজেদের হারিয়ে ফেলি। অনেক কারণে এটা হয়। খেলতে পারলে আয় রুজি, দেশের ক্রিকেটে টাকার ছড়াছড়ি, তাই জিতলেও আছি, হারলেও আছি। প্রেশার নাই ভালো করার। শেখার ইচ্ছা কম, যেটা অনেকেই বলেছে। ফিটনেস নিয়ে মাথা ঘামাই না। তাই জন্মগত দক্ষতা আছে, পরিশ্রম, আগ্রহ, তিতিক্ষা নাই। দোষটা প্লেয়ারদের একার না। রাজনীতি থেকে খেলার মাঠ, কেবল বোল্ড।
সাহিত্যিক, গবেষক