Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

সংকীর্ণতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে মানুষ হোক আরও সুন্দর

Icon

আলমগীর খান

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১৩:০৫

সংকীর্ণতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে মানুষ হোক আরও সুন্দর

আলমগীর খান। ছবি: সংগৃহীত

এই পৃথিবীর উৎপত্তির এক বিশালতা আছে যা বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত হলেও কল্পনাকে হার মানায়। বৈজ্ঞানিক সত্য ও আবিষ্কারসমূহের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব থাকে যা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনাচরণে সহসা বা ধীরে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিক নিয়ে নানারকম প্রশ্ন থাকলেও তাত্ত্বিক দিকগুলো জানা ও বোঝা মানুষের জন্য কল্যাণকর, যেহেতু তা হৃদয়কে বৃহৎ ও মহৎ করে।

মানুষ, জীবজগৎ, পৃথিবী ও প্রকৃতির উৎপত্তির পৌরাণিক, ধর্মীয় ও সবশেষে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। এর মধ্যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পরিবর্তনশীল, নিয়মিত আধুনিকায়িত, বিজ্ঞানীরা সর্বজনগ্রাহ্য, চমকপ্রদ ও নতুন দিক উন্মোচনকারী। বর্তমান আলোচনা এ নিয়েই, কেননা তা আমাদের মানসিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে সহায়ক। 

সূর্য, পৃথিবী ও অন্যান্য সদস্য মিলে আমাদের সৌর পরিবারটির জন্ম ৪৬০ কোটি বছর আগে-একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। আমাদের শরীরের প্রত্যেকটি পদার্থের উৎপত্তি সেই বিস্ফোরণের ফলে। অতএব মানুষ আসলে একমুঠো নক্ষত্রধূলি। পৃথিবীর সব জীবই তাই-সেই বিস্ফোরণে উৎপন্ন মুঠো মুঠো নক্ষত্রধূলি। অবশ্যই তার জীবরূপের বিচিত্র বিবর্তন হয়েছে কোটি কোটি বছরের ধারাবাহিকতায়। কিন্তু গোড়ায় সেই ধূলি-স্টারডাস্ট। 

অতএব মানুষের উৎপত্তি যে এক স্বর্গীয় বা আসমানি নকশার অংশ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এই নকশাটি বৈজ্ঞানিকভাবে আবিষ্কার হতে বহুকাল লেগেছে। কিন্তু তাতে কী? মানুষ মনে মনে ঠিকই জেনেছে যে সে আসমানি ধুলার সন্তান। তাই আকাশের সঙ্গে তার মানসিক যোগ অনেক পুরনো, দৈনন্দিন ও তরতাজা। মানুষের নিত্যকার কথাবার্তায় ও সংস্কৃতিতে রয়েছে তার ছাপ। 

আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ ও তারা নিয়ে মানুষ কত ছড়াগান বানিয়েছে। আর ধীরে ধীরে খুলেছে রহস্যের জট। নিছক কৌত‚হল নিবৃত্তির জন্য মানুষ এসব করেনি। আকাশের রহস্য উন্মোচনের সাধনা তার বেঁচে থাকার সংগ্রামে জয়ের জন্যযেমন কৃষি সভ্যতার শুরু থেকে সেচের ও শস্য চাষের জন্য কিংবা বাণিজ্যের ও বসবাসের প্রয়োজনে দেশদেশান্তরে যাওয়ার জন্য মানুষকে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি জানতে ও বুঝতে হয়। দেখা যাচ্ছে, মানুষের বেঁচে থাকা ও ভালোমন্দ অনেকাংশে নির্ভর করে আকাশের বাসিন্দাদের চালচলনের ওপর।  

কোরআন শরিফে বর্ণিত গ্রহনক্ষত্র নিয়ে আলোচনায় ইসলামি পণ্ডিত ফেতুল্লাহ গুলেন লিখেছেন গ্রহনক্ষত্র মানুষের জন্য সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা মানুষ ও তারার মাঝে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। ন্যূনতম সম্পর্কের কথাও যদি বলি, তাহলে বলতে হয় তারাদের সাহায্যে মানুষ দিকনির্দেশনা পেয়ে থাকে। এই সূরাটি সে কথাই ঘোষণা করছে : ‘এবং তিনি পথ নির্ণায়ক চিহ্নসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং তারকা দ্বারা মানুষ পথের খোঁজ পায়।’ (সূরা আন নাহল ১৬:১৬) 

মানবজীবন ও আসমানের যোগসূত্র সম্পর্কিত ধারণা ও বিশ্বাস কিছু বাড়াবাড়িও তৈরি করেছে। যার ফলে জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে বেরিয়ে অপবিজ্ঞান হিসেবে জ্যোতিষশাস্ত্রের শাখা তৈরি হয়। জ্যোতিষশাস্ত্র মানবজীবনের ওপর গ্রহনক্ষত্রের কাল্পনিক প্রভাবের গল্পগাথা তৈরি করেছে। তা সত্তে¡ও এটা সত্য যে, গ্রহনক্ষত্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই গভীর। 

আর তাই আমাদের সাপ্তাহিক দিনগুলোর নাম রাখা হয়েছে গ্রহনক্ষত্রের নামে। যেমন-রবি (সূর্য), সোম (চাঁদ), মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি ইত্যাদি। ইংরেজিতে মান্থ ও মানডে শব্দের উৎস চাঁদ বা মুন। একইভাবে বাংলায় এসেছে ‘মাস’ ও ‘সোম’। সোমরস পান করলে মানুষের পাগলাটে ভাব দেখা দেয়, যাকে ইংরেজিতে বলে লুনাটিক, মানে চন্দ্রিল। নারীর ঋতুচক্রকে চাঁদের ইংরেজি ও বাংলা প্রতিশব্দ অনুসারে ‘মেনস্ট্রুয়েশন’ বা ‘মাসিক’ বলে। আবার আমাদের চোখে প্রিয়জনদের মুখ সবসময় চাঁদের মতো সুন্দর।  

ইংরেজি বারের নামগুলো চাঁদসূর্য ছাড়াও আসমানি দেবতাদের নামে দেওয়া। এ সম্পর্কে মার্কিন জ্যোতিপদার্থবিদ কার্ল সাগান তাঁর Pale Blue Dot: A vision of the human future in space বইতে লিখেছেন, “ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ইতালিয়ানসহ সব ভাষায় এই মিল আরও স্পষ্ট কেননা এ ভাষাগুলো প্রাচীন ল্যাটিন থেকে উৎপন্ন। যেখানে সপ্তাহের দিনগুলোর নাম সান, মুন, মারস, মারকারি, জুপিটার, ভেনাস ও স্যাটার্নের নামে।” ঠিক বাংলার মতো। 

বিশে^র অনেক ধর্মে ঈশ^রের বাস আসমানে। কয়েকটি বড় ধর্মগ্রন্থ আসমান থেকে আগত মনে করা হয়, তাই এগুলোকে বলে আসমানি কিতাব। গ্রহ, নক্ষত্র ও আসমান পৃথিবীতে জীবনের সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে আমরা তা অবচেতনে বুঝলেও সচেতনভাবে প্রায় খেয়ালই করি না। দৈহিকভাবে মানুষ পৃথিবীতে আবদ্ধ, কিন্তু তার মনের বিচরণ সুদূর আসমানে। পৃথিবী নামক গ্রহের সঙ্গে আমরা শৃঙ্খলাবদ্ধ হলেও ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চাঁদে অবতরণের মধ্য দিয়ে মানুষ প্রথমবারের মতো সে শৃঙ্খলও ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।   

১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো মানুষ উড়াল দিল পৃথিবীর সীমানার বাইরে। এখন সে পা ফেলতে চায় আরও দূরে লাল গ্রহ মঙ্গলে। অচিরেই মানুষ হতে চলেছে এক আন্তনাক্ষত্রিক সত্তা। সেদিনের হোমো স্যাপিয়েন্স আজ হতে চলেছে আসমানি নাগরিক। কল্পনার মহাশূন্য পরিণত হচ্ছে আমাদের বাস্তব দেশে। 

এখনই মানুষের সময় সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র, জাত্যাভিমান, সাম্প্রদায়িকতাসহ সকল অন্ধত্ব পরিত্যাগের ও পাশবিকতার শৃঙ্খল ছুড়ে ফেলে মানবিকতাকে মুক্ত করার। প্রয়োজন পশুত্বের নয়, মানবিকতার উৎসবের। হিংসাদ্বেষ, লোভ-লালসা, হিংস্রতা ও যুদ্ধবিগ্রহের ঘৃণ্য পরিচয় পরিত্যাগ করে ভালোবাসা, সহানুভ‚তি, সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও মঙ্গলাকাক্সক্ষার বিজয়পতাকা উড়ানোর এখনই সময়।

মানুষ পাখির মতো উড়তে চেয়েছে, বহুকাল আগে থেকেই সে স্বপ্ন দেখেছে স্বর্গে যাওয়ার ও আকাশে উড়বার। গাথায়, কাব্যে, চিত্রে, নৃত্যে, সঙ্গীতে ও নানাভাবে সে তার ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছে। প্রাচীন ‘গিলগামেশ’ মহাকাব্যে (খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ) কবি বলেছেন, “বন্ধু, কে তুমি আকাশে চড়তে পারবে?” অথবা মৃত ফারাওয়ের জন্য শ্লোকে বলা হয়, “আকাশের সিঁড়িটা নেমে আসুক যাতে সে স্বর্গে উঠে যেতে পারে। দেবতাগণ, রাজাকে কোলে তুলে নাও। উঠাও তাকে, আকাশে তোলো। আকাশে! আকাশে!” (সাগান, পেল ব্লু ডট)   

মানুষের অতীত সব স্বপ্ন সত্য হচ্ছে, বিশেষ করে তার শূন্যের সমুদ্রে উড়বার স্বপ্ন। কিন্তু পৃথিবীকে নরক বানিয়ে স্বর্গে ছুটে পালাবার কোনো মানে হয় না। কারণ পৃথিবীর সমান তো দূরে থাক, আজ পর্যন্ত এর কাছাকাছি কোনো বাসযোগ্য গ্রহেরও সন্ধান মেলেনি। তাই প্রয়োজন এই পৃথিবীটাকে দুঃখের নয় সুখের, ঘৃণার নয় ভালোবাসার, শত্রুতার নয় ভ্রাতৃত্বের এক স্বর্গতুল্য স্থানে পরিণত করা। 

যে মানুষ নক্ষত্রধূলির সন্তান, সে এক ধ্বংসোন্মাদ নোংরা ভিলেন না হোক। সে হোক প্রকৃতির বন্ধু ও স্বর্গের যোগ্য সন্তান। তার প্রথম জন্মভূমি এই পৃথিবীকে ও অন্য মানুষকে সে লুনাটিক হয়ে ভালোবাসুক, পাগলের মতো-একে পরিণত করুক মহাজগতের এক সুন্দরতম পরম প্রেমময় স্থানে। সবশেষে সূরা আল-ওয়াকিয়াহ থেকে এই কথাগুলো (৫৬: ৭৫-৭৬) আবৃত্তি করে ইতি টানছি, “আমি শপথ করছি নক্ষত্ররাজির অস্তাচলের-নিশ্চয় এটা এক মহাকাশপথ, যদি তোমরা জানতে।” 

সম্পাদক

বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫