
মুহাম্মদ তানিম নওশাদ। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ মনে হয় একটি বিপজ্জনক প্রান্তে চলে গিয়েছে। যুদ্ধে দুই পক্ষই কোনো ছাড় দিতে রাজি হচ্ছে না। অনেকের মতে পৃথিবীতে তৃতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে এবং যুদ্ধের প্রথম ভাগ দুনিয়া অতিক্রম করেছে। কিন্তু রুশ ও মার্কিন জোটের কোনো পক্ষই পৃথিবীর জন্য ভয়াবহ পরিণাম দানকারী এই যুদ্ধে নমনীয়তা প্রদর্শন করছে না।
২৬ মার্চ, ২০২৩-এ ভ্লাদিমির পুতিন বেলারুশে স্বল্পমাত্রার ধ্বংসাত্মক শক্তিসম্পন্ন পারমাণবিক অস্ত্রের বা ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার উইপনের ঘাঁটি স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। জুলাইতে সে কাজ পুরোদমে শুরু হবে বলেও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন।
ইতোমধ্যে পুতিনের ঘনিষ্ঠ বেলারুশ প্রজাতন্ত্র ও তার কর্ণধার আলেকসান্দর লুকাশেঙ্কো তা অনুমোদনও করেছেন। বলাবাহুল্য প্রচলিত যুদ্ধ (কনভেনশনাল ওয়ার) রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদে করতে না পারলে, স্বল্প মাত্রার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে সে এই যুদ্ধের ইতি টানতে চাইবে। এই যুদ্ধের প্রারম্ভে বেলারুশ তার ভূমি ব্যবহার করতে দেওয়ার কারণেই রুশ সামরিক বহর ইউক্রেন আক্রমণ করতে সক্ষম হয়। এছাড়া ইউরোপের স্লাভিক রাষ্ট্রগুলোর অনেকেই পুতিনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
ইতোমধ্যে ইস্কান্দার নামক স্বল্প পাল্লার মিসাইল সিস্টেম রাশিয়া থেকে বেলারুশ প্রজাতন্ত্রে প্রেরণ করা হয়েছে। এর সঙ্গে প্রচলিত ও পারমাণবিক (নিউক্লিয়ার) উভয় ধরনের ওয়ারহেড জুড়ে দেওয়া যায়। এছাড়া পুতিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, রাশিয়া বেলারুশের দশটি এয়ারক্র্যাফটকে ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বহনে সক্ষম করে তুলেছে।
আর যুদ্ধের প্রথম দিকেই পুতিন একবার বলেছেন যে, রাশিয়া না থাকলে পৃথিবীর আর থাকার দরকার নাই। ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্র পেশকভও বলেছিলেন যে, রাশিয়া শুধু দেখানোর জন্য পারমাণবিক অস্ত্রগুলো বানায়নি। রাশিয়া নিজেকে বিপন্ন মনে করলে, সে সেগুলো ব্যবহার করতে কার্পণ্য করবে না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মনে করে, পরাক্রমশালী রাশিয়া যত দিন অখণ্ড থাকবে, পশ্চিমা দুনিয়ার জন্য বিপদও তত দিন থাকবে। ফলে ইউক্রেনে তারা অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকবেই। তাহলে পৃথিবী কি একটি পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে?
দুই
আমরা দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ পারমাণবিক যুদ্ধে পরিণত হবে কিনা-সেই আশঙ্কা বিশ্লেষণ করব। প্রথমটি ১৯৪৫ সালে সংঘটিত জাপানের ঘটনা। ৬ আগস্ট হিরোশিমাতে ও ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে আমেরিকা যথাক্রমে লিটল বয় নামক একটি ইউরেনিয়াম বোমা ও ফ্যাটম্যান নামক একটি প্লুটোনিয়াম বোমা ফেলে। তাতে শহর দুটি প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আধিপত্য প্রমাণ করতে পেরেছে, কারণ জাপানের কাছে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না। আর এখন পর্যন্ত দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় ঘটনায়, কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসে। ১৯৬২ সালে কিউবাতে যে মিসাইল সংকট (কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস) দেখা দিয়েছিল, তাতে বিশ্ব একটি পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল। ঘটনাটি অনেকের জানা যে, কিউবার অবিসংবাদিত কমিউনিস্ট নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্নিকটে থাকার জন্য নিজেকে ও তার দেশকে নিরাপদ ভাবতেন না। আর তাই তিনি ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে এসএ-২ অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট মিসাইল চেয়েছিলেন।
তদানীন্তন সোভিয়েত প্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভ নানা ধরনের ও বিবিধ ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাসম্পন্ন বেশ কিছু মিসাইল ফ্লোরিডা উপকূল বরাবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ১৪০ কিলোমিটারের মধ্যে স্থাপন করে। এর ফলে পৃথিবী একটি পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। ৩৫ দিন এই উত্তেজনা বিরাজিত ছিল। তারপর রাশিয়া মিসাইল অপসারণ করলে এই বিপদ থেকে পৃথিবী রক্ষা পায়।
অনেকে এই সংকটকে ‘জিরো-সাম ম্যাট্রিক্স’ বা গেম থিউরি দিয়ে বুঝতে চান। এই মডেলে দুপক্ষের একজন জয়ী হবে, আরেকজন পরাজিত হবে। তবে তৃতীয় ধারার অবকাশ আছে, যেখানে উভয়ই বিজয়ী হতে পারেন। অবশ্য আমার মতে উভয় পক্ষই পরাজিত হতে পারেন-বাস্তবে এই সম্ভাবনাও থাকতে পারে। কিউবার মিসাইল সংকটের পর বিশেষজ্ঞগণ তিন রকম মত দিয়েছিলেন।
কেউ বলেছেন যে, এতে দুপক্ষই বিজয়ী হয়েছে। কারণ রাশিয়া প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, সে প্রয়োজনে আমেরিকার সীমান্ত বরাবর পৌঁছতে পারে, তার লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। আবার আমেরিকা রাশিয়াকে মিসাইল অপসারণে বাধ্য করতে চেয়েছিল। তা সে পেরেছে। অন্যদিকে কেউ বলেছেন যে, এই সংকটে রাশিয়া বিজয়ী হয়েছে।
কারণ রাশিয়া যে কোনো জায়গা থেকে মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে বিভীষিকাময় হতে পারে, তাই সে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। তারা তা পেরেছে। অন্যদিকে যারা মনে করেন এই সংকটে আমেরিকা বিজয়ী হয়েছে, তাদের ব্যাখ্যা হচ্ছে: রাশিয়ার আরও কোনো উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু আমেরিকার কূটনৈতিক চাল ও সামরিক সক্ষমতার প্রপাগান্ডা রুশদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। ফলে আমেরিকা বিজয়ী হয়েছে।
তিন
ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতা ভিন্ন। এই যুদ্ধে আমেরিকার প্রতিপক্ষ রাশিয়া, জাপান নয়। রাশিয়ার হাতে প্রচুর পরিমাণে প্রবল ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। রাশিয়ার অস্ত্রভাণ্ডারে মজুদ পারমাণবিক অস্ত্রের পরিমাণও আমেরিকার চেয়ে বেশি। অন্যদিকে কিউবার মিসাইল সংকটে রাশিয়ার পিছু হটার পথ ছিল। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পিছু হটার পথ নেই।
ন্যাটোর ক্রমবর্ধমান অস্তিত্ব ও ইউক্রেনকে ন্যাটোর প্রতি নিয়ত অস্ত্র সরবরাহের কারণে রাশিয়ার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বাস্তবতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর পশ্চিমও ভ্লাদিমির পুতিনকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে যুদ্ধ থেকে সরে আসার পথ রাখেনি। তিনি ও তার পারিষদবর্গের প্রায় সবার উপর আমেরিকা ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিকসহ যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। খোদ রাশিয়ার উপর দেওয়া হয়েছে অগুনতি নিষেধাজ্ঞা।
ফলে রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদে প্রচলিত যুদ্ধ চালাতে না পারলে সে ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার উইপন ব্যবহার করতে পারে। ইতোমধ্যে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত ইউক্রেন তখন পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। এতে পশ্চিম আরও অগ্রসর হলে একটি পুরোদস্তুর পারমাণবিক যুদ্ধ দানা বাঁধতে পারে। ফলে পশ্চিমের উচিত রুশদেশকে আন্তর্জাতিক দর কষাকষিতে স্থান দেওয়া। আর তা করা উচিত একটি আসন্ন পারমাণবিক যুদ্ধকে প্রতিহত করতেই।
গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক