
আমীন আল রশীদ।
প্রতিষ্ঠার মাত্র ৯ বছরের মাথায় সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক পাওয়া নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। কিন্তু সেই বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে নিয়ে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব বিতর্ক হলো, সেটি অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
বিদ্যানন্দ কী ও কেন?
বাংলাদেশের রাজনীতির উত্তাল সময় ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করলেও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন মূলত আলোচনায় আসে করোনাকালে। ওই দুঃসময়ে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো; করোনা রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা সেবা দেওয়া; নিজেদের গার্মেন্টস থেকে পিপিই তৈরি ও বিনামূল্যে সারা দেশে বিতরণ; কুড়িগ্রামে এক টাকায় ভাত-ডাল, মাছ-মাংসের রেস্তোরাঁ চালু; ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক কড়াইয়ে একসঙ্গে ৪ হাজার মানুষের রান্না করার মেগা কিচেন; উপকূলীয় এলাকা ও চরাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ভাসমান হাসপাতাল চালুসহ নানাবিধ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রশংসিত হয় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
কিন্তু তারপরও মানুষের অবিশ্বাস কেন?
সম্প্রতি রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুনের পর ফেসবুকে প্রকাশিত একটি কোলাজ ছবি ঘিরে বিদ্যানন্দকে নিয়ে সমালোচনা শুরু। এর সূত্র ধরে বিদ্যানন্দের অন্যান্য কাজ এবং প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা নিয়ে ফেসবুকে অনেকে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। বিশেষ করে বিদ্যানন্দ পাহাড়ি এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনেছে উল্লেখ করে সেসব জমিতে কী হচ্ছে, তা নিয়েও ফেসবুকে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
এরই মধ্যে ফেসবুক লাইভে এসে এসব প্রশ্নের কিছু জবাব দিয়েছেন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাস। তিনিও মনে করেন, যারা বিদ্যানন্দকে নিয়ে সমালোচনা করছেন, তারা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই তা করছেন। তবে বিদ্যানন্দের কাজকর্মে কেউ স্বচ্ছতা না পেলে বা প্রতিষ্ঠানটি অনৈতিক কাজ করছে, এমন মনে করলে যে কেউ বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন বলেও কিশোর কুমার উল্লেখ করেন। (প্রথম আলো, ১৭ এপ্রিল ২০২৩)।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই, সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি বিভক্ত হয়ে গেছে। এখন অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কিংবা নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ে কেউ একজন ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিলে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। একটি পক্ষ ধরেই নেয়, এই স্ট্যাটাসটি উন্নয়ন ও সরকারবিরোধী চক্রান্তের অংশ। আরেকটি পক্ষ ধরে নেয়, যেহেতু সরকার বা সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত বা ঘনিষ্ঠ লোকেরা এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, অতএব এর পক্ষেই থাকতে হবে। বিদ্যানন্দের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।
যে কারণে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে বিদ্যানন্দের তরফে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তাতে অনেকেই সন্তুষ্ট। তারা বিদ্যানন্দকে সমর্থন জানানো, তথা তাদের পাশে থাকার জন্য বিকাশে অর্থ সহায়তাও পাঠাচ্ছেন। কেউ কেউ সেই অর্থ সহায়তার প্রমাণস্বরূপ মোবাইল ফোনে আসা এসএমএসের স্ক্রিনশটও ফেসবুকে শেয়ার করছেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় আরেকটি পক্ষ সন্তুষ্ট নন। বরং তারা নতুন করে আরও কিছু প্রশ্ন তুলেছেন।
গণমাধ্যম কী করছে?
বিদ্যানন্দ এখনো বিশ্বাস ও সন্দেহের মাঝামাঝি আছে। এই দ্বিধা ও বিভ্রান্তি দূর করতে মুখ্য ভ‚মিকা পালন করতে পারে গণমাধ্যম। যেহেতু একটি পক্ষ মনে করছে বা বিশ্বাস করছে যে, প্রতিষ্ঠানটি মানুষের সেবায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছে এবং এর প্রধান ব্যক্তি হিন্দু হওয়ায় তাকে সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে আক্রমণ করা হচ্ছে; পক্ষান্তরে আরেক পক্ষ বলছে যে, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বা বিশেষ কারও স্বার্থ রক্ষায় বিদ্যানন্দ কাজ করছে এবং তাদেরকে মানুষ যেসব দান করেছে, সেসব অর্থ খরচের স্বচ্ছতা নেই।
সে ক্ষেত্রে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার কাজটি করতে পারে গণমাধ্যম। অর্থাৎ মানুষের বিভ্রান্তি বা ধোঁয়াশা দূর করতে গণমাধ্যম অনুসন্ধান করে দেখতে পারে যে, বিদ্যানন্দ আসলে কী করছে? যেমন তারা পাহাড়ে ও অন্যান্য জায়গায় যেসব জমি পেয়েছে বা কিনেছে, সেসব জমির মালিক ও প্রতিবেশীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে কিছু রিপোর্ট করতে পারে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখতে পারে সেখানে কী আছে? সেখানে কোনো প্রতিষ্ঠান থাকলে সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম তুলে ধরতে পারে। তাছাড়া বিদ্যানন্দের ওয়েবসাইটে তাদের যে অডিট রিপোর্ট দেওয়া আছে, সেগুলো পর্যালোচনা করেও কিছু রিপোর্ট হতে পারে। কিন্তু মুশকিল হলো, এরই মধ্যে একটা পারসেপশন তৈরি হয়ে গেছে যে, বিদ্যানন্দের বিপক্ষে বললে বা তাদের নিয়ে প্রশ্ন তুললে সেটি ‘সরকারবিরোধিতা’ হবে। সম্ভবত সে কারণে সাংবাদিকরা বিদ্যানন্দের কার্যক্রম নিয়ে অনুসন্ধানে আগ্রহী নন। আবার এমনও হতে পারে যে, কেউ কেউ সত্যিই অনুসন্ধান করছেন এবং হয়তো ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কিছু রিপোর্ট দেখা যাবে।
সমস্যা কি পিনাকি ভট্টাচার্য?
যারা বিদ্যানন্দের পক্ষে, তারা মনে করেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারের কড়া সমালোচক ও বিতর্কিত ইউটিউবার পিনাকি ভট্টাচার্য যেহেতু বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে বিতর্ক উসকে দিয়েছেন, অতএব এটি তার সরকারবিরোধী রাজনীতির অংশ; সুতরাং বিদ্যানন্দের পক্ষেই দাঁড়াতে হবে। তারা বিদ্যানন্দ সম্পর্কিত যাবতীয় প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়ে বরং এটিকে সরকারবিরোধী চক্রান্ত হিসেবে দেখতেই পছন্দ করছেন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, পিনাকি ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা অবস্থান ও উদ্দেশ্যই যা-ই হোক না কেন, বিদ্যানন্দ সম্পর্কে তিনি যেসব প্রশ্নের অবতারণা করেছেন, সেই প্রশ্ন অন্য কেউও তুলতে পারতেন। যেহেতু বিদ্যানন্দ মানুষের দানের টাকায় পরিচালিত হয়; যেহেতু একজন-দুজন নয় বরং তারা হাজার হাজার মানুষের খাদ্য ও শিক্ষার ব্যবস্থা করছে এবং ওই টাকা যেহেতু সাধারণ মানুষ তাদের কষ্টার্জিত আয় থেকে বিদ্যানন্দকে দানকৃত; আবার তারা বিদেশি অনুদানও নিয়েছে, সুতরাং প্রশ্নটি পিনাকি ভট্টাচার্য তুললেন নাকি রাম শ্যাম যদু মধু, সেটি বড় কথা নয়।
যে কেউ এই প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, মানুষের দানের অর্থ বিদ্যানন্দ সঠিক পথে খরচ করছে কি না? এই সন্দেহ জাগা অমূলক নয়। অপরাধ নয়। এই প্রশ্ন করলেই তাকে সরকারবিরোধী বা বিএনপি-জামায়াত ভাবা উচিত নয়। সমালোচক মানেই বিদ্যানন্দের শত্রু নন। যেমন কিশোর কুমার নিজেও ফেসবুক লাইভে বলেছেন যে, তিনি মনে করেন যারা বিদ্যানন্দকে নিয়ে সমালোচনা করছেন, তারা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই তা করছেন। সুতরাং বিদ্যানন্দের সমালোচনা মানেই সরকারবিরোধী চক্রান্ত নয়।
যেহেতু এই সংগঠনকে ভালোবেসে অসংখ্য মানুষ নগদ অর্থ এমনকি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার জন্য বিপুল পরিমাণ জমি দান করেছেন, সেই মানুষগুলো এই প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে, তাদের দানকৃত জমিতে আসলে কী হয়েছে? তারা যেসব শিশুর পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছেন, সেই শিশুরা আসলেই পড়ছে কি না। অর্থাৎ তাদের দানের পয়সা সঠিক পথে খরচ হচ্ছে কি না। যে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তুললেই সেখানে ষড়যন্ত্র বা চক্রান্তের গন্ধ খোঁজাটা এখন একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। প্রশ্নটি কে বা কারা উত্থাপন করলেন, তার চেয়ে বড় কথা, প্রশ্নটি কী এবং যাদের উদ্দেশে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে, তারা সঠিকভাবে এর জবাব দিতে পারছেন কি না।
একুশে পদক ও জাকাত-বিতর্ক
বলা হচ্ছে, বিদ্যানন্দ একুশে পদক পাওয়ার পরই তার পেছনে একটি পক্ষ লেগেছে বা তাদের সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে। এটিও অস্বাভাবিক নয়। কারণ একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেলে মানুষের মনে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, তিনি বা তারা কী কারণে পুরস্কারটি পেলেন? সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার অবদান কী? যেমন স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, কোনো কোনো লেখককে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার পর তার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
বলা হচ্ছে বিদ্যানন্দকে জাকাতের অর্থ দান করার কারণে একটি পক্ষ তাদের পেছনে লেগেছে। এটিও অস্বাভাবিক নয়। কারণ জাকাত একটি ধর্মীয় বিধান। সুতরাং ধর্মীয় কোনো গোষ্ঠী যদি মনে করে যে, বিদ্যানন্দকে জাকাতের অর্থ দিলে সেটি তাদের স্বার্থে আঘাত হানছে, তাহলে সে বিদ্যানন্দের পেছনে লাগবে। কথা হচ্ছে, সেই পেছনে লাগাটাকে বিদ্যানন্দ কীভাবে মোকাবিলা করছে এবং উত্থাপিত প্রশ্নসমূহের জবাব তারা ঠিকমতো দিতে পারছে কি না?
কেউই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন
যারা রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে যারা মানুষের দানের অর্থে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সেবা করেন, এরকম কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখার সুযোগ নেই। সেটি হোক বিদ্যানন্দ, মাস্তুল ফাউন্ডেশন, আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি, তাদের যে কোনো কর্মকাণ্ড নিয়ে মানুষ প্রশ্ন তুলতে পারে। সন্দেহ করতে পারে। তাদের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে এই প্রশ্ন ও সন্দেহই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
তারা যখন এটি বুঝতে পারবে যে, মানুষ তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করছে, তখন তারা প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্ক থাকবে। অর্থাৎ মানুষের দানের টাকায় পরিচালিত সংগঠনগুলো কী করছে না করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে এবং এই প্রশ্ন উত্থাপনের পেছনে যদি কারও কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেও থাকে, তারপরও সকল প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার মতো সৎ সাহস সকল প্রতিষ্ঠানের থাকতে হবে।
পরিশেষে সবখানে ষড়যন্ত্র বা চক্রান্তের ভূত খোঁজা কিংবা সবকিছুর সঙ্গে রাজনীতিকে টেনে আনা এখন যে একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অসুখে পরিণত হয়েছে, সেই অসুখেরই বরং চিকিৎসা প্রয়োজন।