Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ড. ইউনূসকে নিয়ে বিশ্ব নেতৃত্বের তৎপরতা

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৩, ১১:০৮

ড. ইউনূসকে নিয়ে বিশ্ব নেতৃত্বের তৎপরতা

আমীন আল রশীদ। ছবি: সংগৃহীত

সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি আলোচিত চরিত্র। 

সবশেষ খবর, ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের ‘আচরণ’ নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি দিয়েছেন বিশ্বের রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা, শিল্পকলা ও শিক্ষা ক্ষেত্রের ৪০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি (যাদের অনেকেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত নন)।

যেখানে ড. ইউনূসকে ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের একজন’ অভিহিত করে লেখা হয়েছে, ‘ড. ইউনূসের ভালো থাকা, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মানবিক উন্নয়নে তিনি যে অবদান রেখে চলছেন, তা অব্যাহত রাখতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে আমাদের গভীর উদ্বেগ রয়েছে।’ 

প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে ওই খোলা চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘আমরা নিশ্চিত, আপনি জানেন যে বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসের অবদান, বিশেষ করে অতিদরিদ্র ও সবচেয়ে বিপদাপন্ন মানুষের জন্য তার অবদান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও সম্মানিত। কিন্তু তার মতো একজন অনবদ্য পরিশুদ্ধ মানুষ ও তার কার্যক্রমগুলো আপনার সরকারের অন্যায় আক্রমণের শিকার হচ্ছে। বারবার হয়রানি ও তদন্তের মধ্যে পড়ছে। এমনটা দেখতে পাওয়া বেদনাদায়ক।’

চিঠির শুরুতে অবশ্য বাংলাদেশের মানুষের সাহস ও উদ্ভাবনী দক্ষতার প্রশংসা আছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও এটি দেখা যায় যে, কাউকে কোনো বিষয়ে সতর্ক করার আগে ভদ্রতাবশত তার কাজের কিছু প্রশংসাও করা হয়। এ ক্ষেত্রেও সম্ভবত সেটিই ঘটেছে।

এ ধরনের একটি খোলা চিঠি যে শুধু ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো হয়েছে তা-ই নয়, বরং ওয়াশিংটন পোস্টের মতো একটি প্রভাবশালী পত্রিকার পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে বিজ্ঞাপন আকারে ছাপানো হয়েছে। তার মানে বিবৃতিদাতা বা খোলা চিঠিদাতারা চেয়েছেন সারা পৃথিবীর মানুষ চিঠিটা পড়ুক।

অর্থাৎ এখানে শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ এবং তার হস্তক্ষেপ কামনাই মুখ্য নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে ওই ৪০ জন বিশিষ্ট নাগরিক বাংলাদেশের সরকার সম্পর্কে এমন একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, ড. ইউনূসের মতো একজন ‘অনবদ্য পরিশুদ্ধ মানুষ’ বাংলাদেশ সরকারের অবিচারের শিকার হচ্ছেন। 

মনে রাখতে হবে, এটি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের বছর এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ নানা ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি আছে। যার ফলে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ওপরে তারা নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। সুতরাং এই খোলা চিঠির সঙ্গে ওই সব ঘটনাপ্রবাহের সম্পর্ক থাকা অসম্ভব নয়। 

যারা এই খোলা চিঠি দিয়েছেন তাদের মধ্যে ড. ইউনূসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, প্রয়াত মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডির ছেলে টেড কেনেডি জুনিয়রও রয়েছেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, হঠাৎ করে কেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ৪০ জন নেতা ড. ইউনূসের পক্ষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এমন একটি খোলা চিঠি দিলেন? আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে কি এর কোনো যোগসূত্র আছে? 

একটু পেছনে ফেরা যাক। ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি গঠিত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (ওয়ান ইলেভেন বা এক এগারোর সরকার) প্রধান হওয়ার জন্য ড. ইউনূসকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি রাজি না হয়ে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের প্রস্তাব করেন। ওই সময়ে তিনি ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনেরও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেটি হালে পানি পায়নি। 

তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। ২০১৩ সালের জুন মাসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং একই মাসে বিএনপির আরেকটি প্রতিনিধি দল খালেদা জিয়ার অভিনন্দনপত্র নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে।

ওই বছরের ৭ জুলাই বিকল্পধারা বাংলাদেশ-এর একটি প্রতিনিধি দল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় করে। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির সঙ্গেও তিনি মতবিনিময় করেন। ভাসানী অনুসারী পরিষদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও তিনি কথা বলেন। (ডয়েচেভেলে, ২৭ আগস্ট ২০১৩)।

কিন্তু এখন আবার কেন ড. ইউনূসকে নিয়ে আলোচনা? 

অনেকের ধারণা, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার যদি হয়, সেই সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসকে ভাবা হতে পারে। যদিও বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুযোগ নেই। আবার বিরোধীদের দাবির মুখে সরকার যদি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনে, ড. ইউনূস কি সেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হতে রাজি হবেন?

কেননা ২০০৭ সালেই ড. ইউনূস এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাহলে তাকে নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়া, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি অন্য কোনো পরিকল্পনা করছে? তারা কি ড. ইউনূসকে বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে দেখতে চায়? সেটি কি আদৌ সম্ভব? 

বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানই সরকার প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকেন। ড. ইউনূসের কোনো রাজনৈতিক দল নেই। তিনি যদি এককভাবে কিংবা কোনো দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তারপরও তার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া কঠিন।

তাহলে কি তিনি সরকারের বাইরে থাকা সবচেয়ে বড় দল বিএনপিতে যোগ দেবেন? বিএনপি যদি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়, তারপরও কি জিয়া পরিবারের বাইরে অন্য কেউ কিংবা দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাইরে অন্য কারও প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব? যদি এই সম্ভাবনাও না থাকে তাহলে তৃতীয় অপশন কী হতে পারে? 

অনেকের ধারণা, আগামী নির্বাচনের আগে বা পরে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হতে পারে, যে সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসকে হয়তো ভাবা হচ্ছে। কিন্তু সেই জাতীয় সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে এবং জাতীয় সরকার গঠনের মতো বাস্তবতা দেশে তৈরি হয়েছে কি না বা হবে কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। 

স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের মে মাসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধ্যাপক রেহমান সোবহান কিংবা ড. কামাল হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করে একটি ‘জাতীয় সরকারের ফর্মুলা’ উপস্থাপন করেছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তার প্রস্তাব ছিল, গণভোটের মাধ্যমে ওই জাতীয় সরকার নির্বাচিত হবে, যারা দুই বছর দায়িত্ব পালন করবে।

ওই সরকারে কারা থাকবেন এরকম আরও কয়েকজন সম্ভাব্য ব্যক্তির নামও বলেছিলেন মি. চৌধুরী। যেমন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভুইয়া, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন, সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন প্রমুখ। (যমুনা টেলিভিশন, ১৬ মে ২০২২)।

প্রশ্ন হলো, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ওই জাতীয় সরকার ধারণার সঙ্গে সম্প্রতি ড. ইউনূসের পক্ষে বিশ্বের ৪০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের খোলা চিঠির কি কোনো সম্পর্ক আছে? আরও বড় প্রশ্ন, ড. ইউনূসকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বলয়ের অন্যান্য রাষ্ট্র ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আগ্রহের কারণ কী? অন্যদিকে ড. ইউনূসের প্রতি বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তথা ক্ষমতাসীন দলের বিরাগের কারণ কী, সেটিও বড় প্রশ্ন। 

সবশেষ প্রশ্নের উত্তর অনেকেরই জানা। যেমন ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ তিনি পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল না পেয়ে অর্থনীতিতে পেলে হয়তো তার প্রতি সরকার বা সরকারি দলের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম হতো। 

তাছাড়া ড. ইউনূসের শান্তিতে নোবেল পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে নানারকম যে কথাবার্তা প্রচলিত আছে তার পেছনে আছে নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক। অনেক সময়ই বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি এমন ব্যক্তিদেরকেও নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। যেমন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দুই মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধরত থাকলেও তাকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়। 

ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন প্যারেজকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলেও বিতর্ক ওঠে। কম্বোডিয়ায় বোমা বর্ষণ, দক্ষিণ আমেরিকায় সামরিক শাসনকে সমর্থনসহ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত থাকা সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারও শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। 

আইনি লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পর গ্রামীণ ব্যাংকে পদ পুনরুদ্ধার করার জন্য ড. ইউনূস বিদেশি শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে লবিং করেন। বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের আইনপ্রণেতা, তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী চেরি ব্লেয়ারকে লবিং করে তার পক্ষে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য সরকারকে চাপ দেন। (বাংলা ট্রিবিউন ১২ মার্চ ২০২৩)।

তবে অনেকে মনে করেন, ড. ইউনূসের প্রতি সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের বিরাগ বা ক্ষোভের আরেকটি কারণ হতে পারে তার আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও খ্যাতি। অর্থাৎ বাংলাদেশের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি ও ক্ষমতাকাঠামোয় ড. ইউনূস মূলত একজন ‘আউটসাইডার’। ফলে বিশ্বের অসংখ্য মানুষ যখন ড. ইউনূসের নামে বাংলাদেশকে চেনে, এটাও তার প্রতি বিরাগভাজনের একটা কারণ হতে পারে।

তবে তার প্রতি সরকার বা সরকারি দলের বিরাগের কারণ যা-ই হোক না কেন, তাকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্র এবং বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আগ্রহ বা উৎসাহের কারণও বোঝা দরকার। প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র কী মনে করে যে বাংলাদেশের কোনো দল এখানে তাদের স্বার্থ পুরোপুরি সংরক্ষণ করতে পারছে না যেটি ড. ইউনূস পারবেন?

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫