-64b8b81243581.jpg)
আমীন আল রশীদ
সংসদ সদস্য আকবর হোসেন খান পাঠানের (চিত্রনায়ক ফারুক) মৃত্যুতে শূন্য হওয়া ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত। রাজধানীর অভিজাত গুলশান-বনানী-ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে গঠিত এই আসনের মোট ভোটার ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন। এর মধ্যে ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট পেয়ে এমপি হয়েছেন আরাফাত। অর্থাৎ মোট ভোটারের মাত্র ৮.৮৬ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি এমপি।
সরল অঙ্ক হচ্ছে, বাকি ৯১.১৩ শতাংশ ভোটার তাকে ভোট দেননি। এই যে মাত্র ৮ শতাংশ ভোট পেয়েও এমপি-চেয়ারম্যান-মেয়র হওয়া যায়, এটি আমাদের বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় বৈধ। অর্থাৎ ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট না পেলে ভোট বৈধ হবে না বা কমপক্ষে কত শতাংশ ভোট না পেলে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে না, এমন কোনো বিধান নেই। না থাকার ফলে এখন কেউ যদি ৩ লাখ ভোটের মধ্যে এক হাজার ভোট পান, এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ৯৯৯ ভোট পান, তাতেও তিনি জয়ী।
এ আসনে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন মোট ৮ জন। আরাফাত ও হিরো আলম ছাড়াও এখানে আরও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের প্রার্থী ছিলেন। এই প্রার্থীদের মধ্যে জাতীয় পার্টির সিকদার আনিসুর রহমান পেয়েছেন ১ হাজার ৩২৮ ভোট আর সবচেয়ে কম মাত্র ৫২ ভোট পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. তারিকুল ইসলাম।
স্মরণ করা যেতে পারে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এখন যারা মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তারাও খুব সামান্য ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। উত্তর সিটিতে আতিকুল ইসলাম মেয়র হয়েছেন মোট ভোটারের ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশের সমর্থন নিয়ে। আর দক্ষিণে মোট ভোটারের ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশের সমর্থন নিয়ে মেয়র হয়েছেন শেখ ফজলে নূর তাপস। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, উত্তর সিটিতে ভোট পড়েছে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। তার মানে উত্তরে প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং দক্ষিণে ভোট দেননি ৭০ শতাংশের বেশি।
ঢাকা-১৭ আসনে মাত্র ৮ শতাংশ ভোট পেয়েও যে মোহাম্মদ আরাফাত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন, এটি আইনত বৈধ হলেও কেন এই ভোট নিয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল না বা কেন এত কম সংখ্যক লোক ভোট দিতে এলেন এবং কেন এত সামান্য ভোট পেয়ে তাকে নির্বাচিত হতে হলো, তার কারণ বিশ্লেষণ করা জরুরি।
ধারণা করা যায়, এই নির্বাচন নিয়ে মূলত দুই কারণে ভোটারের আগ্রহ কম ছিল। ১. নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি অংশ নেয়নি এবং ২. এই সংসদের মেয়াদ আছে আর ৫ মাসের মতো। এত অল্প সময়ের জন্য একজন এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি যে খুব বেশি কাজ করতে পারবেন না, সেটি ভোটাররা তো বটেই, বিজয়ী প্রার্থীও জানেন।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে কম ভোটার উপস্থিতির ব্যাপারে সরকারি দলের তরফে এর একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল যে, মানুষ ‘সুখে-শান্তিতে’ আছে বলে ভোট দিতে যায়নি। যদিও সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার প্রধান কারণ ছিল, মানুষ জানত যে ভোটের ফল কী হবে। অর্থাৎ যে খেলার ফল নির্ধারিত, সেই খেলা দেখার জন্য ভোটাররা কষ্ট করে কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ বোধ করেনি।
এর বাইরে আরও অনেক কারণে ভোটের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ কমছে। অনেকে মনে করেন, আমি ভোট না দিলে কী হবে? অনেকে ভোটের দিন তার এলাকায় সাধারণ ছুটি থাকে বলে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সময় কাটান। কেউ কেউ ঘুরতেও চলে যান। ফলে একেবারে দলের ডেডিকেটেড কর্মী এবং প্রার্থীদের নিজস্ব লোকের বাইরে খুব বেশি ভোটারকে কেন্দ্রে আনা কঠিন। অনেকে ঝামেলা এড়ানোর জন্যও ভোট দিতে যান না।
দুই
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে যে কারণেই ভোটার উপস্থিতি কম হোক না কেন এবং নির্বাচনটি যত কম গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন, এই নির্বাচনের প্রধান ‘আকর্ষণ’ ছিলেন আশরাফুল আলম- নেট দুনিয়ায় যিনি ‘হিরো আলম’ নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন এই নির্বাচনের অন্যতম স্বতন্ত্র প্রার্থী। যিনি ঢাকা-১৭ আসনের বাসিন্দা নন।
এর আগে গত পয়লা ফেব্রুয়ারি বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনে উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন হিরো আলম। এর মধ্যে বগুড়া-৪ আসনে তিনি ৮৩৪ ভোট কম পেয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত জাসদের প্রার্থী একেএম রেজাউল করিমের কাছে হেরে যান। আর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রাগেবুল আহসানের কাছে জামানত হারান বগুড়া-৬ আসনে। যদিও বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার কাছে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেনি জাপা। এর আগে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও হিরো আলম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে না অভিযোগে দুপুরে বর্জন করেন। ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। তবে শেষমেশ মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।
হিরো আলম ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী হবেন, এই ঘোষণা শোনার পরপরই নেট দুনিয়া তো বটেই, গণমাধ্যমও তাকে নিয়ে সরব হয়ে ওঠে। সত্যিই রাজধানীর সবচেয়ে অভিজাত এলাকার উপনির্বাচনে; যে নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ আরাফাতের মতো এমন একজন ব্যক্তি যিনি টেলিভিশনের টকশোতে সরকার ও সরকারি দলের কর্মকাণ্ডের পক্ষে জোরালো ভাষায় কথা বলে আলোচিত; যিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক; যিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যই শুধু নন, বরং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও যার হৃদ্যতা, সেরকম একজন প্রার্থীর সঙ্গে হিরো আলমের লড়াইয়ের ঘোষণা দেওয়াটা স্বভাবতই জনমনে কৌতূহলের জন্ম দেয়। কিন্তু বিপত্তি বাধে ভোটের দিন।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, নৌকার ব্যাজধারী কিছু লোক হিরো আলমের ওপর হামলা করেছেন। শোনা যাচ্ছে, তিনি বেশ কিছু সমর্থকসহ কেন্দ্রের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন। তার সঙ্গে অনেক ইউটিউবারও ছিলেন। যেখানে কেবল বৈধ কার্ডধারীদের ঢোকার অনুমতি ছিল। এ নিয়ে হয়তো তর্ক-বিতর্কের জেরে তার ওপর হামলা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হিরো আলম এবং তার অনুসারীরা যদি অবৈধভাবে কেন্দ্রে প্রবেশের চেষ্টা করেও থাকেন, তাহলে তাদের বাধা দেওয়ার এখতিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। কোনো প্রার্থীর বা দলের লোকজন তার ওপর হামলা করবেন কেন? অবশ্য এ ঘটনার পর নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, হিরো আলমের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই আসনে বিজয়ী প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাতও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয় এবং সংসদ নির্বাচনে দেশের প্রধান দুটি দল অংশ না নিলে সেই ভোটের ব্যাপারে ভোটাররা আগ্রহ দেখায় না, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন কি সেই বার্তাটিই দিল? একটি অতি সাধারণ উপনির্বাচন, যে নির্বাচনে জয়ী প্রার্থী মাত্র ৫ মাসের জন্য এমপি হবেন, যে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির প্রার্থীও ছিলেন না, সেই নির্বাচনে জিততেও হিরো আলমের মতো একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে মারধর করতে হলো কেন? এটি অতি উৎসাহীদের কাজ নাকি এই ঘটনাটি ঘটিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হলো, হিরো আলমের মতো লোকও এখন আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী?