Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

রাজনৈতিক ঐকমত্যই হোক জাতীয় নির্বাচনের পথরেখা

Icon

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৩, ১৪:১৪

রাজনৈতিক ঐকমত্যই হোক জাতীয় নির্বাচনের পথরেখা

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি গতিশীলতার মাঝে আছে বলে আমি মনে করি। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো কর্মকৌশল ও কর্মপন্থা গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল ঘুরে গেছে। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে আলাপ করেছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী এবং দায়িত্বশীলদের সঙ্গেও তাদের আলাপ হয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তারা সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক মহলের সামনে ব্যাখ্যা করেছে। অর্থাৎ নির্বাচনকে ঘিরে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

জনমনে এতদিন রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ নিয়ে একটা উদ্বেগ কাজ করছিল। তারা মনে করছিল যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর যথাযথ সংলাপ প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। কিন্তু একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে কিছুদিন আগেই সংলাপের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দপ্তর ও বাসভবনে সরকারের প্রতিনিধিরা সংলাপে বসেছে। আবার প্রধান বিরোধী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাও সংলাপে বসেছে। সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলগুলো একসঙ্গে সংলাপে বসেছে। সুতরাং বলা যায় যে, সংলাপ শুরু হয়েছে। এখন এই সংলাপের পরিণতি কোনদিকে যাবে, সেটার জন্য সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা প্রতীক্ষা করছি। 

আগামী জাতীয় নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হয়, তার জন্য বড় ধরনের জনপ্রত্যাশা রয়েছে। তাই এই সংলাপগুলোর গতিমুখ যেন সেদিকেই ধাবিত হয়, সেটা সবাই চাইছে। সাংবিধানিক পন্থা অনুসরণ করে যথাযথ গণতান্ত্রিক পন্থায় যাতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেটা সবাই চাইছে। অর্থাৎ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করুক, জনগণ সেই প্রতীক্ষায় রয়েছে। 

এখন বিরোধী দল বিএনপি তাদের সমাবেশে সরকারের পদত্যাগ চেয়ে এক দফা দাবির ঘোষণা দিয়েছে। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তারা ৩১ দফা পেশ করেছে। আমার মনে হয়, এ দাবিগুলো নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বের কিছু বিভ্রান্তি আছে। যে কোনো রাজনৈতিক দলের দাবি ঘোষণার সময় নিজেদের মধ্যে আলাপ করে বিভ্রান্তি দূর করতে হবে। আর এই দাবির প্রতি জনগণের সমর্থন আছে কি না, সেটা সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে হবে। এখন জনগণ কোন দফাকে সমর্থন করবে? এক দফা না কি ৩১ দফা? আবার আওয়ামী লীগ যে কথা বলছে, তার প্রতি জনগণের কতটুকু সমর্থন আছে? অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির প্রতি কতটুকু জনসম্পৃক্ততা রয়েছে, সেটাই সবার আগে দেখতে হবে। বিদেশিরাও বলে গেছে যে এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কতটুকু জনসমর্থন আছে, সেটার গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য তারা জনসংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে গেছেন। কিন্তু আমরা বিদেশিদের এই প্রক্রিয়ায় জড়াব না। কেননা এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে উন্নয়ন সহযোগী এই সব দেশের মতামতকে একদম উড়িয়েও দেওয়া যাবে না। 

বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের দেশে এক ধরনের সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। নির্বাচন আসলেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে কিছু দেশ উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করে থাকে। এই বিষয়টি খূব একটা দোষের নয়। কারণ পৃথিবীটা এখন একটা গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। তাই আমাদের দেশে কোনো ঘটনা ঘটলে সেটার প্রভাব সেসব দেশে পড়তে পারে। আবার সেসব দেশের কোনো ঘটনা আমাদের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তবে নির্বাচন আসলেই অতিরিক্ত বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতাও শুভকর নয়। অবশ্য এই প্রবণতা যেহেতু দীর্ঘদিনের তাই সেটাকে একদিনে কমানোও যাবে না। তবে এই প্রবণতাকে কমিয়ে আনতে হবে। দেশের নির্বাচন, মানবাধিকারের বিষয়ে সরকার, বিরোধী দল, প্রশাসন ও সিভিল সোসাইটি যদি জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে বিদেশিদের এসব চাপ তেমন একটা কার্যকর হতে পারবে না। এখানে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিছু রাজনৈতিক দল এই বিদেশমুখিনতার প্রবণতা থেকে সরে আসলো, কেউ কেউ আবার বিদেশিদের দ্বারস্থ হলো, তাহলে তো প্রবণতা কমানো যাবে না। আমরা নির্বাচন সুষ্ঠু চাই, কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশও সৃষ্টি করার দায়িত্ব রয়েছে। সেখানে নিজেদের রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি করাটাই সবার আগে দরকার। 

এখন নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন কর্মসূচি দিতে থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই কর্মসূচি যেন কোনোভাবেই সহিংস না হয়ে ওঠে। যে কোনো কর্মসূচি, যে কোনো সমাবেশের শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরই বেশি বর্তায়। রাজনৈতিক দলগুলো এখানে কোনো কর্মসূচি বা সমাবেশ সহিংস না হয়ে ওঠে, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তারা তো প্রজাতন্ত্রেরই কর্মচারী। তাদের থেকে আমাদের নিজের দায়িত্বই বেশি। এখন আমার বাড়িতে যদি কোনো সমাবেশ আয়োজন করি, তাহলে সেই সমাবেশের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তো প্রথমে আমার নিজের। তারপর তো আমি অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলে থাকব। এখন এই সমাবেশ যাতে শান্তিপূর্ণ থাকে, সেটার মূল দায়িত্ব আমার নিজের। সেই দায়িত্ব পালনে যদি আমরা সক্ষমতা না দেখাতে পারি, তাহলে স্বাধীন দেশের নেতৃত্ব হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা থেকে যায়। 

আর সামনের জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরেপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে নির্বাচন কমিশনের ওপর। রাজনৈতিক দল এবং প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করার দায়িত্ব রয়েছে। এখানে যদি কোনো ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে সেখানে কোনো অ্যাকশন নেওয়ার এখতিয়ারও আছে নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে তাদের আইনগুলোকে অনেক শক্তিশালী করেছে। এখন নির্বাচন কমিশন যদি তাদের আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ ঘটায়, তাহলে সুষ্ঠু ও অবাধ জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া সম্ভব হবে। 

আমরা কোনোভাবেই চাইব না যে, নির্বাচনকে ঘিরে কোনো সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিশেষ করে ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনীতি বেকায়দায় রয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে এখন যদি সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাহলে দেশের সমস্ত অগ্রগতি হুমকিতে পড়তে পারে। আমরা বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করে। তাই তারা এমন কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে না, যাতে দেশের জনগণ দুর্ভোগে পড়ে। সর্বোপরি, তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও নিজেদের মধ্যে আন্তরিক সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন আগামীতে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরেপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবে, সেটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫