
সম্পাদকীয়
আমাদের ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর হয়ে গেল। বিশ্বে একমাত্র বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে রক্ত ঝরেছে। যার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোতে যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি। এমন একটি ভাষার প্রতিনিধিত্বকারী দেশ হিসেবে এই ভাষার সম্মান আমরা কতটুকু রক্ষা করছি তা বিভিন্ন সময়ই প্রশ্নের সম্মুখীন।
আমাদের যেমন শুদ্ধ বাংলায় লেখা গদ্যের আকাল এখন, তেমনি চারপাশে দেখা যাচ্ছে দিন দিন বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড কমছে, অফিস আদালতে দেদার চলছে ইংরেজির ব্যবহার। এমনকি সাধারণ নোটিশও এখন ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে।
আর বানান নিয়ে বিশৃঙ্খলা তো সর্বত্রই। যদিও এর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী করা হয় খোদ বাংলা একাডেমিকেই। বিকল্প বানান তৈরি করে, মানুষের মধ্যে দুই বানানের দ্বিধা তৈরি করেছে বাংলা একাডেমি নিজেই। ‘কাহিনি’ না ‘কাহিনী’, ‘অলংকার’ না ‘অলঙ্কার’, ‘রং’ না ‘রঙ’, ‘শহিদ’ না ‘শহীদ’, ‘উপলক্ষ্য’ না ‘উপলক্ষ’, ‘ছোট’ না ‘ছোটো’- এরকম অজস্র উদাহরণ আছে।
আবার বানানের সাধারণ নিয়মে বিদেশি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণে দীর্ঘ-স্বর পরিহার করা হয়। কিন্তু অহরহ চোখে পড়ে ‘জানুয়ারী’ বা ‘ফেব্রুয়ারী’ বানান। এমনকি বাংলা একাডেমি প্রণীত অভিধানেও বেশ কিছু ইংরেজি শব্দকে দীর্ঘ-ঈকার দিয়ে লেখা হয়েছে। যেমন- বাংলা একাডেমি প্রণীত আধুনিক বাংলা অভিধানের সবশেষ সংস্করণের ৩০৮ নম্বর পৃষ্ঠায় দেখা যায়, Keyboard-কে বাংলায় লেখা হয়েছে: কী-বোর্ড।
একই ভাবে ‘ইদ’, ‘গোরু’ ইত্যাদির মতো অসংখ্য শব্দ আছে যা দুই বানানে লেখা হয়ে থাকে। বানান সম্পর্কিত এসব প্রশ্নে বাংলা একাডেমি শেষ পর্যন্ত জানাতে বাধ্য হয়, তাদের সর্বশেষ অভিধানে কিছু ভুলত্রুটি ঘটে গেছে, পরবর্তী সংস্করণে যা সংশোধন করা হবে। কিন্তু অভিধানের নতুন সংস্করণেও সেসব ‘ভুলত্রুটি’র অধিকাংশই অপরিবর্তিত আছে।
পাকিস্তান শাসনামল থেকে বাংলাদেশে বাংলা বানান নিয়ে কাজ হলেও কার্যত তা নানা জটিলতায় আলোর মুখ দেখেনি। এখন বাংলা একাডেমির উচিত হবে বিকল্প তৈরি করা বানানগুলোর ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়া।
বাংলা একাডেমির বানান বিষয়ক কমিটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দাবি অনুযায়ী নতুন কিছু নিয়ম সংযোজন করে ‘প্রমিত বাংলা বানান’-এর নিয়মাবলি তৈরি করেছে। তবু বাংলা বানান নিয়ে সংকটের অবসান হয়নি। একেকজন একেকরকম বানান লিখছেন। প্রমিত বানান সবাই মানছেন না। তাই বাংলা বানানকে এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে মুক্ত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। এ ব্যাপারে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই।
সেই সঙ্গে আমরা কেন নিজের ভাষাতেই এত বানান ভুল করি, সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। কম শিক্ষিত, অসচেতন লোকদের দিয়ে ব্যানার বা দেয়াল লিখনের কাজ করানো যাবে না। এতে ভুল বানানগুলোতেই আমাদের চোখ অভ্যস্ত হয়ে যায়। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে আমাদের শিশুরা যাতে বানানের প্রতি বিশেষ যত্নবান হয় সে ব্যাপারে, বিশেষ করে শিক্ষকদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।