
শেখর দত্ত। ফাইল ছবি
বর্তমান সরকারের আমলের শেষ বাজেট ঘোষিত হয় সবচেয়ে খারাপ সময়ে। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছিল, সত্তরের মন্দাপরবর্তী পুনরুদ্ধারের পর এখন বিশ্ব অর্থনীতি সবচেয়ে মন্থর। এ অবস্থায় মাঝারি ধরনের নেতিবাচক প্রভাবও বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ১৯ মে মন্ত্রিসভা বৈঠকে বলেছিলেন, করোনার আঘাত ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে চাপের মধ্যে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। এই চাপ মোকাবিলায় অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে একসঙ্গে বসে করণীয় ঠিক করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। করণীয় ঠিক হয়েছিল কিনা, হলে তা বাস্তবায়িত হয়েছিল কিনা, জনগণকে তা অবহিত করা হয়েছিল কিনা, তা মনে করতে পারছি না।
পরবর্তী পর্যবেক্ষণে এটা সুস্পষ্ট, কৃষিতে সফলতা অর্জন এবং ধানকাটাসহ কিছু জনহিতকর কাজ করলেও কৃচ্ছ্রসাধনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ সফলতা দেখাতে পারেনি। সবাই মিলে ত্যাগ নয়, দেশ ভোগের রাজনীতির আবর্তে পড়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি পড়ে ছিল এবং আছে বিএনপির বিরোধিতা নিয়ে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের অন্যতম প্রশংসনীয় অর্জন ছিল বিদ্যুৎ। কিন্তু বাজেট যখন ঘোষিত হয়েছে, তখন প্রচণ্ড গরমে মানুষ রয়েছে চরম লোডশেডিংয়ের মধ্যে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক এলাহী চৌধুরী ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট কাটতে আরও ২/৩ মাস লাগতে পারে’ মন্তব্য করে দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার অর্থাৎ দেশের জন্য ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু জানা যায়, তার বাড়ি বনানীর ১৮ নম্বর সড়কে নাকি লোডশেডিং হয় না। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী কথিত কৃচ্ছ্রসাধনের রাজনীতি মাঠে মারা গেছে।
এদিকে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর। শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার মাসখানেক আগে বলেছেন, ‘আমি অনেককে দেখেছি বাজার করতে গিয়ে কাঁদছেন। কারণ বাজারের যে অবস্থা তার পকেটে সে টাকা নেই। এটার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট।’ আমদানির কথা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে পেঁয়াজের দাম কমে যাওয়ার ভেতর দিয়েও প্রমাণ হয়, শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে। এ অবস্থায় শহুরে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত রয়েছে সবচেয়ে সংকটে-শঙ্কায়।
এ সরকারের আমলে বিগত বছরগুলোতে মানুষ কতটা ভালো ছিল, কোভিড দুর্যোগের সময় সরকার সঙ্গত ও ভালো কাজ কতটুকু কী করেছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে কীভাবে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল; তা দিয়ে কিন্তু গণমানুষের মতামত ও প্রতিক্রিয়া আবর্তিত হবে না। সংকট ও শঙ্কা মানুষকে সমালোচনামুখর করে তুলছে। এরই মধ্যে এসেছে বাজেট। তাই বাজেটের গণবান্ধব বা ভালো দিকগুলো যে আলোচনায় আসবে না এবং আসলেও যে তা সংকট ও শঙ্কাগ্রস্ত মানুষ তেমনভাবে আমলে নেবে না-এমনটা বলাই বাহুল্য।
দেশ রাজনৈতিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। বর্তমান সরকারবিরোধী দল বিএনপি স্বাভবিকভাবেই বাজেটের সমালোচনায় মুখর হয়েছে। কিন্তু তারা আয়নায় নিজেদের মুখ দেখছে না। বিশ্বব্যাপী সত্তরের মতো ভয়াবহ মন্দা যখন ছিল না, তখন ক্ষমতায় থেকে তারা কী বাজেট দিয়েছিল, তা স্মরণে রাখছে না। তাদের আমলে কানসাটের গুলি কিংবা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা এবং দেশ যে তখন ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’, ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ প্রভৃতি তালিকায় উঠেছিল, তা দলটি ভুলে যেতে চাইছে। নিজেরা তখন কী করেছিলেন, তা তাদের আয়নায় দেখা উচিত। বাস্তবে সমাজের উচ্চস্তরে দুঃসময়ের ত্যাগ বা ধৈর্য নয়, ভোগেরই রাজত্ব চলছে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে।
বাজেটপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বিশ্লেষকরা মনে করেন, অন্যান্য বার জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জনতুষ্টির জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হতো বাজেটে। এবার তার অনুপস্থিতি রয়েছে।’ জবাবে তিনি বলেছেন, ‘সরকার ধনী-গরিব সবার জন্যই বাজেট প্রস্তাব করেছে।’ একই প্রশ্নে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচনে জিততে চাই। এ জন্য জনগণকে খুশি করতেই নতুন বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে।’ দৃষ্টিভঙ্গি বা কথার পার্থক্য রয়েছে কিনা তা পাঠকরাই লক্ষ করুন। ধনী-গরিব সবার বাজেট এটা সঠিক। কিন্তু খারাপ সময় যখন চলছে, তখন দুঃখ-কষ্টটা বহন করবে কে? ভোগবাদিতা কাটছাঁট করবে কে?
একটু খেয়াল করলেই প্রতীয়মান হবে, বিগত বছরগুলোতে সরকার বিনিয়োগ ও কল্যাণমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে ‘আয়বর্ধক কর্মসৃজন’, মজুরি ও বেতন বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ভর্তুকি এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ‘আওতা সম্প্রসারণ’ করে জনগণের প্রকৃত আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সেবাবৃদ্ধির কৌশল নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। এ বিষয়গুলো সরাসরি জনসন্তুষ্টির সঙ্গে সংযুক্ত। সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী ‘সরকার ব্যর্থ হয়নি’ বলে মন্তব্য করে বলেছেন, সরকার ৩ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এর বিপরীতে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
এদিকে শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, গত বছর ডিসেম্বর শেষে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ২০ হাজার, মার্চ মাস শেষে হয়েছে ২৫ লাখ ৯০ হাজার অর্থাৎ জানুয়ারি-মার্চ ২০২৩ থেকে আগের তিন মাস অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২২-এর চেয়ে দেশে বেকারের সংখ্যা দুই লাখ ৭০ হাজার বৃদ্ধি পেয়েছে। তখন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছিলেন, শীতকালে কাজের সুযোগ কম থাকায় এমনটা হয়েছে। বেকারের সংখ্যা আবার কমে আসবে। কথাটা সঠিক। প্রসঙ্গত ২০১৭ সালে বেকার ছিল ২৭ লাখ অর্থাৎ ৫ বছর আগের চেয়ে বেকারত্ব কমেছে। বাজেটে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ২০ লাখ বাড়িয়ে ৩০ লাখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্থ বরাদ্দ ১১ শতাংশ বাড়িয়ে ১৬.৫ শতাংশ করা হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থে সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন, ঋণের সুদ রয়েছে বলে সমালোচনা থাকলেও এটাই বাস্তব যে, উপকারভোগীদের সংখ্যা ও পরিমাণ দুই-ই বাড়ানো হয়েছে। অর্থনীতিতে টানাপড়েন ও নানা সমস্যার মধ্যেও সরকার তা করতে ভুল করেনি।
অবস্থা পর্যবেক্ষণে বলা যায়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যা ও টানাপড়েনের মধ্যে বর্তমানে শহুরে মধ্যবিত্ত, বিশেষত নিম্নবিত্তরা রয়েছেন সবচেয়ে শঙ্কা ও অসহায়ত্বের মধ্যে। করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হলেও মুদ্রাস্ফীতির হিসেবে তা খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। ৪৪ ধরনের সেবা পেতে দুই হাজার টাকা আয়কর দিয়ে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র সংগ্রহ করার বিষয়টির সমালোচনা হচ্ছে। নিম্নবিত্ত মানুষ একে চাপ মনে করছে। তবে সরকারি সেবা পেতে কর দিতে হবে-এটা সর্বজনস্বীকৃত।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নিজের অতীত বিবেচনায় তিনি বোঝেন, গরিবের দুঃখ-বেদনা কতটা! বর্তমানে তিনি যখন রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের উচ্চাসনে, তখন তিনি গরিবের বেদনার ভারটা নিজ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর ওপর নিতে পারেন।
সামাজিক নিরাপত্তা বিবেচনায় বাজেটে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও স্বস্তির। দাতা দেশ ও সাহায্য সংস্থার নানামুখী চাপ ও বাধা সত্তে¡ও বাজেটে খাদ্য, এলএনজি, সারে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ বাবদ জিডিপি ১.৯০ শতাংশ রাখা হয়েছে; দাতা দেশ-সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেওয়া এখনো প্রয়োজনীয় হলেও এটা করা সম্ভব হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সামর্থ্য ও শক্তি বাড়াতে সক্ষম হয়েছি বলে।
সবশেষে-ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের ব্যাপারে কী করা হচ্ছে বা হবে তা এখনো অস্পষ্ট। নির্বাচনী অঙ্গীকার মতো ‘দেউলিয়া আইন বাস্তবায়নের টেকসই ও কার্যকর পদ্ধতি’ এখন কী পর্যায়ে রয়েছে তা এখনো অজানা। আর ‘বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে গঠিত আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স’ কী কাজ করছে তাও জানা যাচ্ছে না। গত বাজেটে সহজ শর্ত অর্থাৎ ৭ শতাংশ কর দিয়ে কেউই অর্থ ফেরত আনেনি। ১ টাকাও ফিরে আসেনি। তাই এবারে দায়মুক্তি রাখা হয়নি। এদিকে সমাজের দেয়ালে কান পাতলেই জানা যাবে কারা অর্থ পাচারকারী।
প্রবাদ বলে, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। এই বিবেচনায় সময় সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। সরকার সঠিক ও ভালো কাজ দিয়ে খারাপটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ভালো সময়কে কাছে টানতে পারে। অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাকে গ্রহণ করে নিজেকে আরও খারাপ সময়ের জন্য প্রস্তুত রাখতে পারে। উল্টো দিকে মন্দ কাজ দিয়ে খারাপকে আরও গভীর ও তীব্র করতে পারে।
অসময় যেমন মানুষের দুঃখ-কষ্ট বাড়ায়, তেমনি মন্দ ও বেঠিক পদক্ষেপ দুঃখ-কষ্টকে আরও বাড়াতে পারে। এই সব দিক বিবেচনায় নিয়ে সংসদ বাজেট নিয়ে আলোচনা করুক, সংশোধন-সংযোজন-বিয়োজন করুক, এটাই আজকের একান্ত কামনা।
কলাম লেখক, রাজনীতিক