Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ডিজিটাল আইন: এবার বাদীই গ্রেপ্তার

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:৩৮

ডিজিটাল আইন: এবার বাদীই গ্রেপ্তার

আমীন আল রশীদ। ছবি: সংগৃহীত

রংপুরে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার বাদী গ্রেপ্তার। খবরটি প্রথমত চাঞ্চল্যকর, দ্বিতীয়ত কৌতূহলোদ্দীপক। সম্ভবত এই প্রথম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার কোনো বাদীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল। যদিও সেটি অন্য মামলায়। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, গ্রেপ্তার জাকারিয়া আলম শিপলু রংপুর সিটি করপোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং তাজহাট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, যিনি যমুনা টেলিভিশনের ব্যুরো প্রধান সরকার মাজহারুল মান্নানসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছিলেন।

একটি প্রতিবেদন প্রচারের জন্য যমুনা টেলিভিশনের ব্যুরো প্রধান সরকার মাজহারুল মান্নানসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে তিনি ওই মামলা করেন। কিন্তু জমি দখলের একটি মামলায় উল্টো তাকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, শিপলু জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলার পলাতক আসামি। (ডেইলি স্টার অনলাইন, ৮ এপ্রিল ২০২৩)।

প্রশ্ন হলো, একজন পলাতক আসামি কী করে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করলেন? মামলা করার জন্য তাকে তো থানায় যেতে হয়েছে। আইনের চোখে পলাতক একজন আসামি থানায় গেলেন, মামলা করলেন, পুলিশ তখন কিছুই করল না? বরং যখন তাকে নিয়ে সংবাদ হলো যে, ডিজিটাল আইনে মামলার বাদী নিজেই একাধিক মামলার আসামি, তখন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করল। 

তবে শুধু শিপলু নন, সারা দেশে এ পর্যন্ত ডিজিটাল আইনে যত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে তার অধিকাংশ মামলার বাদী সরাসরি ওই সংবাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নন। বরং তারা আদিষ্ট হয়ে বা কোনো পক্ষকে খুশি করার জন্য মামলা করেছেন। অনুসন্ধানে হয়তো এও বেরিয়ে আসবে যে, ওই বাদীদের বিরাট অংশই কোনো না কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। 

ফলে এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত সবগুলো মামলার বাদীর রেকর্ড পরীক্ষা করার সময় এসেছে।  

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০২০ সালের জুন মাসে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর ফেসবুকে তাকে নিয়ে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছিল খোদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ, তাদের ফেসবুক স্ট্যাটাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, একজন নেতা সম্পর্কে মন্তব্য করায় বা স্ট্যাটাস দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানহানি হলো কী করে? এখানে শুধু মামলা করাই নয়; বরং ক্ষমতা দেখানো এবং কে কার পক্ষের, কোন দলের ও কোন নেতার কতটা ডেডিকেটেড কর্মী সেটি দেখানোরও একটা বিষয় কাজ করে। 

অস্বীকার করার উপায় নেই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ যাবৎ যেসব অভিযোগে মামলা হয়েছে, তার অধিকাংশই দুর্বল; কিন্তু এসব দুর্বল অভিযোগে পুলিশ কেন মামলা নেয় এবং অন্য যে কোনো আইনে দায়েরকৃত মামলার তুলনায় দ্রুততম সময়ে কেন আসামিকে গ্রেপ্তার করে, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

এটা ঠিক যে, বেরোবির শিক্ষক একজন প্রয়াত নেতার সম্পর্কে যা লিখেছিলেন, সেটি শালীনতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়। তার অর্থ এই নয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি বিতর্কিত আইনে মামলা করবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় মুক্তচিন্তা বিকাশের পাঠশালা। 

সম্প্রতি দেশের একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকের প্রকাশিত একটি ফটোকার্ড নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি যে ভাষায় ওই পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচার দাবি করেছে, সেটি বিস্ময়কর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সঙ্গে যদি রাজনৈতিক দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের কোনো তফাত না থাকে, তাহলে সেটি আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকে না। 

বলা হয়, যদি একজন ছাড়া সমগ্র মানবজাতিও কোনো একটি বিষয়ে একমত পোষণ করে, তাহলেও ওই ব্যক্তির কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেওয়া যাবে না। বরং তার বক্তব্যটিও শুনতে হবে। নাগরিক হিসেবে তারও ভিন্ন মত পোষণের অধিকার রয়েছে।আবার যে মতামতকে স্তব্ধ করে দেওয়া হলো, সেটি পুরোপুরি না হলেও অংশত সত্য হতে পারে এবং যদি তাকে মতামত প্রকাশের সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে মানবজাতি সেই আংশিক সত্য সম্পর্কে কোনোদিনই জানতে পারবে না। 

ফলে রাষ্ট্রের যেখানে উচিত নাগরিকের মতামত/ভাবনা/অনুভূতির স্বাধীন প্রকাশে আইনি সুরক্ষা দেওয়া। সেখানে রাষ্ট্র যখন নিজেই এমন সব আইন করে যা উল্টো নাগরিকের মনে ভীতি সঞ্চার করে; নিজের মত প্রকাশে সে ভয় পায় এবং আইনি মারপ্যাঁচে হয়রানির শিকার হতে পারে বলে তার মনে আতঙ্ক তৈরি হয়, তখন সেই রাষ্ট্রের পক্ষে বেশিদূর এগোনো কঠিন। হয়তো দারিদ্র্য বিমোচন, মাথাপিছু আয়, জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়নের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের সূচক খাড়া করা যায়, কিন্তু তাতে দেশের অগ্রগতি হয় না। সেই রাষ্ট্র নানাভাবে পিছিয়ে পড়ে। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫