
মাওলানা লিয়াকত আলী। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের অফুরন্ত রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের অমিয় বার্তা নিয়ে আগমন করছে ১৪৪৪ হিজরির মাহে রমজানুল মুবারক। প্রতিদিন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও কামাচার থেকে নিয়ত সহকারে নিবৃত্ত থাকার মাসব্যাপী বিধানের জানান দিতে পশ্চিম আকাশে উদিত হবে নতুন চাঁদ। দিনে সিয়াম পালন ও রাতে তারাবিহ সালাতসহ বিভিন্ন ইবাদতে অনেক বেশি আত্মনিয়োগের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন আল্লাহর মুমিন বান্দারা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ঘোষিত পুরস্কারের আশায় মহান প্রভুর দরবারে সমর্পিত হওয়ার সূচনা হয় শাবান মাসের শেষদিনের বিকেলে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই খোশ আমদেদ জানায় পবিত্র মাসটিকে।
মহানবী (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় যাওয়ার পর দ্বিতীয় বছরে মাহে রমজানের এই বিশেষ বিধান নিয়ে নাজিল হয় কুরআন মজীদের সূরা বাকারার ১৮৩ ও ১৮৪ নং আয়াত। ইরশাদ হয়- ‘হে মুমিনরা, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হলো, যেমনভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের আগে যারা ছিল তাদের ওপর- এই আশায় যে, তোমরা মুত্তাকি হবে। নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন। আর যে কেউ অসুস্থ হয় কিংবা সফরে থাকে, তার জন্য অন্যান্য দিন থেকে এই সংখ্যা (পূরণ করা কর্তব্য)। আর যারা এতে অক্ষম হয়, তাদের কর্তব্য ফিদয়া আদায় অর্থাৎ দরিদ্রকে খাবার দেওয়া। যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো কল্যাণ কাজ করবে, সেটি তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর তোমরা রোজা রাখবে, এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে।’
তারিখে ইবনে জরীর ও আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া’য় বলা হয়েছে, হিজরি দ্বিতীয় সনের ১০ই শাবান ফরজ হয় রমজানের রোজা। এ বছরেই রমজানের আগে কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ আসে। এর আগে নবী করীম (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম আশূরা বা মহররম মাসের দশম তারিখ ও আইয়ামে বীজ বা প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখতেন। তবে এসব রোজা তখন ফরজ ছিল কি না, তা নিয়ে মতভেদ আছে। হানাফিরা মনে করেন এসব রোজা ফরজ ছিল। কিন্তু শাফেয়ীদের মতে রমজানের রোজা ফরজ ছিল না। বরং আশূরা ইত্যাদির রোজা আগেও সুন্নত ছিল, এখনো সুন্নত।
হানাফিদের পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায় আবু দাউদ শরীফের একটি হাদিস থেকে। আবদুর রহমান ইবনে মাসলামা তার চাচা থেকে বর্ণনা করেন, আসলাম গোত্রের লোকেরা নবী করীম (সা.)-এর কাছে এলে তিনি তাদের প্রশ্ন করেন, তোমরা কি আজকের এ দিনে (অর্থাৎ আশূরার দিনে) রোজা রেখেছ? তারা বলল, না। তিনি বললেন, তাহলে তোমরা তোমাদের দিনটির অবশিষ্ট অংশ পূর্ণ করো এবং এটি কাযা করো। ইমাম আবু দাউদ বলেন, অর্থাৎ আশূরার দিন। বোখারি শরীফে হজরত সালামা ইবনুল আকওয়া রা. থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সা.) আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তিকে এ মর্মে ঘোষণা করা আদেশ দিয়েছিলেন যে, কেউ খেয়ে থাকলে সে যেন দিনের অবশিষ্ট অংশ রোজা রাখে। আর যে ব্যক্তি খায়নি, সে যেন রোজা রাখে। কেননা আজ আশূরার দিন। মুসলিম শরীফে হজরত রুবায়্যে বিনতে মুয়াওয়াজ ইবনে আফরা রা. থেকে বর্ণিত আছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) আশূরার দিন সকালের দিকে মদীনার আশপাশের আনসারদের পল্লীগুলোতে এ মর্মে খবর পাঠিয়েছিলেন যে, সকাল থেকে যে ব্যক্তি রোজা অবস্থায় আছে, সে যেন তার রোজা পূর্ণ করে। আর যে ব্যক্তি রোজাহীন রয়েছে অর্থাৎ সকালে নাশতা খেয়েছে, সে যেন দিনের অবশিষ্ট অংশ পূর্ণ করে। সেই অনুযায়ী এর পর আমরা রোজা রাখতাম এবং ইনশা আল্লাহ আমাদের ছোট বাচ্চাদের রোজা রাখাবো।
বোখারি শরীফে হজরত আয়েশা রা. এর বর্ণনা আছে। তিনি বলেন, আশূরার দিনে কুরাইশরা ইসলামপূর্ব যুগে রোজা রাখত। আল্লাহর রাসুলও ইসলামপূর্ব যুগে এদিনে রোজা রাখতেন। যখন তিনি মদীনায় এলেন, তখন তিনি এদিনে রোজা রাখতে আদেশ দিলেন। তারপর যখন রমজান ফরজ হলো, তখন তিনি আশূরার দিনটি ছেড়ে দিলেন। ফলে যে চাইল রোজা রাখল, আর যে চাইল ছেড়ে দিল।
রমজানের এই সিয়াম পালনকে ইসলামের অন্যতম ভিত্তি বলে ঘোষণা করেন মহানবী (সা.)। হাদীছের বিশুদ্ধতম গ্রন্থ বুখারী ও মুসলিম শরীফসহ বিভিন্ন গ্রন্থে সঙ্কলিত আল্লাহর নবীর বাণীতে বলা হয়েছে ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি- এ মর্মে সাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহছাড়া উপাস্য নেই ও এ মর্মে যে মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায়, হজ আদায় ও রমজানের সিয়াম আদায়।
আয়াত ও হাদীছের দ্বারা রমজানের সিয়াম পালন যেমন আবশ্যিক বলে প্রমাণিত হয়, তেমনি এই ইবাদতটির অসাধারণ মাহাত্ম্য ও প্রতিদানের সুসংবাদও দেয়া হয়েছে। হজরত সালমান ফারসী রা. বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) শাবানের শেষে একদিন আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণে বললেন, হে লোকেরা, তোমাদের মাথার ওপর এসে পড়েছে এক মহান মাস, এক কল্যাণময় মাস। এমন মাস. যাতে রয়েছে এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম এক রজনী। আল্লাহ এ মাসের রোজা রাখাকে করেছেন ফরজ, আর রাতের দাঁড়ানো (ইবাদত)কে করেছেন ঐচ্ছিক। যে ব্যক্তি এতে কোনো নেককাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করবে, তার জন্য থাকবে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায়ের সমান প্রতিদান। আর যে ব্যক্তি এতে একটি ফরজ আদায় করবে, তার জন্য থাকবে অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান প্রতিদান। যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য রয়েছে পাপ মোচন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং রোজাদারের মতোই তাকে প্রতিদান দেয়া হবে। কিন্তু রোজাদারের প্রতিদান কমানো হবে না। প্রশ্ন করা হলো- হে আল্লাহর রাসূল, রোজাদারকে ইফতার করানোর মতো সামর্থ্য আমাদের প্রত্যেকের নেই। তিনি বললেন, যে কেউ কোনো রোজাদারকে একটু দুধ, একটি খেজুর কিংবা একটু পানীয় দিয়ে ইফতার করাবে, তাকেই আল্লাহতায়ালা এ প্রতিদান দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্ত করে আহার করাবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে হাউজে কাওছার থেকে পানি পান করাবেন। এ মাসের প্রথমভাগে রহমত, মধ্যভাগে মাগফিরাত ও শেষভাগে রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি। এটা ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত। এটা সমবেদনার মাস। এ মাসে মুমিনের রিজিক বাড়িয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি তার অধীনস্থের কাজের ভার লাঘব করবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। তাছাড়া বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, হজরত আবু হুরায়রা রা.বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজানের সিয়াম পালন করবে, তার ইতঃপূর্বেকার পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।
বস্তুত দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুমিন বান্দারা মহামহিম প্রভুর প্রিয়পাত্র হওয়ার সুযোগ লাভ করবে। এ জন্য আগে থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া উচিত যাতে এই পবিত্র মাসের কল্যাণ যথাসম্ভব বেশি অর্জন করা যায়। বিশেষ করে তাকওয়া অর্জনের যে উদ্দেশ্য সিয়াম পালনের মধ্যে নিহিত, তা সফল হতে হলে রমজানের প্রথম মুহূর্ত থেকেই সযত্নে চেষ্টা চালানো প্রয়োজন। কেননা আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি হলো তাকওয়া।
রমজান মুমিনের জীবন সাজানোর শ্রেষ্ঠ সময়। এজন্য প্রথমে প্রয়োজন সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু আত্মাকে নিষ্কলুষ করা। দীর্ঘ এগারো মাসের পাপাচারের কারণে অন্তরে যে কালিমা লেপন হয়েছে তা দূর করতে হবে। কুপ্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরতে হবে। সামনের দিনগুলোতে প্রবৃত্তিসমূহ যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাপাচার ত্যাগ করার মনোবৃত্তিই পাপকার্য থেকে বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বড় সহায়ক। রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন. ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও পাপকার্য থেকে বিরত রইল না তার রোজা অর্থহীন উপবাস ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (বুখারী শরীফ)