Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

‘হিট অফিসার’ কীভাবে ঢাকার তাপ কমাবেন

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৩, ১১:৫৪

‘হিট অফিসার’ কীভাবে ঢাকার তাপ কমাবেন

আমীন আল রশীদ। ফাইল ছবি

সড়কদ্বীপের উন্নয়নের নামে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত ধানমন্ডি এলাকার সাত মসজিদ এলাকায় নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন নিয়ে যখন সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম; যখন পরিবেশবাদীরা এর তীব্র সমালোচনা করছেন, ঠিক সেই সময়ে জানা গেলো, উত্তর সিটি করপোরেশনে ‘চিফ হিট অফিসার’ নামে একটি পদে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্বয়ং উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়েকে, যিনি ঢাকার তাপমাত্রা কমাতে কাজ করবেন।

এ সময় মেয়র নিজেও জানিয়েছেন যে, উত্তর সিটির বিভিন্ন এলাকায় তারা পাঁচ লাখ গাছ লাগাতে চান। গাছগুলো যাতে যত্নে বেড়ে ওঠে, সেজন্য তিনি নাগরিকদেরও সহায়তা চেয়েছেন। 

এখানে ঘটনা তিনটি। ১. উন্নয়নের নামে দক্ষিণ সিটিতে বৃক্ষনিধন; ২. উত্তর সিটিতে ৫ লাখ গাছ লাগানোর উদ্যোগ এবং ৩. চিফ হিট অফিসার পদে স্বয়ং মেয়রকন্যার নিয়োগ।

বলা হচ্ছে, ঢাকা এশিয়ার প্রথম শহর, যেখানে একজন চিফ হিট অফিসার (সিএইচও) নিয়োগ দেয়া হলো, যিনি তাপমাত্রা কমাতে শহরব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন। বিশেষ করে জনগণের মধ্যে তাপ সচেতনতা বৃদ্ধি, সুরক্ষা প্রচেষ্টা ত্বরান্বিতকরণসহ নতুন নতুন কাজে নেতৃত্ব দেবেন।

কিন্তু মেয়রকন্যার নিয়োগ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা বেশি হচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, তিনি নারী বলে ট্রলের শিকার হচ্ছেন। আসলে কি তা-ই? 

অস্বীকার করা যাবে না, এই পদে অন্য কোনো নারী, অর্থাৎ তিনি যদি মেয়রকন্যা না হয়ে অন্য কেউ হতেন, তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সমালোচনা হতো না। অর্থাৎ বুশরা আফরিন নিজের যোগ্যতায় এই পদে নিয়োগ পেলেও মানুষের মনে এই ধারণা সৃষ্টি অস্বাভাবিক নয় যে, এই নিয়োগের পেছনে হয়তো মেয়রের প্রভাব রয়েছে।

কেননা বুশরাকে যারা নিয়োগ দিয়েছেন তার মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশন অন্যতম এবং তার পিতা এখানকার মেয়র। এটিকে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের সংঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ বুশরার নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে তার বাবার ভূমিকা যেমন থাকতে পারে, তেমনি কাজ করার সময় পিতার কাছ থেকে তিনি বাড়তি সুবিধা পেতে পারেন।

যদিও উত্তর সিটি করপোরেশনের তরফে বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশন তাকে নিয়োগ দেয়নি। তাকে নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন এবং সিটি করপোরেশন থেকে তিনি বেতন বা অন্য কোনো সুবিধা পাবেন না। (ডেইলি স্টার অনলাইন, ৪ মে ২০২৩)। 

তবে বুশরা আফরিনের পৈত্রিক ও লৈঙ্গিক পরিচয় যাই হোক না কেন, তাকে নিয়ে কোনো ধরনের অশোভন মন্তব্য করা সমীচীন নয়। বরং যে প্রশ্নটি করা যেতে পারে তা হলো, যে পদের জন্য তিনি নিয়োগ পেয়েছেন, সেই প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ছিল কি না। মেয়রের কোনো প্রভাব ছিল কি না।

দ্বিতীয়ত এটি পুরোপুরি পরিবেশবিজ্ঞানের ইস্যু। তিনি কি এই বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন বা এই বিষয়ে তার কি কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে? যে কাজের জন্য তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন, সেই কাজটি তিনি যদি সত্যি সত্যি সফলভাবে করতে পারেন, তখন হয়তো সমালোচনা কমে আসবে। তৃতীয়ত যে কাজের জন্য তাকে নিয়োগ দেয়া হলো, অর্থাৎ নগরীর তাপমাত্রা কমাতে ভূমিকা রাখা, সেই পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো?

ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বছরের পর বছর ধরে যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে, সেখানে সিটি করপোরেশনের কি কোনো দায় নেই? ঢাকার দুই অংশের মধ্যে উত্তর সিটিতে বিলাশবহুল আধুনিক ঝা চকচকে বহুতল ভবনের সংখ্যা বেশি। যে ভবনগুলোর বিরাট অংশই নির্মিত হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল ও কাঁচ দিয়ে। একটি বহুতল ভবনে ব্যবহৃত কাঁচ কী পরিমাণ তাপ শুষে নেয় এবং ছাড়ে এবং নগরীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সেটি কী ভ‚মিকা রাখে, সেই হিসাব সিটি করপোরেশনের কাছে রয়েছে?

চিফ হিট অফিসার

গবেষকরাও বলেন, ঢাকার বিল্ডিংগুলো জলবায়ু সংবেদনশীল নয়, এগুলো দিনের বেলা সূর্য থেকে প্রাপ্ত আলো ট্রাপ করে। ফলে রাতে যে হারে ঠান্ডা হওয়ার কথা, তা না হয়ে উল্টোটা হয়। অর্থাৎ বিল্ডিংগুলো তাপ ধরে রাখে। আর এই উদ্বৃত্ত তাপ আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে স্থানীয় জলবায়ুকে উত্তপ্ত করছে। (আশরাফ দেওয়ান, প্রথম আলো, ১১ জানুয়ারি ২০২১)। 

ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধির আরেকটি কারণ এসি। গরম যত বাড়ে, এসির ব্যবহার তত বাড়ে। এসির ব্যবহার যত বাড়ে, এসি থেকে তত বেশি তাপ বাইরে আসে। অর্থাৎ ঘরের গরম বাতাস এসির মধ্য দিয়ে বাইরে চলে আসে। ঘরের ভেতর ঠান্ডা হয়। কিন্তু আরও বেশি উত্তপ্ত হয় বাইরের দুনিয়া। এটি একটি সাংঘর্ষিক ব্যাপার। ফলে এসি কোনো সমাধান নয়। সমাধান গাছ। সমাধান প্রকৃতি সংরক্ষণ।  

প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে এরকম কাঁচের ভবন নির্মাণের অনুমোদন কারা দেয়? ইউরোপ-আমেরিকার মতো শীতপ্রধান দেশের আইডিয়া, নকশা ও ম্যাটেরিয়াল দিয়ে বাংলাদেশে ভবন বানালে সেটি এই দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর সঙ্গে মিলবে? এই বোধটুকু আমাদের স্থপতি, প্রকৌশলী, ভবন মালিক ও নীতিনির্ধারকদের কেন নেই? 

দেখতে সুন্দর হবে; দিনের বেলায় বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবহার কমানে যাবে, শুধু এই যুক্তিতে বিশাল বিশাল ভবন বানানো হয়েছে কাঁচ দিয়ে। অথচ গরমের মৌসুম এই কাঁচের ভবনগুলো কী পরিমাণ তাপ বিকিরণ ঘটায়, সেই অংকটি কি করা হয়েছে? না করে এখন করপোরেশন বলছে লাখ লাখ গাছ লাগানো হবে।

আজ যে গাছ লাগানো হবে, সেই গাছ বড় হয়ে ছায়া দেয়ার উপযোগী হতে ১০-১৫ বছর লাগবে। ততদিনে এই শহরের তাপমাত্রা আরও কী পরিমাণ বাড়বে? ততদিন মানুষকে ছায়া ও বৃষ্টি কে দেবে? গাছ না থাকলে সেখানে বৃষ্টিও কমে যায়। একটি শহরে যেখানে মোট ভূমির ২৫ শতাংশ গাছ থাকতে হয়, রাজধানী ঢাকায় আছে ৮ শতাংশেরও কম (অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান, নগর পরিকল্পনাবিদ)। এরকম বাস্তবতার মধ্যেই দক্ষিণ সিটির সাতমসজিদ রোডের সড়কদ্বীপের সৌন্দর্য বাড়ানোর অজুহাতে অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

যে গাছগুলো বহু বছর ধরে এই এলাকার মানুষকে ছায়া ও অক্সিজেন দিয়ে আসছিল। যে যুক্তিতে এই গাছ কেটে ফেলা হয়েছে তা হলো, গাছগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এখন এই সড়কদ্বীপে লাগানো হবে বাগানবিলাসের মতো হাল্কা গাছ।

শোনা যাচ্ছে, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে বিদেশি অর্থায়নে। তার মানে এখানে নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি কিংবা সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়ানো উদ্দেশ্য নয়, বরং উদ্দেশ্য হলো প্রকল্প বাস্তবায়ন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ যে একটি প্রকল্পশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, সাতমসজিদ এলাকার গাছগুলো সেই প্রকল্পেরই নিরীহ ভিকটিম।

উত্তর সিটির নিকেতন এলাকায় ডা. ফজলে রাব্বি পার্ক দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ। কারণ পার্কের উন্নয়নের কাজ চলছে। কী উন্নয়ন হচ্ছে? পার্কের সীমানা ছোট করে কাঁচের দেয়াল দেয়া হয়েছে। ভেতরের অনেক গাছও কাটা হয়েছে। প্রশস্ত ওয়াকওয়ে বানানো হচ্ছে। কাঁচের দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করা এরকম অদ্ভুত পার্ক পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ।

পার্কের বাতাস বাইরে যাবে না। বাইরের বাতাসও পার্কে ঢুকবে না। বরং গরমের দিনে এই কাঁচের তাপে পার্কে হাঁটাই কঠিন হবে। কিছুটা দূর থেকে দেখলে পার্কটিকে ‘গ্রিন হাউজ’ মনে হবে। অর্থাৎ স্বয়ং সিটি করপোরেশনই এখানে তাপমাত্রা বাড়ানোর আয়োজন করেছে এবং মেয়রের কন্যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাপ কমানোর!

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫