
গাজী তানজিয়া। ছবি: সংগৃহীত
বাংলা সন গণনার মধ্যে মিশে আছে বাংলার বহুত্ববাদী সংস্কৃতির যৌথতা। সম্রাট আকবর সর্বভারতীয় একটি ক্যালেন্ডার ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ প্রবর্তনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। তবে সর্বভারতে এটি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলেও বাংলায় এখনো চালু থাকা ক্যালেন্ডারে সম্রাট আকবরের সর্বভারতীয় অসাম্প্রদায়িক ক্যালেন্ডার ‘তারিখ-ই-ইলাহী’র প্রভাব রয়ে গেছে।
ষোড়শ শতকের শেষ দিকে, মুসলমান চন্দ্র ক্যালেন্ডার হিজরির প্রথম সহস্রাব্দ যখন শেষ হচ্ছে, আকবর তখন ভারতের জন্য এমন এক দিনপঞ্জির পরিকল্পনা করেছিলেন, যেখানে ছিল বহু সংস্কৃতির মেলবন্ধনের ছাপ। জৈন বা পার্সিদের মতো তা সৌরমাসের হিসাবে চলার কথা হয়েছিল, যদিও তাতে মুসলমান হিজরির কিছু প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য ছিল।
১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দকে (আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সাল) শূন্য বৎসর ধরা হয়েছিল, যা ১৪৭৮ হিন্দু শকাব্দ এবং ৯৬৩ মুসলমান হিজরির সমান। বাংলা অব্দের সংস্কারের ক্ষেত্রে, সনের হিসাব দিয়েই সৌর মিশ্র গণনা পদ্ধতি অনুসারে নবী মুহাম্মদ (স.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের বিষয়টি স্মরণ করা হয়। হিসাবটা হলো, ৯৬৩ পর্যন্ত মুসলমান চান্দ্র অব্দ, তারপর থেকে হিন্দু সৌর অব্দ।
আকবরের প্রচুর আশা থাকলেও, দিল্লি বা আগ্রায় তারিখ-ই-ইলাহী প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি, তা কেবল চালু হয়েছিল আকবরের রাজসভায়। তবে তার সাম্রাজ্যের নবতম সংযোজন বাংলায় বেশ ভালোভাবেই গৃহীত হয় এই ক্যালেন্ডার। এটিতে আকবরের তারিখ-ই-ইলাহীর গভীর প্রভাবে পুরনো বাংলা অব্দের সংস্কার করা হয় যা আজও পাল্টায়নি। আকবরের পরে তারিখ-ই-ইলাহী আর টিকে না থাকলেও টিকে আছে বঙ্গাব্দ।
সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম আল্লামা আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী চান্দ্রবর্ষ আর সৌরবর্ষের সমন্বয়ে সেকালে সুবে বাংলার জন্য যে ফসলি সন তৈরি করেছিলেন তা মূলত ফসল ঘরে ওঠার সময়কে কেন্দ্র করে। শীতকালীন ফসল বোনার মৌসুম কার্তিক মাস আর ফসল তোলার মৌসুম হলো মাঘের শেষ থেকে চৈত্রের প্রথম অবধি। এই সময়টাকে জমিদার জোতদাররা খাজনা তোলার সময়কাল হিসেবেও নির্ধারণ করে নেন।
পৃথিবীর সব দেশেই আধিপত্যকারী শ্রেণির সংস্কৃতিই জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে পরিগণিত হয় এবং উৎসব-পাগল আমজনতা সেই মেওয়া লুফেও নেয়। তাছাড়া বাংলা ক্যালেন্ডারটি এখনো নানা হিন্দু অনুষ্ঠানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ড. অমর্ত্য সেনের মতে, ‘হিন্দু অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণের সময় ইসলামের নবীর সঙ্গে সন তারিখের যোগাযোগের বিষয়টা কোনো প্রতিবন্ধকতা কখনো তৈরি করেনি। এর পেছনে বিশেষ ভ‚মিকা রেখেছিল সম্রাট আকবরের উদার অসাম্প্রদায়িক নীতি।’
বাঙালি সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলমান যোগাযোগের ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করতেন ক্ষিতিমোহন সেন। তার মতে, ‘ধর্মীয় বহুত্বের স্বীকৃতি ছিল সাধারণভাবে মুঘলদের ঘোষিত নীতি। ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সম্রাট আকবরের হাত ধরে যার সূচনা। রোমের কম্পো দ্য ফিয়োরিতে জোর্দানো ব্রুনোকে যখন ধর্মদ্রোহের অপরাধে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, আকবর তখন আগ্রায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গুরুত্ব বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন।’
মুসলমান রাজারা বহু শতক ধরে বাংলা শাসন করেছেন, কিন্তু তারা কখনোই হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সুবিধাজনক অবস্থানটি নষ্ট করতে চাননি। ধর্মান্তরিত করার চেষ্টাও করেননি। মুঘল সেনাবাহিনীতে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের চমৎকার সব বর্ণনা পাওয়া যায়। দেখা যায় মুসলমান অধিকারিকেরা আল্লাহর নামে শপথ নিচ্ছেন আর হিন্দুরা বিষ্ণুর নামে। (রিচার্ড ইটন, হু আর দ্য বেঙ্গলি মুসলিম’স ইসলাম অ্যান্ড ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি। অক্সফোর্ড, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০০)। আর এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যে বাংলায় তারিখ-ই-ইলাহী প্রবর্তনের পথ সুগম করেছিল, তা বলাই বাহুল্য।
১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি উদ্ভাবক বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা বাংলা সনের ইতিহাসে এই নিপুণ মিশ্রণের কথা উল্লেখ করেন। যদিও এর চল্লিশ বছর পর স্যামুয়েল হিংটনের গবেষণা The clash of civilizations-এর পরে এই বিষয়ে আরও বিশদভাবে আলোচনা হয়। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এই বই গোটা বিশ্বের নজর কাড়ে। হান্টিংটনের মতানুসারে যারা সভ্যতার বিভাজনে বিশ্বাস রাখবেন, তাদের খুঁজে দেখতেই হবে, বাংলা সনকে তারা কোথায় রাখবেন-‘হিন্দু সভ্যতা’ না ‘মুসলমান সভ্যতা’ হান্টিংটন এই দুইয়ের ভিতর গভীর অনৈক্যের কথা বলেছেন।
কিন্তু সত্যটা হলো, বাংলার কৃষক ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যেমন বাংলা সন তারিখকে উপেক্ষা করতে পারবে না, তেমনি বাংলার হিন্দুও পূজা, পার্বণ, আচার, উপাচার পালনের ক্ষেত্রে বাংলা সনকে অপরিহার্য মেনে চলছে। এই উত্তরণকে কখনোই হান্টিংটনের সরল শ্রেণিকরণে বিচার করলে হবে না। বাঙালি কোনো ভুঁইফোড় জাতি নয়। বাঙালির আছে হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য। অথচ বাঙালি সংস্কৃতি বললে অনেকেই বলেন এটা হিন্দু সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতি কি শুধু হিন্দু সংস্কৃতি? বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে আর অন্য কোনো সংস্কৃতির মিল, সংশ্রব নেই?
আবহমান বাংলার কৃষ্টি বিভিন্ন বহিরাগত সংস্কৃতির মিশ্রণে তৈরি হয়ে এসেছে। বাঙালি কখনো মেনে নিয়েছে, কখনো বর্জন করেছে, আবার অনেক দিন ধরে চলতে চলতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সবকিছুই কাল ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যার ফলে শত শত বছর ধরে বাঙালি মুসলিম নামে একটা জাতির যেভাবে আবির্ভাব হয়েছে, তেমনই এখানে আছে হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ বাঙালি, এমনই আরও আছে অনেক জাত-ধর্মের বাঙালি।
গত পঞ্চাশ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালি জাতি এক নিজস্বতা তৈরিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতি বলতে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান; সবধর্মের সংমিশ্রণকেই বোঝায়। কারণ বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষের বাস। এরা মিলেমিশে বাংলাদেশের আলো-বাতাসে, প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। একথা পরিষ্কার যে মানুষের ধর্মোৎসবে, আচার-অনুষ্ঠানে, নামে- নিশানায়, আর্ট-কালচারে তার গণরূপ প্রতিফলিত হয়।
বাংলার প্রাচীনতম সব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে বাংলা সন তারিখ। তাই ধর্ম, বর্ণ, মত, ভেদ নির্বিশেষে বাংলা নববর্ষ আজও আমাদের একমাত্র সর্বজনীন উৎসব। এ প্রসঙ্গে আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন, ‘আমরা আনন্দোৎসবকে প্রার্থনা সভায় পরিণত করেছি আমাদের পতনের যুগে। দুর্দিন দীর্ঘস্থায়ী হলে মানুষ অদৃষ্টবাদী অতিরিক্ত ধার্মিক হইয়া পড়ে।’
তবে কি দীর্ঘ অগণতান্ত্রিক পরিবেশ, সম্পদের সীমাহীন বৈষম্য মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর করে তুলেছে! তাই আমাদের ভেতরে এত অসহনীয়তা, ভেদাভেদ! এর পেছনে যে রাজনৈতিক চাল নেই তাও তো নয়। তাই তো আজ আমরা ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও কোনো এক সর্বজনীন উৎসবেও নিজেকে লীন ভাবতে কুণ্ঠা বোধ করি। পরস্পরের প্রতি ঘৃণা বিদ্বেষ জাগিয়ে রেখে আজ আমরা নিঃস্ব হতে চলেছি।
যেখানে আমাদের উৎসব থাকবে না, থাকবে বেদনা, উল্লাস পরিণত হবে আর্তনাদে। অথচ বাংলার ইতিহাস মূলত ঐক্যের ইতিহাস। ধর্মীয় বিভাজন ও সংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার নয়। সেই বোঝাপড়াই যূথবদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে সম্ভব করেছিল, তার উত্তরণ ঘটিয়েছে, এবং তাকে দান করেছে বিশ্বের সঙ্গে নিজের মতো করে যুঝে নেওয়ার শক্তিও।
কথাসাহিত্যিক