
আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি
মেয়েটি আমাকে বলল, সে বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া করতে চায়। এখন চাকরিতে আছে। মনে করে উন্নতি করতে হলে বাইরে থেকে ডিগ্রি আনলে ভালো হয়। ‘সবাই তো বিদেশ যাচ্ছে ডিগ্রি নিতে।’ মেয়েটিকে আমি বললাম, ‘তোমার তো বিশাল অফিস। একজনকে দেখাও, যার বিদেশ থেকে ডিগ্রি আনার কারণে উন্নতি হয়েছে?’
মেয়েটি চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, “তা নয়, তবে সবাই কেন যেতে চায় তাহলে? আমি তো দেখি সারাদিন শুধু অ্যাপ্লিকেশনের পেছনে দৌড়াচ্ছে মানুষ। আর আমি তো শুধু এমএ পাস। আমাকে পাত্তা দেবে কেন?”
চাকরিতে উন্নতি করতে, অফিসে প্রভাবশালী হতে কয়েকটি পরামর্শ দিলাম আমার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। আমি নিজে অফিসের বস ছিলাম, তাই কর্মীদের মধ্যে বস কী চায় জানি। নিজের প্রোফাইল কীভাবে তৈরি করতে হয়, এই সব। মেয়েটা শুনল। কিছুটা হলেও মনে ধরেছে মনে হলো। তবে আশা ছাড়বে না। আসলে মেয়েটা একটু হতাশ, হয়তো এটাই আসল কথা। মনে হয় ভাবছে চাকরির উন্নতির দরজা একটু ছোট হচ্ছে। তাই এই সব ভাবনা।
আমি মনে করি সবার বিদেশ যাওয়া উচিত, তবে জানা দরকার কেন? এটাই। ভালো থেকো মেয়ে।
দুই
সমাজে অনেক কিসিমের মানুষ আছে, তাদের বিদেশ যাওয়ার কারণও ভিন্ন ভিন্ন। সবচেয়ে সহজ সরল হচ্ছে গ্রামীণ মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর বিদেশ যাওয়া। তারা যায় রুজি করতে, সেটা সৌদি, মালয়েশিয়া বা অন্য কোথাও। যদি কপাল ভালো থাকে, এক দশকের মতো থাকতে পারলে, টাকা পাঠিয়ে নিজের ও বংশের উন্নতি ঘটাতে পারবে দেশে; এটাই উদ্দেশ্য। আমাদের সবচেয়ে সফল বিদেশ যাওয়া দল এরাই। এদেরকেই আমরা ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ বলি।
তিন
গ্রামে আর শহরে একাধিক কিসিমের মধ্যবিত্ত আছে। তাদের একটি অংশ যায় ইউরোপ ও অন্য পশ্চিমা দেশে। এরা কাজ খুঁজতে যায় নানা ছুতায়। আগে অনেকে যেত অ্যাসাইলামের নামে, এখন চোরা পথেও। অনেকেই কিছু না কিছু কাজ পেয়ে যায়। এরা কিছুটা দক্ষ, ওখানে আর একটু দক্ষ হয়। বের করে না দিলে অনেকে থেকে যায়, দেশে ফেরে, ওখানে ঠিকানা রাখে। এরা প্রবাসী গোষ্ঠী হিসেবে সবল, দেশে ফিরেও সবল। তবে যারা গরিব ঘরের মানুষ, তারা ধবল দেশে গিয়ে প্রতারিত হয়, পানিতে ডুবে মরে, অনেকেই ফেরত আসে সব হারিয়ে। এরকম ফেরত আসাদের নিয়ে কিছু সহায়ক কার্যক্রমও আছে। মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রেও এটা ঘটে।
চার
এই যে ওপরের দুই কিসিমের মানুষ, যায় রুজি করতে, কিন্তু সবাই ফেরে না। মধ্যপ্রাচ্য যারা যায় তারা প্রায় সবাই ফেরে। কিন্তু গ্রামে আর এক কিসিমের লোক আছে যারা আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে। তারা গ্রামের নিম্নবিত্ত। অতি দরিদ্র নয়, তাদের সংখ্যা কম, কিন্তু যারা কষ্টে আছে বা আরও উন্নত সামাজিক সুবিধার জীবন চায়। অথবা বৈবাহিক কারণে অন্যত্র যাওয়া দরকার। এরা গ্রামে থেকে শহরে যায় এবং এদের সংখ্যা বর্ডার পার করা প্রবাসীদের চেয়ে বেশি। এরা বেশিরভাগ ঢাকা আসে। ঢাকার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক এরা। ম্যাক্রোট্রেন্ডস অনুযায়ী বাংলাদেশের গ্রামের জনসংখ্যা কমছে, কারণ জন্মের সংখ্যার চেয়ে গ্রাম ত্যাগ হচ্ছে বেশি। আর এদের কাছে ঢাকা বিদেশ। শহরের মানুষের তাদের খুব প্রয়োজন, গার্মেন্টস কর্মী বা সাফ করার কর্মী যা-ই হোক। অবস্থা ফেরাবার সহজ উপায় শহরে যাওয়া।
পাঁচ
তাহলে বাকি রইল কারা? ফেসবুক মধ্যবিত্তরা। অর্থাৎ যারা গেলে বা এলে জানান দিয়ে যায় আসে। যারা আমাদের নিকটজন, যারা আমরা। যারা ওই বিদেশ যেতে ইচ্ছুক মেয়েটির মতো। এখানে দুই-তিন কিসিমের মানুষ আছে। এক হচ্ছে যারা বিদেশে পড়তে যেতে চায় তারপর কী হবে সেটা নিয়ে ঠিক ভাবনা নেই। দ্বিতীয় হচ্ছে যারা, পড়তে যেতে চায় এবং শেষ হলে এর মাধ্যমে প্রবাসী হতে চায়। তিন নম্বর হচ্ছে পড়তে যেতে চায় প্রবাসে যাবার উদ্দেশ্যে। আর শেষ অংশ হচ্ছে যারা অ্যাপ্লাই করে লটারি দিয়ে আমেরিকা, কানাডা যায়। আমি এদের সবার যাওয়ার সমর্থক। তবে পড়ুয়া টাইপের প্রবাসীদের জানা দরকার প্রবাসটা কেমন। যাতে করে গিয়ে কষ্ট না পেতে হয়।
ছয়
বিদেশে গিয়ে ডিগ্রি করে দেশে ফিরে লাভ হয় মাস্টারদের, অন্য কারও তেমন নয়। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কোর্স করা যায়, ডিগ্রি নয়। উন্নতির জন্য দেশে সবল হতে হয়, ডিগ্রি তার প্রধান হাতিয়ার নয়। এখানে বসেই প্রোফাইল গঠন করা যায়, কনেকশন বৃদ্ধি করে এগোনো যায়। তবে একাডেমিক চাকরিতে বিদেশ লাগে অনেকের। বাকিদের তেমন না।
সাত
ওখানে গিয়ে যারা ডিগ্রি শেষ করে তাদের খুবই স্বল্প সংখ্যক সেখানে বড় চাকরি পায়। অনেক কাজ, টাকা অর্জন, সংসার সামলানো এ সবের চাপেই কাবু হয়ে যায়। এগোতে পারে না। কম বয়সের মানুষজন ওখানে পথ পাল্টে অন্য কিছুতে চলে যেতে পারে, যায়। সেটা অন্য হিসাব। তাই যাওয়া উচিত কম বয়সে। ডিগ্রি মুখ্য বিষয় নয়, আসল হলো প্রবাসে যাওয়া। আমার মতে যেই পারে, যার ইচ্ছা আছে, তাদের যাওয়া উচিত।
আট
আমি নিজে প্রবাসী ছিলাম বলেই বলছি, এত আরামদায়ক মধ্যবিত্ত জীবন এদেশে পাওয়া সম্ভব নয়। বিনা ঝামেলায় এত সুখ সইবে তো? সইবে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কিছুর দায়িত্ব নেয় সরকার রাষ্ট্র। আর আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে নিজ দেশেও প্রভাবশালী মানুষ হওয়া যায় বিদেশে বসে। তাছাড়া পরের জেনারেশন এসব ‘দেশ’ টানে ভোগে না। অতএব যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে সেই দেশ কোনোদিন কেউ কিছু হতে পারে না দেখলাম। কিছুটা অদৃশ্য জীবন তাদের। যারা দেশের জন্য কিছু করতে চায়, তাদের সুযোগ কম। কারণ ওটা দেশ নয়। যাদের এই ঝামেলা নেই মনে, তাদের বাদে সবার বিদেশ যাওয়া উচিত।
নয়
বড়লোকদের বিদেশ গমন নিয়ে কিছু বললাম না। তাদের আলাদা কিস্সা। অন্য কোনো লেখায় কোনো এক দিন।