Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

মুখের ভাষাকে সম্মান করতে হবে

Icon

শানু মোস্তাফিজ

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৩১

মুখের ভাষাকে সম্মান করতে হবে

শানু মোস্তাফিজ। ফাইল ছবি

প্রখ্যাত লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একবার ঢাকা লিট ফেস্টে এসেছিলেন। সেখানে তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “আমি নানা রকম শব্দ খুঁজি। এই শব্দ খোঁজার জন্য অনেক সময় নানা জায়গায় ঘোরাফেরা করি। যেখানে সাধারণ মানুষরা ভিড় জমায় সে রকম জায়গায় গিয়ে তাদের কথা শুনি। এভাবে আমাদের পরিচিত শব্দের বাইরে অনেক নতুন শব্দ খুঁজে পাই এবং সেগুলো আমি আমার উপন্যাসে ব্যবহার করেছি।” 

শীর্ষেন্দু বড় মাপের লেখক। তার অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণ গভীর। তিনি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার নানা কৌশল জানেন। তবে তিনি যেভাবে নতুন শব্দ সাহিত্যে যোগ করেন তা নিঃসন্দেহে অনেক বড় কাজ। এভাবেই একজন লেখক সমাজের বাস্তব চিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি ভাষাকেও সমৃদ্ধ করে থাকেন।  

এ ধরনের গভীর বোধসম্পন্ন ভাবনা সাম্প্রতিক দেশকালের সম্পাদকের মাঝেও দেখতে পাই। তিনি বলছিলেন, গ্রামে যে ভাষা রয়েছে অর্থাৎ গ্রামের তাঁতি, কৃষক, শ্রমিক বা খেটে খাওয়া মানুষগুলো যে ভাষায় কথা বলেন কিংবা তারা যে ধরনের শব্দগুলো ব্যবহার করেন সে সবের মূল্য রয়েছে। কেননা গ্রামীণ ভাষাই আমাদের ভাষার প্রাণ। আমরা যখন খুবই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করি সেই ভাষা কি আসলেই আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-বেদনার সাথি? আমাদের জীবনে সকল অনুভূতি কি সেই ভাষায় প্রকাশ পায়? আমরা কি জীবনের শুরু থেকেই এ ভাষায় কথা বলি? 

প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক। এ দেশের প্রায় প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনো এলাকার বাসিন্দা। সাধারণত ছোটবেলা থেকে আমরা সেই এলাকার ভাষায় কথা বলতে শুরু করি। এর পর ধীরে ধীরে তা পরিবর্তন করে অনেকেই একেবারে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলি। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এতে দোষের কিছু নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি শুধু সেই ভাষা ব্যবহার করব? যে ভাষায় আমরা নিজ নিজ এলাকায় আগে কথা বলতাম তা পরিত্যাগ করছি কেন? 

কারণ সেটা ওই সব এলাকার চাষা-ভুষারা ব্যবহার করে বলে আমরা তা ব্যবহার করি না। কৃষক এবং শ্রমিক শ্রেণির মানুষরা যে ভাষায় কথা বলেন সে ভাষার নৃ-তাত্ত্বিক মূল্য রয়েছে। এর সঙ্গে কৃষি এবং উৎপাদনের সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যদি উন্নয়নের বিষয়গুলো গুরুত্ব দেই তাহলে তাদের কথা এবং ভাষারও গুরুত্ব রয়েছে। উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা জমিতে ধানের বীজ লাগানোর বিষয়টিকে বলে, জমিতে ধানের বেচন লাগাই। তারা বীজকে বেচন বলে। 

আবার দুই জমির মাঝখানের রাস্তাকে তারা জমির মাললি বলে। একই রকমভাবে তারা জমিতে সেচ দেয়ার বিষয়টিকে বলে জমিতে পানি দিতে হবে। তাই গ্রামীণ জীবন, কৃষি এবং কৃষকদের বুঝতে হলে তাদের ভাষাকে বুঝতে হবে। একইভাবে শ্রমিক, মজুর ও তাঁতিদের ভাষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো আমরা শিল্প-সাহিত্যে ব্যবহার করে আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারি। 

আবার দেখা যায়, আমরা যখন গ্রামে যাই তখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় শুদ্ধভাবে কথা বলার চেষ্টা করি। অথচ এক সময় এ সব লোকের সঙ্গে আমরা একই ভাষায় কথা বলতাম। শহরে থাকার পর যখন তাদের কাছে যাই তখন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করি তাদের চেয়ে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা এবং অর্থ ও প্রতিপত্তিতে অনেক উপরে। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে তাদেরকে মানসিকভাবে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি আমরা উন্নত। এ প্রচেষ্টা কি সঙ্গত? নাকি এ চর্চা কৃত্রিম? এভাবে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি হয়। মানুষের অমর্যাদা হয় এবং তাদেরকে মূলধারার বাইরে রেখে আমরা কাজ করি। যা ঠিক নয়। ভুলে গেলে চলবে না গ্রামীণ জীবনের সংস্কৃতি ও ভাষা আমাদের নিজস্ব এবং সেটাই আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাণ। 

কয়েক বছর থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে, এক শ্রেণির মানুষ অতিরিক্ত শুদ্ধ ভাষা বলতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভাষা ব্যবহার করছে। বাংলা ভাষার মূল জায়গা বাংলাদেশ। সেই দেশের মানুষ যদি পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের উচ্চারণ এবং ঢঙে কথা বলেন তাহলে কি বলা যায় আমরা আমাদের অবস্থানই জানি না? যে দেশ নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য এত রক্ত দিল, এত ত্যাগ করল সে দেশের মানুষ অন্য দেশের ভাষার অনুকরণ করছে এটা কি চরম লজ্জার বিষয় নয়?  

আরেক শ্রেণির মানুষ শিল্প সাহিত্যে নানা পদক পাচ্ছেন। পদক পাওয়ার আগে বা পরে তারাও শুদ্ধ ভাষা যেভাবে বলেন তাতে মনে হয় রপ্ত করা এ ভাষায় কথা বললে সত্যিকারের সংস্কৃতিবান হওয়া যায়। এটিও ভুল চর্চা। যে ভাষা আমার নিজস্ব পরিচয়কে মুছে দেয়, মৌলিকতাকে গুরুত্ব দেয় না সেই ভাষার চর্চা কতটা যৌক্তিক? শুদ্ধ ভাষা চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। সেটা শিক্ষাদান, বক্তৃতা, লেখার কাজে কিংবা বইপত্রে অনেক বেশি  প্রয়োজন। 

কেননা সেখানে মানসম্মত ভাষা ব্যবহার না করলে সকলেই তা বুঝতে পারবে না। নিজ ভাষার মূলে প্রবেশ না করলে নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরা যাবে না। এজন্য কয়েক বছর ধরে আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা নিজেদের ভাষা রক্ষার জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করছে। 

ভাষা ও শব্দ নিয়ে আমাদের দেশে একটি চক্র কিছু ভুল কাজ করছে। যা কিছু জাতিসত্তাকে আঘাত করছে। যেমন পার্বত্য অঞ্চলের কিছু জায়গার নাম পরিবর্তন হয়েছে। যে কোনো ভাষা বা নামের একটি স্থানীয় প্রভাব থাকে, যার সঙ্গে ওই স্থানের কোনো ঘটনা বা স্মৃতি জড়িত। এগুলো ঐতিহাসিক বিষয়। সেটা পরিবর্তন করে বাংলা নামকরণ ঠিক নয়। 

জানা যায়, খাগড়াছড়ির আদি নাম ছিল হাগারাছড়ি। চাকমা ভাষায় হাগারা অর্থ নলখাগড়া। ওই অঞ্চল এক সময় নলখাগড়ায় ভরপুর ছিল বলে এ নামকরণ হয়। কিন্তু তা পরিবর্তন করে খাগড়াছড়ি করা হয়। একইভাবে চিম্বুকের আদি নাম ছিল তাজিংডন। সেটা পরিবর্তন করে চিম্বুক করা হয়। এগুলো মোটেও কাম্য নয়। 

ভাষার এই সংবেদনশীলতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কাজ করা উচিত। ১৯৯৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তৎকালীন সরকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণার জন্য একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত করার কথা ভাবেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। 

এর পর ঐ ইনস্টিটিউট গড়ে উঠতে বহুদিন সময় লাগে। ২০১০ সাল থেকে ইনস্টিটিউটটি স্বল্প পরিসরে কাজ শুরু করে। সরকারিভাবে দেশে ৫০টি ভাষা স্বীকৃতি পেয়েছে। বলা হচ্ছে, এই ভাষাগুলো ছাড়াও আরও বহু ভাষা রয়েছে। ভাষা ইনস্টিটিউট এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে পারে। বাস্তবে তাদের কাজ নিয়ে মানুষের স্বচ্ছ ধারণা নেই। তাদের কার্যক্রম দেখলে মনে হয় শুধু ভাষা দিবসটি পালন করা নিয়ে তারা কাজ করে। 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিট উপরের সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করতে পারে। শুদ্ধভাষা চর্চার পাশাপাশি লেখক-শিল্পীরা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা নিয়ে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। দেশে বহু শ্রেণি, পেশা এবং গোষ্ঠীর মানুষ রয়েছেন। শুধু বাংলা সর্বত্র ব্যবহার হোক এমন কথার সঙ্গে অন্যদের মুখের ভাষাকে আমাদের সম্মান করতে হবে এবং সে সব ভাষাকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক ও গবেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫