
আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি
সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা নিয়ে আমরা এত মাতোয়ারা যে ভুলেই গেছি বা কোনো আলোচনাই হয় না তার লেখালেখি নিয়ে। তিনি লিখতেন প্রফেশনালি, মানে রুজির জন্য। অনেক বই লিখছেন যেগুলো খুব ভালো চলত-এর মধ্যে ফেলুদা সিরিজ অন্যতম। তবে বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দাদের ধারাবাহিকতা আছে। এমনকি রবিন হুড টাইপের চরিত্রেরও ছড়াছড়ি। দস্যু মোহন যেমন একটি চরিত্র। বেড়ে ওঠার বয়সে আমরা সবাই পড়েছি ৫০, ৬০ দশকে। আরও দস্যু ছিল, এমনকি বাংলাদেশে ছিল দস্যু বাহরাম।
অতএব এই ঘরানাটা ছিল কিন্তু ৭০, ৮০ দশকের পাঠকের জন্য। এরপর এলো ফেলুদা। বেচারা মাসুদ রানা এত কিছু করেও ঠেলে সরাতে পারল না তাকে। সত্যজিৎ বাঙালির মন বুঝতেন। আর বুঝতেন ইউরোপীয় সমঝদার ভাবনা। ব্রাহ্ম সমাজের উৎপত্তিস্থল এখানেই। তিনি তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভূ। তবে ফিল্ম তো ফিল্ম, বাঙালি ছবিয়ালকে দুনিয়ার সামনে উপস্থিত করেছেন তিনি।
দুই
এত সব কথা বলার কারণ হচ্ছে ফেলুদা মৌলিক সৃষ্টি না, কিন্তু অসাধারণ। এই কিসিমের ডিটেক্টিভ গল্প পৃথিবীর সব দেশে আছে। কিন্তু এই জনপ্রিয়তার চাপে ওনার অন্য গল্পচর্চা হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। যেমন সিনেমার চাপে তার সাহিত্য সত্তার প্রাধান্য নেই। একসময় যখন সিনেমা দেখতাম ও বই পড়তাম পাগলের মতো, তখনো মনে হতো তার সাহিত্যকে পাত্তা দিচ্ছে না মানুষ। জীবনে অনেক সিনেমা দেখেছি, কয়েক হাজার বই পড়েছি। আমরা আগের দিনের মানুষ, এই ছিল জীবন ডিজিটাল যুগের আগে। কিন্তু এত সব দেখে মনে হয়েছে রায় বাবু বিরাট ছবিয়াল। কিন্তু এমন কী হতে পারে, আরও বড় বা সমমানের সাহিত্যিক? তার লেখা নিয়ে আলোচনা কই?
তিন
আমার কাছে মনে হয় রায় বাবুর সাহিত্যকর্ম উপেক্ষিত হওয়ার অন্যতম কারণ, তার লেখা ছোটদের জন্য মার্কেট করা হয়। অতএব ছোটরা তো সিরিয়াস পাঠক না তাই সেগুলো মূল সাহিত্য বেদি থেকে বাদ। ফেলুদা খুব মজার লেখা, অসম্ভব জনপ্রিয়, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের প্রধান সাহিত্য (আমার কাছে) তার ‘বারোটা’ সিরিজ। বারোটার মতোই বই আছে এই সিরিজে, সব পড়ার দরকার নেই। তবে প্রথম কয়েকটা পড়লেই বুঝবেন, মৌলিক কল্পনা শক্তি ও গল্প বলার কৌশল তার কত বিশাল ছিল। আর এই আমি যে অনেক বই পড়েছি, প্রায় সব পশ্চিমা সাহিত্য, বাঙালি সাহিত্যের তেমন অনুরাগী না, অকপটে বলছি, কিছু গল্প আসলেই অতুলনীয়, দুনিয়া মানের, হয়তো শ্রেষ্ঠ দশ-কুড়িটার মধ্যে।
চার
এই সিরিজের প্রথম বইটির নাম ‘এক ডজন গপ্পো’। এক ডজন গপ্পো, আরও এক ডজন, আরও বারো, এবারো বারো, বাহ্! বারো, একের পিঠে দুই, জবর বারো!-পারলে পড়েন। এমন বই কম আছে বা নেই এই সাহিত্যে। এই বইতে আছে এমন একটা গল্পের কথা বলি। ‘অনাথ বাবুর ভয়’। গল্পের চরিত্রের সঙ্গে দেখা ট্রেনে, তিনি দেশের বিভিন্ন ‘ভূতের’ বাড়ি দেখে বেড়ান। যাচ্ছেন গল্প বলিয়ের এলাকায় একটি পরিচিত ভূতের বাড়ি দেখতে। গল্পটার শুধু শেষটা বলি। সকালে গল্পের কথক চিন্তিত হয়ে সেই বাসায় যান তার খোঁজ নিতে। দেখেন অনাথ বাবু বেরিয়ে আসছেন তাকে দেখে। কথাবার্তা হয়, ভূত দেখতে পাওয়া নিয়ে।
অনাথ বাবু বললেন, বিষয়টা একটু জটিল তাই যেখানে তিনি রাত কাটিয়েছেন সেখানে যাওয়া দরকার। তিনি বলছেন আর তারা যাচ্ছেন ওপরে হেঁটে হেঁটে। যেই ঘরে অনাথ বাবুকে রাতে রেখে এসেছিলেন কথক, সে ঘরে পৌঁছে দেখেন ইজি চেয়ারে এলিয়ে পড়ে রয়েছে মৃত অনাথ বাবু। খালাস। তাহলে সাথের জন কে ছিল? আমি অসংখ্য নামকরা ভূতের গল্প পড়েছি। এমনটি পাইনি, চমকে বিবরণে, বর্ণনায়।
পাঁচ
আরও অনেক গল্প আছে এই সিরিজে, এতদিন পর মনে নেই। দুটি গল্প অতুলনীয়। একটিতে এক মানুষ একজনকে হত্যা করে, মুখোশ পরে। পরে সেই মুখোশটা আর খুলতে পারে না, দম আটকে নিজেই মারা যায়। কে হত্যা করল তাকে? অন্যটির নাম, ‘খগম’। মহাভারতের চরিত্র অনুসারে। এক লোক এক কেউটে সাপ মারে কোনো কারণ ছাড়াই। এক সাধু এই জন্য তাকে অভিশাপ দেয়।
সেই সাপ ঘাতক ক্রমে ক্রমে পাল্টে যেতে যেতে এক রাতের মধ্যে, নিজেই একটি কেউটে সাপে পরিণত হয়। কথক তাকে খুঁজতে গিয়ে দড়িতে ঝুলছে দেখতে পায় একটি মানুষের দেহের খোলস, সেই সাধুর আস্তানায়। দায়িত্ব নিয়ে বলছি এগুলো বিশ্বের সম্পদ। কিন্তু রায় বাবুর সিনেমার ওপর ফোকাস এত বেশি, কেউই তার এই গল্পগুলোর খোঁজ রাখে না। তার সিনেমা একদিন পুরনো হবে, কিন্তু তার সাহিত্য অনাদি কালের সম্পদ।
সাহিত্যিক, গবেষক