
আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি
১৯৭১ সালের ইতিহাস চর্চা নিয়ে কথা হলে, অনেকগুলো বিষয় পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। আমরা ভাবি ৭১ মানেই কেবল যুদ্ধ, গোলাগুলি, পালানো, আশ্রয় খোঁজা ইত্যাদি। কিন্তু এসব ছাড়াও আরও কিছু বিষয় ছিল-যেমন প্রেম, ভালোবাসা ইত্যাদি। যদিও আমি এবং আরও কয়েকজন এসব নিয়ে লিখেছি, কিন্তু কথাসাহিত্যে তেমন গুরুত্ব পায়নি।
একটা কথা হলো-ওই কালে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অনেক তরুণ তরুণী এক সঙ্গে থাকতে বাধ্য হয়েছেন, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন ঘটনাও ঘটেছে, যা সব সময় গ্রহণযোগ্যও নয়। কিন্তু হয়েছে। এতে লুকাবার কিছু নাই, ফলাও করারও না। যুদ্ধের কারণেই এটা হয়েছে।
দুই
এইসব কথা এখন বলছি, কারণ আমরা একাত্তরপিডিয়া-ইতিহাসপিডিয়া নিয়ে কাজ করছি। যতদূর সম্ভব বাঁচা-মরার সকল দিকের কথা বলব ভেবেছি। আমাদের ইতিহাস যদি সামগ্রিক বয়ান হতে হয় তবে মানুষের জীবন ও মৃত্যু উভয়ের বিবরণ থাকা উচিত। এই কারণে আমাদের তিনটি গ্রন্থে-গ্রামের একাত্তর, নারীদের একাত্তর ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর গ্রন্থে আমরা বেঁচে থাকার, টিকে থাকার, জীবন যাপনের এই সব তথ্য সামনে এনেছি।
তিন
ঢাকা শহরের এক বাসায় এক তরুণ, ধরে নেই তার নাম করিম, যেতেন নিয়মিত তার বন্ধুর (ধরলাম তার নাম রহিম) সঙ্গে দেখা করতে। গল্প গুজব হলেও একটা কাজ ছিল, কাতর প্রেমিক করিম তার ‘ডার্লিংয়ের’ (ঢাকায় তখন ‘জিএফ’ বলত না, এই শব্দ চালু ছিল) একটা ফটোগ্রাফ নিয়ে ছবি আঁকাতে যেত রহিমের কাছে। রহিম ছবি আঁকত। তার তখন পাস হয়েছে, কিন্তু চাকরি হয়নি। রহিমের ছোট ভাই বোনেরা খুব মজা পেত এই সব জেনে। এর মধ্যে এলো পঁচিশে মার্চ।
চার
মানুষের জীবন যে কীভাবে ওলটপালট হয় তা বোঝানো যাবে না আজকে এসে। প্রথমে পালানো, তারপর আশ্রয়ের সন্ধান, তারপর ফেরা বা আরও দূরে যাওয়া। কিছুটা সামলাতে প্রায় মাস খানেক লেগে যায়। নিজেদের সন্তানদের নিয়ে মানুষ কী যে ভয়ে ছিল। মৃত্যুর পাশাপাশি আসে নয়া ভয়, যার সঙ্গে মানুষের পরিচয় কম ছিল-ধর্ষণ। যারা মেয়ে সন্তানের পিতা-মাতা, তাদের ওপর এ এক বাড়তি চাপ। আমাকে একজন জানায় যে তাকে তার বাবা, রংপুরের এক বাড়িতে দরজা জানালা বন্ধ করে রেখে দেয়। মাস খানেক পর সেই আপা আর সহ্য করতে না পেরে ঢাকায় পালিয়ে আসে। তারপর বাবা তাকে আটকে রাখে ঘরের ভেতর। এরকম অদ্ভুত বহু ঘটনা ঘটেছে, ভয় থেকে যার সূত্রপাত। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ঘটে হুট করে ‘ভালো’ ছেলেপেলের বিয়ে দেওয়া।
পাঁচ
যা ভেবেছেন তাই হলো। একদিন দেখা গেল করিম রহিমের সামনে বসে ছবিটা হাতে নিয়ে কাঁদছে। বোঝার বাকি রইল না কী হয়েছে। এর কয় দিন পর সে আবার ফেরে রহিমের কাছে। জানায় সে যুদ্ধে চলে যাচ্ছে। ‘প্রেম ভি করলাম, ছ্যাঁকা ভি খাইলাম, যামু গা যুদ্ধে’। তার প্রাক্তনের ছবিটা নিয়ে যায়, তবে যুদ্ধে কিনা জানি না। কয়েক মাস পর ফেরে ঢাকা শহরে। কয়েকটা অপারেশন চালায়। আর সব অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ জমা থাকত রহিমের কাছে, যে আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে সব বিগড়ে যাওয়া যন্ত্রপাতি সারিয়ে দিত। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকাতেই ছিল। পরে কী করে কী করে সিনেমা লাইনে চলে যায়। বিয়েশাদি করে সংসারী হয়। ছ্যাঁকা খেয়ে হলো মুক্তিযোদ্ধা। কীসে কী হয় কে জানে?
ছয়
বাহরাম ঢাকার ছেলে, প্রেমে পড়ে পড়শির। লুসি নামের মেয়েটি নির্বাচনের পর আমেরিকা থেকে ঢাকায় বেড়াতে আসে, বাহরামকে ভালো লাগে। ওই উত্তাল দিনে রাস্তায় মিছিলে যায় দুজন, সম্পর্ক হয়। মেয়েটা ভালো করে বাংলা পারত না। তাও খুব চেষ্টা করে। তারপর ২৫ মার্চ। বাহরাম রাজনীতি করত, ওকে নিয়ে ওর মা-বাবা চিন্তিত ছিল। আর লুসির বাবা আমেরিকায়, মেয়ের জন্য পাগল। বাহরাম একসময় বন্ধুদের সঙ্গে যুদ্ধে চলে যায়। ঢাকায় ফেরে কয়েকবার ওই যুদ্ধের মাঝে। লুসি আমেরিকা ফেরত যায়নি, ঢাকায় ছিল। যুদ্ধের মধ্যেই তাদের দেখা হয়। কিন্তু নভেম্বরে এক ঘটনায় সে শহীদ হয়। লুসি অনেক পরে, যুদ্ধের অনেক পরে এই সব জেনেছিল। কী করার ছিল তার? আমেরিকায় ফেরত যায়। আর কোনোদিন এই দেশে আসেনি।
সাত
ওসমান তাদের গ্রামে আক্রমণ হওয়ার পর পালিয়ে যায় অনেকের সঙ্গে। তারপর কীভাবে যেন ঢাকা আসে, দোকানে চাকরি নেয়। ওই সময় সহজ সরল লোকটার সঙ্গে বুয়া-কন্যা জ্যোৎস্নার দেখা হয়। কীভাবে প্রেম ভালোবাসা হয় কেউ বলতে পারে না। যুদ্ধের পর সে গ্রামে ফেরত যায়। এমন কিছু জমি-জমা ছিল না। বাবা কামলা। শহর দেখা ওসমানের সেসব ভালো লাগেনি। তাছাড়া মনে ছিল জ্যোৎস্না। বছর না ঘুরতেই ঢাকা চলে আসে। তখন সব কিছুর টানাটানি। কালোবাজারিতে নামে দোকানের মালিকের সঙ্গে। বছর খানেক পর বিয়ে হয় ওই মেয়ের সঙ্গে। দোকান করে অন্য কোথাও চলে যায়, যাতে মেয়ে যে বুয়া-কন্যা এটা কেউ না জানে। সফল।
আট
আমরা ২৫টি গল্প সংগ্রহ করেছি। যেগুলো সহজ সরল স্বাভাবিক মনে হয়েছে তাই বললাম। কিছু গল্প আছে যা বেশ কষ্টের। স্বামী ছেড়ে অন্যের সঙ্গে চলে যাওয়া, স্ত্রী ফেলে অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক, এই সব। নানা পরিস্থিতি অবস্থাতে এই সব ঘটে। একটি ক্ষেত্রে এক মহিলা তার স্বামী ছেড়ে পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে এক সময় পাকিস্তানে চলে যায়। তার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা ছিল। এক লোক তার পাকিস্তানি পড়শির প্রেমে পড়ে দেশ ত্যাগ করে। ভাগ্যিস, সন্তান ছিল না। এ রকম বহু ঘটনা আছে। আমাদের উদ্দেশ্য একাত্তরের বহু মাত্রিকতাকে উপস্থিত করা, অন্য কিছু নয়।
নয়
তবে ৭১-এ প্রেম-ভালোবাসার গল্পের চেয়ে বিরহ কিংবা বিধবা হওয়া ছিল বহু গুণ বেশি।
সাহিত্যিক, গবেষক