Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

আপনার দেশ কই? কিন্তু দেশ মানে কী?

Icon

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৩, ১১:২০

আপনার দেশ কই? কিন্তু দেশ মানে কী?

আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি

আমার জন্ম ঢাকা শহরে ১৯৫২ সালে, ফেব্রুয়ারির গুলির ৫ দিন আগে। আমার জন্ম পাড়ার নাম টিকাটুলী, গলির নাম অভয় দাস লেন। ১৯৪৮ সালে চাকরি সূত্রে ঢাকায় আসে মা-বাবা কলকাতা থেকে। তবে ইন্ডিয়া ছাড়াটাও বড় কারণ ছিল। আমার বাবা বড় হন কলকাতায়, তাই ওই শহরের ওপর টান ছিল আজীবন বা আমৃত্যু। তার জন্ম নোয়াখালীর রায়পুর উপজেলার কেরোয়া গ্রামে। 

কিন্তু বাবা বড় হয়েছেন তার বড় বোনের কাছে, যিনি ঘুরেছেন নানা জায়গায় স্বামীর চাকরি সূত্রে। শেষে ছিলেন কলকাতায় যেখানে বাবা বড় হন। ১৯৪৭-এর পর ফুপা ছিলেন পাকিস্তানের  ইংরেজি পত্রিকা ‘ডন’-এর সম্পাদক। তাই ফুপু করাচিতে শায়িত, বাবা ঢাকায়। বাবার একমাত্র ভাই কলকাতায়। বাবার কলকাতা গমন রায়পুরের যোগাযোগের সুতাটা ছিঁড়ে দেয় তার জন্য, আমাদের জন্য তো বটেই। আমাদের কোনো ‘দেশ-গ্রাম’ নাই। 

দুই

আর মার কাছে যেখানে সংসার সেটাই দেশ। আমার মা ওই দিক থেকে চলে আসা মানুষ। কিন্তু শুধু মা না, তার সকল মামাতো-খালাতো-চাচাতো বোনের একই কথা। যেখানে সংসার, সেটাই দেশ।

তিন

আমার মার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলি/জনাই জেলায়, বড় হওয়া অবশ্য আসামের শিলং শহরে যেখানে নানার ব্যবসা ছিল। মার বিবাহ ও প্রথম দুই সন্তান কলকাতায়। মা ১৯৪৬-এর দাঙ্গা দেখেছিলেন। এক নিরীহ দুধওয়ালাকে খুন হতে দেখেছিলেন তাদের বাসার নিচে। নিরীহ হিন্দু দুধওয়ালা খুন হলো দাঙ্গাবাজ মুসলমানের হাতে। বারান্দা থেকে মা-সহ সবাই চিৎকার করে বলেছিল, ও হিন্দু না, ও তো দুধওয়ালা। ওই পরিচয় তো ওর কাজে। 

ভীষণ অপছন্দ করতেন ওই খুনের শহরকে। আমি একবার এক ভারতীয় চ্যানেলের- জি বাংলার হয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমার চলে আসা আত্মীয়দের। কোনো নস্টালজিয়া ছিল না ওদের, মা-খালাদের কথায়। ঢাকার সুশীল এপার বাংলা ওপার বাংলা টাইপের লোকজন কষ্ট পাবে শুনলে। সাক্ষাৎ বাবু, কলকাতার লোক কিন্তু পছন্দ করে ঢাকা। আমার মার ভাষায়, “আমি ইন্ডিয়ান হতে যাব কেন, এটা আমার দেশ।”

চার

আমাদের ছোটবেলায় দেখাশোনা করত মার এক দেশের বাড়ির লোক যাকে ‘কালো চাচা’ বলে ডাকতাম। সে পালিয়ে এসেছিল কলকাতা থেকে। সোনার গহনা পালিশ করত কলকাতার এক দোকানে। দোকানটা ছিল হিন্দু এলাকায়। দাঙ্গাকালে তার ওপর আক্রমণ হয়। মাথায় শরীরে ছুরি মেরে ড্রেনে ফেলে দিয়ে চলে যায়। কপালে মৃত্যু ছিল না বলেই বেঁচে যায় সে। পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে হাসপাতালে দেয়। মাথায় বড় বড় উঁচু জমাট মাংসের পিণ্ড ছিল। আমরা ওতে হাত বুলাতাম। সে কি মুসলমান না গ্রামে থেকে আসা ঘষা মাজার সহকারী? না দুধওয়ালা? তার দেশ কই?

পাঁচ

আশির দশকের দিকে আমি একটি ছোট গবেষণা করি মানুষের দেশ ভাবনা নিয়ে। আমার উদ্দেশ্য ছিল অনুসন্ধান করা বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন মানুষ কী ধারণা রাখে। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখলাম ‘দেশ’ বলতে সবাই এক বিষয় বোঝে না। সবচেয়ে বেশি পার্থক্য ছিল শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে। অর্থাৎ ‘দেশ’ বলতে সবার এক ধারণা নেই।

ছয়

আমার জন্ম টিকাটুলীতে, বড় হয়েছি দিলু রোডে, পড়েছি ঢাকার উইলস ও শাহীন স্কুল, ঢাকা কলেজ, ও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। বাল্যকালের প্রতি কোনো নস্টালজিয়া নাই। গ্রামের সাথে সম্পর্ক নাই অতএব কল্পিত টানও নাই। কাজের সূত্রে গেছি পৃথিবীর বহু দেশে। থেকেছি, ফিরে এসেছি। অভিবাসী ছিলাম কানাডায়। ৫ বছর পর ফিরে আসি। কেবল এই পচা দেশের নাগরিক। বিদেশের কিছুই টানে না। আধা বিত্তহীন ৭১ বছরের বৃদ্ধ যাকে মাস এনে মাস চালাতে হয়। অ্যাপার্টমেন্ট, পেনশন, জমি, টাকা কিছুই নেই। অথচ সব দিলেও আমি কোথাও যাব না। কিসের টান দেশে? দেশ কী?

সাত 

১৯৬৩ সালে পাকিস্তানে ছিলাম এক বছর। আমার বয়স তখন ১১। এত ঢাকায় ফিরে আসতে চেয়েছিলাম বলতে পারব না। বহু দেশে কাজের সুবাদে গেছি, কিন্তু সেটা তো দেশে থাকা সংসারের মানুষদের জন্য। যারা ট্রেনিং নেয় ইন্ডিয়াতে যুদ্ধের কালে, সেটাও দেশে থাকা মানুষের জন্য। শরণার্থীরা যায় কেবল নিজেকে নয় পরিবারকে বাঁচাতে। যারা দেশে থেকে লড়াই করেছে সেটাও নিজের মানুষের দিকে তাকিয়ে। আমরা যা-ই করি না কেন, সেটা বোধহয় দেখা আর না দেখা নিজের মানুষদের জন্য।

আট

একদিন কানাডায় খবর পেলাম মা মারা গেছেন। মনে হলো আর তো দেশে ফেরার দরকার নাই। দেশ মানে তো মা যেখানে থাকে। সেই তো নেই। একই সাথে, আমি তখন প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয় সহায়তার জন্য একটা কাজ করছিলাম, সেটা ফেলে আসিনি। নিজের কষ্টের চেয়ে দায়িত্ব বড় এটা পরিবারের শিক্ষা। তাই ফিরেছি অনেক পরে। থাকব না বলে। কিন্তু ফিরলাম কোথায়?

নয়

গ্রামের মানুষ বোঝায় ‘দেশ’ মানে তার নিজের গ্রাম। শহর তার দেশ নয়, শহর কাজের জায়গা। ইদানীং গ্রামের বহু মানুষ অভিবাসী হওয়ার ফলে তাদের জগৎ অনেক বড় হয়ে গেছে। যে গবেষণার সাথে আমি ইদানীং যুক্ত তাতে এই বিষয়টা আসছে। দেশ ভাবনা নিজের কাছে, সবার এজমালি ভাবনা নয়। আমাদের যে প্রাতিষ্ঠানিক ‘দেশ’ মানে পতাকা, সরকার, রাষ্ট্র ক্ষমতা এই সব ভাবনা যতটা প্রভাবশালী মনে করি ততটা নয়। 

সমাজে আর রাজনীতিতে দেশের যে সংজ্ঞা তা এক নয় সবার কাছে। দেশের মধ্যে গ্রাম, জেলা, উপজেলা, পাড়া, পরিবার সবই আছে। দেশ একাধিক বাস্তবতা মিলে একটা কিছু। এতটা নিরেট কিছু নয়। আমার দেশ কই? আপনি দেশ বলতে কী বোঝেন?

দশ

রাষ্ট্র, পতাকা, ভূমি সবই দেশের অংশ। তবে মানুষের আসল দেশ নিজের বুকের ভেতর থাকে। সংসার, গ্রাম, পাড়া, বাচ্চা কালের স্কুল, ইউনিভার্সিটির আড্ডা, কাজের জায়গা, ভালোলাগার, ভালোবাসার মানুষ সব মিলে দেশ। আসলে দেশটা বোধহয় কোনো বিমূর্ত বাস্তবতা, কেবল মনের ভেতর যার বসবাস। ইন আস্ত ওয়াতানাম, এই আমার দেশ।

সাহিত্যিক, গবেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫