Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

খালিস্তান আন্দোলনের সমাধান কি অমৃত পাল সিং

Icon

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৩, ১৪:০৯

খালিস্তান আন্দোলনের সমাধান কি অমৃত পাল সিং

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ। ফাইল ছবি

আবারও বহু দিন পর পাঞ্জাব অশান্ত হয়ে উঠেছে এবং প্রায় বিস্মৃত খালিস্তান আন্দোলন প্রসঙ্গ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে একটি নাম-অমৃত পাল সিং। শিখদের এই খালিস্তান আন্দোলন এক সময় ব্রিটিশ রাজেরও মাথাব্যথার কারণ ছিল। কারণ ব্রিটিশ ভারতেই প্রথম খালিস্তানের স্বপ্ন দেখা শুরু করেন স্বাধীনচেতা শিখরা। 

অবশ্য যারা শিখ আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল তারা জানেন, আদতে শিখদের যে বৃহত্তম বর্গ অর্থাৎ দশগুরুবাদীসহ আরও বেশ কয়েকটি ধারা মনে করে, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে যখন ১৬০৬ সালে পঞ্চম গুরু অর্জুনকে হত্যা করা হয়, মূলত তখনই অনেক শিখ মনে করতে থাকেন মুসলমান ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর অধীনে থেকে শিখ ধর্মের সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান পালন এবং শিখ জনগোষ্ঠীতে শিখ দর্শন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। 

তাদের এই স্বপ্ন প্রথম বাস্তবায়ন করেন মহারাজ রণজিৎ সিং। ১৭৯৯ সালে বর্তমান ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাবের বিশাল ভূভাগ এবং আরও ব্যাপক অঞ্চল নিয়ে তিনি শিখ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তার আয়তন হয় ৫ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার। যারা মোগল এবং পাঠানদের আধিপত্য পাঞ্জাবে সংকুচিত করতে সমর্থ হন, রণজিৎ সিং ভারতের সেসব রাজার মধ্যে প্রধান। তার প্রতিষ্ঠিত এই রাজত্বকে তিনি অবশ্য খালিস্তান বলে অভিহিত করেননি। খালসা (অর্থাৎ খাঁটি বা পবিত্র) আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা শিখ বৃহত্তম বর্গের দশম গুরু গোবিন্দ সিং। 

১৬৯৯ সালের বৈশাখী উৎসবে গোবিন্দ সিং খালসা পন্থের (অর্থাৎ পবিত্র পথ) প্রচলন সূচনা করেন। তবে এটির পেছনেও আছে এক মর্মান্তিক অধ্যায়। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের হুকুমে হত্যা করা হয় নবম গুরু অর্থাৎ গোবিন্দ সিংয়ের পিতা তেগ বাহাদুরকে, ১৬৭৫ সালে। ফলে তখনই শিখ স্বাধীন ভূমি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন স্থায়ী হয়ে যায় অধিকাংশ শিখ ধর্মাবলম্বীর মনে। আর সেই স্বপ্নের কিছুটা মহারাজ রণজিৎ সিং বাস্তবায়ন করলেও তা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৮৪৯ সালে দ্বিতীয় অ্যাঙলো-শিখ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শিখ রাজত্বের অবসান ঘটে। যদিও রণজিৎ সিং প্রতিষ্ঠিত রাজত্ব আক্ষরিক অর্থেই শিখ রাজত্ব ছিল কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে যে কোনো অর্থেই শাসন ব্যবস্থা এখানে ভালো ছিল। অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে কোনো রকম বৈষম্য এই শিখ রাজত্বে করা হয়নি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতাই করা হয়েছে। রাজত্বের বড় বড় পদেও অশিখরা স্থান পেয়েছিলেন। দাপ্তরিক ভাষা ছিলো ফার্সি। 

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের হাতে পঞ্চম গুরু অর্জুনের মৃত্যুর পর যষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ সিং শিখ ধর্মের সামরিকায়ন করেন। তিনি ‘মিরি’ (অস্থায়ী শক্তির প্রতীক) ও ‘পিরি’ (আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক) নামে দুটি তরবারি ধারণ করতেন। দশম গুরু গোবিন্দ সিং এই সামরিকায়নকে সামগ্রিক রূপ দেন। হরগোবিন্দ সিং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে এক ধরনের মার্শাল আর্টেরও উন্নয়ন ঘটান, যার নাম ‘গাটকা’। 

উত্তর ভারতে এই গাটকার চর্চা হাজার বছর ধরে চলছিল, তার সময় থেকে শিখরা এটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। অবশ্য শিখদের কিছু ধারা মনে করে, কোনোভাবেই সামরিকায়ন শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকের শিক্ষা নয়। তবে খালিস্তান (অর্থাৎ পবিত্র স্থান) শব্দটি ১৯৪০ সালে প্রথম উত্থাপন করেন বিদেশে বসবাসরত শিখ ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠী একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতেই, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। 

শিখদের একটি গৌণধারা সহজধারী ধারা। তার এক অনুসারী বাবা দয়াল দাস সিং প্রবর্তন করেন সন্ত নিরাঙ্কারী ধারা। দশম গুরু এবং গুরু গ্রন্থসাহিব থাকার পরও একজন মানুষ গুরুর সম্ভাবনায় তারা বিশ্বাস করেন, যা প্রচলিত বৃহৎ শিখ বিশ্বাসীদের বিশ্বাসের সঙ্গে না মেলার কারণে অতীতে বেশ কিছু সংঘর্ষ বেধেছে। 

১৯৫০-এর দশক থেকেই মূলধারার শিখদের সঙ্গে সন্ত নিরাঙ্কারী ধারার বচসা ও সংঘাতের সূচনা হয় এবং ৬০-এর দশকে এর মাত্রা আরও প্রবল হয় যখন মূলধারার শিখদের দুটি প্রতিষ্ঠান ‘দমদমই টাকসাল’ ও ‘অখ- কিরতানী জাথা’ তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। কারণ তাদের অভিযোগ যে, নিরাঙ্কারীরা শিখ সমাজকে ভুল শিক্ষা দিয়ে বিভ্রান্ত করছে এবং শিখ ধর্মকে বিকৃত করছে। 

ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার আকালী আন্দোলনসহ বিভিন্ন শিখ সংগঠন সেই সঙ্গে দমদমই টাকসাল ও অখ- কিরতানী জাথার মতো প্রতিষ্ঠান তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরোপ করতে থাকে এই বলে যে, তারা নাকি নিরাঙ্কারী ধারার মধ্য দিয়ে শিখ সংহতি ও রাজনৈতিক ঐক্য ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ওই সময়ে কট্টরপন্থি দমদমই টাকসালের নেতা ছিলেন জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে, যিনি ১৯৭৭ সালে সন্ত কারতার সিংয়ের মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। 

১৯৭৮ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতস্বরে নিরাঙ্কারীদের সঙ্গে সাধারণ শিখদের সংঘর্ষে ১৬ জন শিখের মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে ১৩ জনই ছিলেন সাধারণ ও ৩ জন ছিলেন নিরাঙ্কারী। এই ঘটনার পর ৬০ জন নিরাঙ্কারীর বিরুদ্ধে মামলা করে পাঞ্জাবের তৎকালীন নেতৃত্বদানকারী আকালী দল। প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই এবং দেশের বৃহত্তর মিডিয়া অবশ্য নিরাঙ্কারীদের সমর্থন করেন। মূলত এর পরই স্বাধীন শিখরাষ্ট্র খালিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আবার দানা বাঁধে এবং ভিন্দ্রানওয়ালে শিখরাষ্ট্রের জন্য সশস্ত্র আন্দোলনের ডাক দেন। 

১৯৮৪ সালে ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নাম দিয়ে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় সৈন্যরা হরিমন্দির সাহিব অর্থাৎ স্বর্ণমন্দিরে অভিযান পরিচালনা করলে ভিতরে অবস্থানরত ভিন্দ্রানওয়ালে ও তার সশস্ত্র যোদ্ধারা সশস্ত্র যুদ্ধে মারা যান। এর জের হিসেবে ১৯৮৪ সালে অর্থাৎ ঐ বছরই শ্রীমতী গান্ধী তার দুই শিখ দেহরক্ষী বিয়ান্ত সিং ও সতভন্ত সিংয়ের হাতে প্রাণ দেন। এরপর দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া খালিস্তান আন্দোলন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। 

২০২১ সালে সন্দীপ সিং সিধু নামের একজন অভিনেতা ওয়ারিস পাঞ্জাব দে (অর্থাৎ পাঞ্জাবের উত্তরাধিকারী) নামক একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী দল গড়েন এবং ২০২২ সালে তার মৃত্যুর পর দলের নতুন প্রধান অমৃত পাল সিং খালিস্তান আন্দোলনকে আবার সচল করে তোলেন। তিনি প্রকাশ্যেই ভিন্দ্রানওয়াকে শিখ জাতির নায়ক রূপে আখ্যায়িত করেন। যিশু খ্রিষ্ট সম্পর্কে তার মন্তব্য যে, তিনি নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি, অন্যদের কী করে রক্ষা করবেন? 

তার নিজস্ব সশস্ত্র দল ‘ফৌজান’কে নিয়ে তিনি স্বর্ণমন্দিরও পরিদর্শন করেন। ২০২২ সালে নভেম্বরে তার দলের সন্দীপ সিং সানি শিব সেনা নেতা সুধীর সূরীকে হত্যা করলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক মোড় নেয়। পাঞ্জাব পুলিশ অমৃত পাল সিংকে সংক্ষিপ্তকালের জন্য গৃহবন্দিত্বের আওতায় আনে। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই তার সমর্থকরা দুটি শিখ গুরু দুয়ারা তছনছ করে এই কারণে যে, সেখানে গুরু গ্রন্থ সাহিবকে যথার্থ মর্যাদায় রাখা হয়নি। এই বছরেও তার অনুসারীদের দ্বারা অপহরণের ঘটনা ঘটে।

অন্যদিকে তাকে বন্দি করার কারণে তার সশস্ত্র অনুসারীরা পাঞ্জাব পুলিশকে আল্টিমেটাম দেয় এবং তার সশস্ত্র অনুসারীরা পুলিশ বাহিনীর উপর চড়াও হয়। বিশ্বব্যাপী তাদের সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে। মনে হচ্ছে এ ঘটনা সামনে আরও গড়াবে। শিখ সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী এখন পৃথিবীতে কম নয়, প্রায় তিন কোটি। বিশ্বে অর্থনৈতিক দিক দিয়েও তারা বেশ সমৃদ্ধ একটি সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। অথচ তাদের কোনো স্বতন্ত্র ভূমি নেই। 

মোগল, ব্রিটিশ এবং বর্তমান যুগেও তারা কম-বেশি বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। এরকম একটি জাতি স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে অমৃত পাল সিংয়ের মতো আল্ট্রা-অর্থডক্সদের নিয়ে, যিনি এবং তার অনুসারীরা অন্য ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করেন এবং অন্য শিখ ধারাগুলো নিয়ে যাদের প্রবল আপত্তি, তারা কি এই স্বাধীনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম? 

গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫