Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় হাইকোর্টের বার্তা

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৩, ১৫:০৩

নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় হাইকোর্টের বার্তা

আমীন আল রশীদ

বরিশালের বানারীপাড়ায় সন্ধ্যা নদীর সীমানা জরিপ ও নদীর জায়গায় থাকা দখল ও স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পাঁচ বছর আগে দেওয়া রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কত দিন লাগবে? ১০০ বছর হলেও হয়তো হবে না।’ 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, সন্ধ্যা নদী বাঁচাতে একটি রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনাসহ রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি উল্লেখ করে মামলার বাদী বলেন, আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকেরা টালবাহানা করেন। এ সময় আদালত বলেন, ‘সচিব থেকে যা দেখছে, তাই শিখবে। সচিব তো কেয়ার করেন না। আদালত অবমাননার কয়েক হাজার মামলা পড়ে আছে।’ রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আমেরিকা নিচ্ছে না, আটকে দিচ্ছে। দেশ এটিই, এটার মধ্যে থাকতে হবে। সব লুট করে নিয়ে যাবেন, সব আটকে রেখে দেবে। ভালো করে বুঝিয়ে বলেন, দেশের পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য। সময় দিচ্ছি, না পারলে আপনার ডিসি সাহেব এসে আদালতে বলবেন।’ (প্রথম আলো, ২৮ মে ২০২৩)।

দেশের নদী, পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় উচ্চ আদালতের এই ধরনের সাহসী পদক্ষেপ নানা সময়ে প্রশংসিত হয়েছে। ২০১৯ সালে একটি রায়ে দেশের সব নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করে হাইকোর্ট বলেছেন, মানুষের মতো নদীরও বাঁচার অধিকার রয়েছে। এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ে নদী দখল ও দূষণ রোধে উচ্চ আদালত পদক্ষেপে নিয়েছেন, যা মানুষকে আশাবাদী করেছে। বস্তুত মানুষ এখনো বিশ্বাস করে, কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা না থাকলেও তার সবশেষ ভরসার নাম উচ্চ আদালত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আদালত যাদের উদ্দেশে এই নির্দেশনা দিলেন, সতর্ক করলেন, তারা কি বার্তাটা বুঝতে পেরেছেন?

পাঠকও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, আদালত কী ইঙ্গিত করেছেন। আদালত মনে করিয়ে দিয়েছেন, দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে টাকা পাচার করে সেখানে বাড়ি গাড়িসহ বিপুল বিত্ত-বৈভব গড়ে তুললেও শেষরক্ষা নাও হতে পারে। সংশ্লিষ্ট দেশ ওই সম্পদ আটকে দিতে পারে। ফলে আদালত বলছেন, নিজের দেশই ভরসা। এখানেই থাকতে হবে। সুতরাং নিজের দেশের নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি ঠিক রাখতে হবে। অন্তত যাদের বিদেশে কিছু নেই, দেশেই থাকতে হবে, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে যে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়তে হবে, আদালত সেটিই মনে করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও যারা ভাবছেন যে দেশ গোল্লায় যাক, শেষ জীবনটা বিদেশে আরাম-আয়েশে কাটাবেন, আদালত সতর্ক করে বলে দিয়েছেন যে, সেই সুযোগ সবার নাও হতে পারে। 

আদালত এখানে আরেকটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলেছেন যে, ডিসি সাহেবরা সচিবদের কাছ থেকে যা শিখেছেন, সেটিই করেন। কারণ সচিব সাহবেরাই আদালতের নির্দেশনা পাত্তা দেন না। তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার কয়েক হাজার মামলাও পড়ে আছে।

প্রশ্ন হলো, সচিব বা সরকারের আমলারা কেন আদালতের আদেশ মানেন না বা তাদের মধ্যে এই সাহস তৈরি হয় কীভাবে? আদালত কি ব্যক্তিস্বার্থে কোনো আদেশ দেন? নদী, পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় আদালত যে আদেশ, নির্দেশ, রায় ও নির্দেশনা এবং পর্যবেক্ষণ দেন, সেগুলো দেশের স্বার্থে। মানুষের স্বার্থে। তাহলে মাঠ প্রশাসন কেন এগুলো আমলে নেয় না?

বলা হয়, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ চাইলে এক বছরের মধ্যে দেশের চেহারা বদলে যেতে পারে। একজন ডিসি বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চাইলে তিন দিনের মধ্যে তার এলাকার নদীপাড়ের সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারেন। আইনত সেই ক্ষমতা তাদের আছে। অনেক স্থানে এরকম উদ্যোগ নেওয়াও হয়েছে। কিন্তু তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই কাজগুলো করেন না। এখানে কয়েকটি ফ্যাক্টর কাজ করে। যেমন-

  • নদী দখলদার এবং কারখানা গড়ে তুলে সেই কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলে যারা নদী বিপন্ন করেন, তারা সমাজের প্রভাবশালী। সঙ্গত কারণেই তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের যোগসাজশ থাকে। ফলে একদিকে তাদের আর্থিক ক্ষমতা, অন্যদিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে স্থানীয় প্রশাসন অনেক সময় তাদের স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিতে ভয় পায়। 
  • নদী দখলদার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্থানীয় পর্যায়ে বড় বাহিনী থাকে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে গেলে অনেক সময় তাদের সঙ্গে সংঘাতের শঙ্কা থাকে। ফলে স্থানীয় প্রশাসন অনেক সময় এটাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। 
  • অভিযান চালিয়ে প্রভাবশালীদের অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও কিছুদিন পর আবার সেগুলো দখল হয়ে যায়। 
  • অনেককে আটক বা গ্রেপ্তার করা হলেও আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে আসেন। 
  • পুলিশ ও প্রশাসনের অনেক অসৎ কর্মকর্তা ওইসব প্রভাবশালীর কাছ থেকে নানারকম অবৈধ সুবিধা নিয়ে চুপ থাকেন। 
  • অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ঝামেলা এড়িয়ে তার চাকরির মেয়াদকাল শেষ করতে চান। অর্থাৎ দেশ ও জনগণের স্বার্থে যে কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেবেন সেটিকে তারা অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। অনেক সময় সৎ অফিসাররাও কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চান না। 

এরকম নানা কারণে দেশের নদী, পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির ওপর হুমকি সৃষ্টিকারীরা মূলত বিচারের বাইরে থেকে যান এবং যারা আদালতের নির্দেশও অমান্য করেন, তাদেরও ওই অর্থে কোনো শাস্তি হয় না। কারণ উচ্চ আদালত নিজেই বলেছেন যে, আদালত অবমাননার হাজার হাজার মামলা পড়ে আছে। যদি পরপর অনেকগুলো মামলার বিচার হতো এবং আদালত অবমাননার দায়ে কোনো সচিব, ডিসি, ইউএনও বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার শাস্তি হতো, চাকরি চলে যেত, তাহলে অন্যরা আদালতের আদেশ অমান্য করার সাহস পেতেন না। ফলে নদী দখল ও দূষণের জন্য দায়ীরাও ভাবেন, তাদেরও কিছু হবে না। 

কিন্তু বাংলাদেশের লাইফলাইন যে নদী, তা যদি বিপন্ন হলে ৫০ বছর পরে এই দেশের অবস্থা কী হবে? পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই বাংলাদেশের মতো এত নদী নেই। কিন্তু বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও ভূমির গঠনই অন্যরকম। ইউরোপ-আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না। এই দেশে নদী না থাকলে কোনো প্রাণ বাঁচবে না। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখেই উচ্চ আদালত স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, দেশের পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে। কিন্তু যাদের উদ্দেশে আদালত এই কথা বললেন, তারা আদৌ দেশের পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত কি না, সেটিই বিরাট প্রশ্ন। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫