
মুহাম্মদ তানিম নওশাদ
আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামো ও পররাষ্ট্রনীতির সুবাদে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের মানুষের কাছেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অপছন্দনীয়। পশ্চিমের এসব দেশের অর্থনীতি নিও-লিবারেলিজম বা নব্য-উদারতাবাদ নামক দর্শনের একটি শাখা থেকে উদ্ভূত, যার একটি নাম আছে ‘নব্য-উদার-অর্থনীতি’। পশ্চিমের দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতিও এই মতাদর্শ ও তা থেকে উদ্ভূত দর্শন দ্বারা পরিচালিত।
আমাদের দেশের অনেকে অবশ্য এই মতাদর্শের বিষয়ে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল নন। পশ্চিমা দুনিয়া এই মতাদর্শের ভিত্তিতেই পৃথিবীতে দাপটের সঙ্গে শাসন করতে পারছে। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে কেন এবং কীভাবে? তাহলে কি এই অর্থনৈতিক দর্শনের কোনোই ইতিবাচক দিক নেই?
আঠারো শতাব্দীর স্কটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০) এবং তার উত্তর-সাধকগণ এই তত্ত্বের আদি পিতামহ, তবে তারা ছিলেন উদার-অর্থনীতির পথিকৃৎ। তারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ এবং সুরক্ষাকবচের বিরোধী ছিলেন।
পরে অবশ্য এই মতাদর্শের বহু শাখা গজিয়েছে, যার একটি হলো নব্য-উদার-অর্থনীতি, যেটি এখন বিশ্বের কর্তৃত্বে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকাল থেকে সমাসীন। একটি বিষয়ে অবশ্য উদার-অর্থনীতির সব ধারাই একমত, আর তা হচ্ছে বাজার উন্মুক্ত থাকলেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য ব্যয় করবেন, এতে পণ্যের মান হবে ভালো এবং তার দাম হবে যথার্থ।
ফলে এগুলো নিশ্চিত করতে প্রতিযোগিতা হতে হবে সীমাহীন। সরকারি হস্তক্ষেপ প্রতিযোগিতার মনোভাব নষ্ট করে, সেই সঙ্গে সম্ভাব্য উপযুক্ত প্রতিযোগীকে বাজারে অনুপ্রবেশে বাধা দেয়। যদি বাজার অগণতান্ত্রিক সরকারের হাতে পড়ে, তবে তা একচেটিয়া কারবারের জন্ম দিতে পারে। ফলে এই ধারার অর্থনীতিবিদরা গণতন্ত্রকে অপরিহার্য মনে করেন, আর তাদের গণতন্ত্রের মার্কা বা ব্র্যান্ডের নাম ‘নব্য-উদার গণতন্ত্র’।
সেই সূত্রে এই ধারা যে পুঁজিবাদের জন্ম দিয়েছে, তার নাম মুক্তবাজার পুঁজিবাদ। নব্য-উদার গণতন্ত্র মানবসম্পদ বিকাশের জন্যও মুক্তবাজার অর্থনীতিকে বিকল্পহীন মনে করে। উন্মুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীতার মাধ্যমেই ব্যক্তি তার বিকাশ ঘটাবে ও তার যোগ্যতার প্রমাণ রাখবে, এই তাদের মীমাংসা। নব্য-উদার-অর্থনীতির মূল তাত্ত্বিককেন্দ্র আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর প্রধান ত্রিতাত্ত্বিকের দুজন হচ্ছেন দুই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ- মিল্টন ফ্রিডম্যান ও ফ্রিডরিখ অগাস্ট ফন হায়েক।
আর শেষ ব্যক্তিটি হলেন হেনরি কালভের্ট সিমন্স। পরে অবশ্য এ বিষয়ে আরও রথী-মহারথীর আবির্ভাব বিশ্বজুড়ে হয়েছে। যেমন ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান অর্থনীতিবিদ ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জগদীশ নাতওয়ারলা ভগবতী। যা হোক নব্য-উদার-অর্থনীতি একটি বিষয়ে সবার কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, তা হচ্ছে এটি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা সৃষ্টির মাধ্যমে পণ্যের ও সেবার গুণগত মানবৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।
যদি বাজার অগণতান্ত্রিক সরকারের হাতে পড়ে, তবে তা একচেটিয়া কারবারের জন্ম দিতে পারে। ফলে এই ধারার অর্থনীতিবিদরা গণতন্ত্রকে অপরিহার্য মনে করেন, আর তাদের গণতন্ত্রের মার্কা বা ব্র্যান্ডের নাম ‘নব্য-উদার গণতন্ত্র’। সেই সূত্রে এই ধারা যে পুঁজিবাদের জন্ম দিয়েছে, তার নাম মুক্তবাজার পুঁজিবাদ। নব্য-উদার গণতন্ত্র মানবসম্পদ বিকাশের জন্যও মুক্তবাজার অর্থনীতিকে বিকল্পহীন মনে করে।
উন্মুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীতার মাধ্যমেই ব্যক্তি তার নিজের বিকাশ ঘটাবে ও তার যোগ্যতার প্রমাণ রাখবে, এই তাদের মীমাংসা। ফলে এই মতাদর্শ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, আর তা হলো এই মতাদর্শ অন্তত তাত্ত্বিক জায়গায় স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের বিরোধী। যদিও বাস্তব দুনিয়ায় পশ্চিমানীতি ইতিহাসে এর বহু ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। কিন্তু অন্তত তাত্ত্বিক জায়গায় এটি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে, যা এর একটি বড় ইতিবাচক দিক।
অন্তত পশ্চিমা দেশগুলো ঢালাওভাবে স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের পক্ষে নয়, যেখানে কম্যুনিজমের নামে গত শতাব্দীতে স্ট্যালিনপন্থি, মাওপন্থি ও পলপটের খেমারুজ নৃশংস গণহত্যার ইতিহাস রচনা করেছে। এটিও নিও-লিবারেলিজমের জনপ্রিয়তার ও বিশ্বনিয়ন্ত্রণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
জার্মান ভাবাদর্শে কার্ল মার্ক্স ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস মানব জীবনের উদ্দেশ্য বলতে মানুষের সৃজনশীলতার চূড়ান্ত বিকাশের কথা বলেছেন। মার্ক্স ও এঙ্গেলসের কাছে প্রলেতারিয়েতের ক্ষমতারোহণ সৃজনশীলতার বিকাশের জন্য সাধারণ মানুষের যে অর্থনৈতিক মুক্তি দরকার শুধু সেই পর্বটি মাত্র। কিন্তু ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণচীনে তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। সেসব দেশে প্রলেতারিয়েতের ক্ষমতারোহণের মধ্য দিয়েই সমাজে মার্ক্সবাদের বিকাশমানতার ইতি ঘটেছে।
অন্যদিকে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার মধ্য দিয়ে বরং পুঁজিবাদী অনেক রাষ্ট্রই মার্ক্সীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছে। মানুষের সৃজনশীলতার বিকাশের জন্য দরকার তার চিন্তার উন্মুক্তি ও স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, যার দুটিই সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুপস্থিত ছিল এবং বর্তমান ও ভূতপূর্ব কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রগুলোতে অনুপস্থিত।
মনে পড়ে চীনা ভাষা অধ্যয়ন করতে যাওয়ার পর আমার চীনদেশীয় শিক্ষিকাদের একজন বলেছিলেন, বাণিজ্যিক ইংরেজি শিক্ষণ এবং বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য চীনা ভাষার শিক্ষিকা হওয়ার সিদ্ধান্তটি তার নিজের নয়, বরং রাষ্ট্রের। অন্যদিকে পশ্চিমা দুনিয়ায় শিক্ষার্থীদের পরামর্শক ছাত্র-ছাত্রীকে উপদেশ দিতে পারেন, কিন্তু মূল সিদ্ধান্ত ঐ শিক্ষার্থীরই, অন্তত ঐ বিষয়ে যদি ঐ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা করার যোগ্যতা থাকে।
তথাকথিত কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রগুলোতে তো রাষ্ট্রের তথা কম্যুনিস্ট দলের বিরুদ্ধে কোনো টুঁ শব্দটি করার জো নেই, সিদ্ধান্ত গ্রহণ তো দূরের কথা। এটি ঠিক পশ্চিমের অনেক দেশও আর আগের মতো গণতান্ত্রিক নেই। কিন্তু তাই বলে, সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললে তো তাকে হাওয়া করে দেওয়া হয় না।
নিও-লিবারেলিজমের কট্টর সমালোচক ও ভ্লাদিমির পুতিনের মস্তিষ্ক নামে খ্যাত আলেকসান্দর দুগিনও তার ‘দ্য ফোর্থ পলিটিক্যাল থিওরিতে’ স্বীকার করেছেন যে, অনেক সীমাবদ্ধতার পরও নিও-লিবারেলিজম ফ্যাসিজম ও কম্যুনিজমের চেয়ে ভালো এবং ঐ দুইকে সে তার স্বগুণেই বিশ্ব-রাজনৈতিক মঞ্চে পরাস্ত করেছে (পৃ. ৯-১২)। দুগিন এই বইতে রাশিয়ার জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক মতাদর্শ কামনা করেছেন, কিন্তু তিনি রাশিয়াকে ফ্যাসিবাদ বা কম্যুনিজমে গমন করতে অনুপ্রাণিত করেননি।
যা হোক অনেকে বলেন, জার্মান ভাবাদর্শ তো মার্ক্স ও এঙ্গেলসের প্রথম দিককার রচনা। আমার প্রশ্ন, মার্ক্স ও এঙ্গেলস কী বলেছেন যে, আমাদের প্রথম দিককার রচনা আমরা বিসর্জন দিয়েছি। সে ক্ষেত্রে কম্যুনিস্ট ইশতেহারও তো তাদের প্রথম দিককার রচনা, তাহলে কম্যুনিস্টরা সেটিকে আঁকড়ে ধরে আছে কেন?
আমার বক্তব্য শুধু এটুকুই যে, নিও-লিবারেলিজমকে ঢালাওভাবে সমালোচনার আগে আমরা জেনেবুঝে নেই, অন্য রাজনৈতিক দর্শনগুলোর তুলনায় তার বৈশ্বিক দাবি কতটুকু।
গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক