
আমীন আল রশীদ। ফাইল ছবি
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গাজীপুরের মতো ‘অঘটন’ ঘটেনি। যদিও গাজীপুরের ঘটনাকেও ‘অঘটন’ বলা যায় না। কারণ সেখানে নৌকার প্রার্থী হারেননি। বরং জিতেছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তিনি ভোটে না থাকলেও তার ডামি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন তার মা জায়েদা খাতুন এবং জায়েদা খাতুন জিতেছেন মূলত জাহাঙ্গীর আলমের ক্যারিশমায়। ফলে এক অর্থে এটিও অঘটন নয়। কেননা গাজীপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের চেয়ে জাহাঙ্গীর আলমের জনপ্রিয়তা যে বেশি, সেটি নানা ঘটনায় প্রমাণিত।
বরিশালে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এরকম কোনো অঙ্ক বা ক্যারিশমা ছিল না। কিছু গৃহদাহ থাকলেও তা যে শেষ পর্যন্ত হালে পানি পায়নি, সেটি প্রমাণ হলো ৫৩ হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতের জয়ের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ কিছু অনিশ্চয়তা থাকলেও খোকন সেরনিয়াবাতই যে জয়ী হবেন, সেটি শুরু থেকেই ধারণা করা যাচ্ছিল। যদিও ভোটের ফল প্রত্যাখ্যান করেছেন খোকনের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মো. ফয়জুল করিম।
বস্তুত বরিশালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে এখন পর্যন্ত নতুন কোনো শক্তি গড়ে ওঠেনি বা অন্য কোনো দলের কেউ মেয়র হননি। উপরন্তু এবার বিএনপিও মাঠে নেই। দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়েই তারা সিটি নির্বাচন বয়কট করছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, গত নির্বাচনে বাসদ বরিশাল জেলা শাখার সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী বেশ আলোচিত হলেও এবার দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে তিনিও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। ফলে এবার নৌকার সঙ্গে মূল লড়াই যে হবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীর, সেটি বোঝা যাচ্ছিল। যদিও অনেকে ভেবেছিলেন সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রুপন যেহেতু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন, ফলে বিএনপির ভোট তিনি পাবেন। কিন্তু দেখা গেল তিনি হাতপাখার চেয়েও কম ভোট পেয়েছেন।
বরিশালে নৌকার প্রার্থী বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ, যিনি রাজনীতিতে সেভাবে পরিচিত নন, মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই তার সঙ্গে ভাতিজার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। অবশ্য বিগত পাঁচ বছরে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ নানাবিধ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যেভাবে বিতর্কিত হয়েছেন, তাতে এবার তিনি মনোনয়ন পেলে এবং মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে হেরে যেতেন বলে নাগরিকদের অনেকেই মনে করেন।
বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সেরনিয়াবাত পরিবার বরাবরই একটা ফ্যাক্টর। কিন্তু তা সত্ত্বেও পারিবারিক বিরোধই এখন এখানে নৌকার প্রার্থীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
বহু বছর ধরেই বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতি মূলত দুই মেরুতে বিভক্ত। এক মেরুতে দলের সিনিয়র নেতা আমির হোসেন আমু এবং অন্য মেরুতে আরেক সিনিয়র নেতা আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ। দুজনই পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ হলেও আমির হোসেন আমুর পাল্লা ভারী। তিনি যেখানে সক্রিয় হয়েছেন বা যার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, সেখানে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ কিছুটা ‘সাইডলাইনে’ চলে গেছেন।
বৃহত্তর বরিশালে আওয়ামী লীগের আরেক সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদের প্রভাব থাকলেও সেটি আমু বা হাসনাতের চেয়ে বেশি নয়। উপরন্তু বরিশালের আরেক জাঁদরেল নেতা এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক যে আমির হোসেন আমুর ঘনিষ্ঠ, সেটিও গোপন কিছু নয়। ফলে সবকিছু মিলিয়ে বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এবার যেহেতু বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে তার চাচা খায়ের আবদুল্লাহকে কেন্দ্র মনোনয়ন দিয়েছে, ফলে দলের মূল ধারাটি তার পক্ষেই ছিল। বরং এই নির্বাচনে খায়ের আবদুল্লাহকে ঠেকাতে গিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ এবং তার ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ আরও বেশি সাইড লাইনে চলে গেলেন বলেই মনে হয়।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বরিশাল সিটির মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ ঢাকায় অবস্থান করছেন। এমনকি তিনি ভোট দিতেও বরিশালে যাননি। শুধু সাদিকই নন, তার অনুসারীরাও ভোট দেননি বলে শোনা যাচ্ছে। বরিশালে আগামী দিনের রাজনীতি এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে কি না, সেটি অবশ্য এখনই বলা কঠিন।
বরিশাল সিটি মূলত বিএনপি অধ্যুষিত। ফলে অনেকের ধারণা ছিল, দলটি নির্বাচন বর্জন করলেও তাদের সমর্থকদের ভোটে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে। কিন্তু গণমাধ্যমের খবর বলছে, খুব বেশি ভোটার আসেননি। তার ওপর দুপুরের দিকে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। না হলে আরও কিছু ভোট পড়ত। কিন্তু তারপরও কথা হচ্ছে, বিএনপি সমর্থকরা কেন স্বতন্ত্র প্রার্থী রুপনকে ভোট দেবেন? তিনি তো দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। ফলে নৈতিক কারণেই তার বিএনপির ভোট পাওয়ার কথা নয়। তারপরও অনেকের ধারণা ছিল, যেহেতু বরিশাল শহরে বিএনপির ভোট বেশি বলে মনে করা হয় এবং আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে তাদের বিরুদ্ধে জনগণের অনেক অভিযোগও আছে, ফলে একধরনের প্রতিশোধ নিতে তারা হয়তো নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। কিন্তু এই অঙ্কও শেষ পর্যন্ত বরিশালে কাজ করেনি।
গত পাঁচ বছরে বরিশালবাসী সিটি করপোরেশনের সেবা থেকে যেভাবে বঞ্চিত হয়েছে, তারা হয়তো সরকারি দলের বাইরে অন্য কাউকে ভোট দিয়ে সেই বঞ্চনার লিগ্যাসি বহন করতে চায়নি। তারা হয়তো ভেবেছে, সেরনিয়াবাত পরিবারের লোক হলেও খায়ের আবদুল্লাহ যেহেতু ব্যক্তি হিসেবে সজ্জন এবং তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, ফলে আওয়ামী লীগের আমলে তাকে নির্বাচিত করলে অন্তত বিগত পাঁচ বছরের বঞ্চনার অবসান হবে।
প্রসঙ্গত, আবুল খায়ের আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। তিনি যুবলীগের আগের কমিটির সদস্য ছিলেন। বরিশালেও তার কোনো দলীয় পদ নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আবুল খায়ের ও হাসনাতের বাবা আবদুর রব সেরনিয়াবাতকেও তার মিন্টো রোডের বাসায় গুলি করে হত্যা করা হয়। খায়েরও ওই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন। যদিও তিনি বরাবরই রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন অথবা তাকে দূরে রাখা হয়েছিল। এমনকি তিনি বরিশাল শহরের স্থায়ী বাসিন্দাও নন। বড় ভাই হাসনাত আবদুল্লাহর সঙ্গে তার বৈরিতার কথা বরিশালবাসী জানে। হাসনাত আবদুল্লাহর ছেলে সাদিক আবদুল্লাহকে বাদ দিয়ে খোকনকে মনোনয়ন দেওয়ায় তাকে জেতাতে মাঠে সক্রিয় হয় বরিশাল আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ- যারা হাসনাত-সাদিকের কারণে দীর্ঘদিন কোণঠাসা ছিল। ফলে খোকন সেরনিয়াবাতের জয়ের মধ্য দিয়ে বরিশালের রাজনীতিতে হাসনাত ও সাদিক সংকটে পড়তে পারেন বলে মনে হয়।
বরিশালের সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে তার স্থলে এই পরিবারেরই একজন ভদ্রলোককে মনোনয়ন দেওয়াটা ছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। যেহেতু বিএনপি সরাসরি এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি, ফলে বিএনপি সমর্থক সাধারণ ভোটারদের বিরাট অংশ দলমতের বাইরে গিয়ে ব্যক্তি খোকনকে ভোট দিয়েছেন বলে ধারণা করা যায়। এই ভোটারদের হাতপাখায় ভোট দেওয়ার কথা নয়। কারণ এখানে হাতপাখা জিতে গেলে সেটি বিএনপির জন্য ক্ষতির কারণ হতো। আগামী নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গেও লড়তে হতো কিংবা তারা যদি বিএনপির সঙ্গে জোট করে সেখানে তারা বরিশালের এই বিজয়কে কেন্দ্র করে অনেক বেশি হিস্যা দাবি করত। সে কারণে বিএনপির অনেকেই চেয়েছেন বরিশালে নৌকার প্রার্থী জিতলেও যাতে হাতপাখা না জেতে।
অনেকের ধারণা ছিল, বরিশাল সিটি নির্বাচনে বিজয় কিংবা পরাজিত হলেও বিপুল ভোট পাওয়ার মধ্য দিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুফতি ফয়জুল করিম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। কেননা এই দলটি যে চরমোনাই পীরের, তার আবাস বা দরবার এই বরিশাল শহরের অদূরেই। সারা দেশে চরমোনাই পীরের প্রচুর মুরিদ আছেন। কিন্তু পীরের কাছে দোয়া চাওয়া আর ভোটের রাজনীতি যে এক জিনিস নয়, বরিশালে সেটিও প্রমাণ হলো।
তবে গাজীপুর, বরিশাল ও খুলনায় কারা জিতলেন-হারলেন, সেটি রাজনীতির হিসাব। এই হিসাব দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে এখনই উপসংহারে পৌঁছানো যাবে না। কিন্তু সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, অনেক বছর পরে যে দেশে ভোটের একটি আবহ ফিরে এসেছে; মানুষ যে অন্তত ভোট দিতে পারছে; সেটিই সাম্প্রতিক তিনটি নির্বাচনের সবচেয়ে বড় অর্জন। এই ধারাবাহিকতা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত অব্যাহত থাকুক, এই প্রত্যাশা।