
আমীন আল রশীদ।
পরপর বেশ কয়েকটি আগুনে পুড়েছে রাজধানীর একাধিক মার্কেট। এর মধ্যে গত ৪ এপ্রিল ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট, যার খুব কাছেই ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর, পুলিশ সদর দপ্তর এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগর ভবন। এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, বিশেষ করে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর সংলগ্ন হওয়ার পরও এই মার্কেটের একটি দোকানও কেন রক্ষা করা গেল না, সেই প্রশ্ন জনমনে রয়েছে।
বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের আহাজারি শেষ না হতেই ১৫ এপ্রিল আগুনে পুড়ে যায় রাজধানীর নিউমার্কেট সংলগ্ন নিউ সুপার মার্কেটের (দক্ষিণ) চার শতাধিক কাপড়ের দোকান। এর আগে নিউমার্কেটের কাছে আরেকটি মার্কেট এবং পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারের একটি ভবনে বিস্ফোরণে ২০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১১ এপ্রিল চকবাজারের সিরামিক গুদামে আগুন লাগে। এরপর পুরান ঢাকার নবাবপুর রোডে আগুন লেগে পুড়ে যায় ২০টির মতো গুদাম। এসব ঘটনায় অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, গ্যাস সিলিন্ডারের ত্রুটি কিংবা এসির বিস্ফোরণই দায়ী নাকি অন্য কিছু আছে?
এসব ঘটনার পেছনে নাশকতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লা আল-মামুনও বলেছেন, বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এসবের তদন্তে গোয়েন্দারা কাজ করছেন।
তবে এসব আগুন আসলেই নাশকতা কি না, সেটি সঠিক তদন্ত ছাড়া বের করা কঠিন। বরং একের পর এক মার্কেটে আগুনের দায় ব্যবসায়ীরা এড়াতে পারেন কি না এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির পরও ফায়ার সার্ভিসকে আগুন নেভাতে কেন বেগ পেতে হচ্ছে, সেই প্রশ্নটিও সামনে আনা উচিত।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার মাইন উদ্দিন বলেছেন, তারা প্রতিটি মার্কেটে যাচ্ছেন, মহড়া দিচ্ছেন, নোটিশ দিচ্ছেন, সতর্ক করছেন, কিন্তু তারপরও আগুন এড়ানো যাচ্ছে না। তার মানে কি ফায়ার সার্ভিসের কথাকে ব্যবসায়ীরা পাত্তা দিচ্ছেন না?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, ৪ বছর আগে বঙ্গবাজারকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করে সাইনবোর্ড টানানো হয়। তখন নতুন ভবন নির্মাণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মার্কেট সমিতি নতুন ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে এবং হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেন।
বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটে আগুনের পর গত ১৬ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে রাজধানী ঢাকার ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ সুপার মার্কেট ও শপিংমলের তালিকা প্রকাশ করে ফায়ার সার্ভিস। সেখানে ঢাকা মহানগর এলাকায় ৫৮টি মার্কেট ও শপিংমল পরিদর্শন করে ৯টিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ১৪টিকে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ও ৩৫টি মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়।
অতি ঝুঁকিপূণ মার্কেট ও শপিংমলগুলোর মধ্যে রয়েছে নিউমার্কেট এলাকার গাউছিয়া মার্কেট, ফুলবাড়িয়া এলাকায় বরিশাল প্লাজা মার্কেট, টিকাটুলী এলাকায় রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট, লালবাগ এলাকায় আলাউদ্দিন মার্কেট, চকবাজার এলাকায় শাকিল আনোয়ার টাওয়ার ও শহীদুল্লাহ মার্কেট এবং সদরঘাট এলাকায় শরীফ মার্কেট।
অস্বীকার করা যাবে না মার্কেটে অনেক ক্ষেত্রেই অগ্নিনিরাপত্তা আইন মানার ক্ষেত্রে চরম অবহেলা আছে। অধিকাংশ মার্কেটের লোকজনের মধ্যে প্রাথমিকভাবে আগুন নেভানোর ধারণা নেই, সেখানে অগ্নিনিরাপত্তা মহড়াও হয় না। ফলে যখন আগুন লাগে তখন ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আবার রাজধানীতে অব্যাহতভাবে খাল, পুকুর ও জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থানে পানির উৎসগুলো ভরাট করে ফেলায় আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসকে বেশ বেগ পেতে হয়।
উপরন্তু মার্কেটগুলোয় আগুন লাগছে মধ্য রাতে বা শেষ রাতে, যখন মার্কেটে কেউ থাকে না। সামান্য কিছু লোক থাকলেও তারা ঘুমে থাকেন। ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগে এটি কারও চোখেও পড়ে না। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আসতে আসতে আগুন অনেক দূর ছড়িয়ে যায় এবং বহু সম্পত্তি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
এর পাশাপাশি ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড না মানা; নকশাবহির্ভূতভাবে ভবন সম্প্রসারণ; অগ্নিনির্বাপণের আধুনিক সিস্টেম না থাকা; মার্কেটের দোকানে গাদাগাদি করে কার্টনে মালামাল রাখা; নিয়ম না মেনে মার্কেটের দোকানের ভেতর রাত্রিযাপন, ধূমপান ও গ্যাস ব্যবহার করে খাবার রান্না করাও কোনো না কোনোভাবে দায়ী বলে মনে করা হয়। ফলে এর দায় ব্যবসায়ী, দোকান মালিক এবং ভবন মালিকরা এড়াতে পারেন না।
ব্যবসায়ীরা এসব মার্কেটে কোটি কোটি টাকার মালামাল রাখেন, অনেকে ক্যাশেও লাখ লাখ টাকার বান্ডিল রেখে বাড়ি চলে যান। অথচ রাতের আঁধারে সেই মার্কেটে আগুন লেগে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও টাকার বান্ডিল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অথচ বৈদ্যুতিক লাইনের ত্রুটি যে ওই সম্পদকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে; গ্যাসের সিলিন্ডার ও এসির ত্রুটির কারণে যে পুরো একটি মার্কেট পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে, সেটি তাদের বিবেচনায় থাকে না।
সরকার বা সিটি করপোরেশনের উপর ভরসা না করে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে, সবাই কিছু কিছু টাকা দিয়ে যদি বিদ্যুতের লাইনগুলো আধুনিক ও নিরাপদ রাখতেন; মার্কেটে একটা হাইড্র্যান্ড সিস্টেম বা অগ্নিনির্বাপণের জন্য আধুনিক সিস্টেম গড়ে তুলতেন, তাহলে মার্কেট পুড়ে যাওয়ার পর তাদের নিঃস্ব হয়ে রাস্তায় বসতে হতো না। প্রশ্ন হলো, কেন তারা আগে থেকেই আগুনের ব্যাপারে সতর্ক হন না? কেন মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পরও সেখানে বছরের পর বছর ধরে ব্যবসা করতে থাকেন? সুতরাং এসব আগুনের দায় কি তারা নিজেরাও এড়াতে পারেন?
আসা যাক ফায়ার সার্ভিসের প্রসঙ্গে:
বলা হয়, ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বেড়েছে; আগুন নিয়ন্ত্রণে এমন সব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এখন বাংলাদেশে আছে যা প্রতিবেশী দেশসমূহেও নেই। এমনকি যেসব জায়গায় মানুষ পৌঁছতে পারে না বা যেখানে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে রোবট পাঠিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য রোবটও কিনেছে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে ওসব যন্ত্র এবং রোবট কি ব্যবহার করা হয়েছিল? ফায়ার সার্ভিসের এত সক্ষমতা বাড়ার পরও কেন মার্কেটের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেল? এসব যন্ত্রপাতি চালানোর মতো দক্ষ জনবল কি ফায়ার সার্ভিসের আছে?
বঙ্গবাজারের আগুনের সময় দেখা গেল পানির তীব্র সংকট। এই মার্কেট সংলগ্ন ওসমানী উদ্যানের পুকুরটি পানিশূন্য। তখন বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার অদূরে হাতিরঝিল থেকে পানি এনে তা উপর থেকে ফেলছে। অথচ বঙ্গবাজার মার্কেটটি ছিল টিন ও কাঠের কাঠামো। তার ভেতরে কাপড় ও তুলার মতো দাহ্য বস্তু। সুতরাং উপর থেকে যতই পানি দেওয়া হোক না কেন, তাতে আগুন নেভার কোনো কারণ ছিল না। বরং এসব ক্ষেত্রে পানি দিতে হয় সরাসরি বস্তুর উপর।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক (অপারেশন্স) শাকিল নেওয়াজও সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, উপর থেকে হেলিকপ্টারে পানি ছিটিয়ে এরকম নেভানোর চেষ্টা করা অনর্থক। কারণ টিন ও কাঠের কাঠামোর ওপর যখন উপর থেকে হেলিকপ্টারের বাকেট থেকে পানি ফেলা হয়, সেটি নিচে পড়তে পড়তে অনেক শক্তিশালী হয় এবং ওই পানির ভারেই দুর্বল অবকাঠামো ধসে পড়ে। অর্থাৎ আগুন নেভানোর বদলে এই উদ্যোগ হিতে বিপরীত হয়। তাছাড়া এরকম লেলিহান আগুনের ওপরে হেলিকপ্টারের বাকেট থেকে পানি ফেলা হলে সেটি আগুনের গায়ে লাগতে লাগতেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তাছাড়া হেলিকপ্টারের পাখার বাতাস ওই আগুন আরও ছড়িয়ে দেয়।
একটি মার্কেটে বা শপিংমলে কিংবা আবাসিক ভবন অথবা বস্তিতে আগুন লাগলেই সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর নড়েচড়ে বসে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা সেখানে নাশকতার গন্ধ পান। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি চলে। কিন্তু ভবনগুলো নির্মাণের শুরু থেকে প্রতিটি ধাপে যে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, ত্রুটি, সেসব নিয়ে আলোচনা কম হয়। বলা হয়, এসব আগুন মূলত বছরের পর বছর ধরে মেনে নেওয়া অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা আর মানুষের লোভেরই বিস্ফোরণ। সুতরাং সেই অনিয়ম অব্যবস্থাপনা দূর করতে না পারলে এবং লোভের রাস টেনে ধরতে না পারলে আজ বঙ্গবাজার, কাল নিউ সুপার মার্কেট তো পরশু গাউছিয়া। এভাবেই চলতে থাকবে।