Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

দুর্গতির গোড়া ‘ঋণপ্রবণতা’

Icon

শাওন সরকার

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৩, ১৩:২১

দুর্গতির গোড়া ‘ঋণপ্রবণতা’

শাওন সরকার।

দেশে ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ প্রতিটি পরিসরে রয়েছে ঋণপ্রবণতা। নগদ টাকায় পণ্য ক্রয় করলে তৎক্ষণাৎ হিসাব চুকে যায়। কিন্তু ঋণের মাধ্যমে পণ্য কিনলে সেটা হয়ে যায় একটি অমীমাংসিত চুক্তি। কারণ ঋণ হচ্ছে ঋণদাতার পুঁজি এবং ঋণগ্রহীতার আগাম সুবিধা। যে ঋণে মেয়াদ যত বেশি তাতে সুদ তত বেশি। যে অর্থপ্রাপ্তি সাময়িকভাবে শ্রমসাধ্য নয় তা খরচ করতে প্রাথমিকভাবে আনন্দ হয়। তাই যে একবার ঋণ নেয় সে বারবার ঋণ নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে সমাজের উঁচুনিচু সকল স্তরে ঋণের অর্থনীতি টিকে থাকে।

দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশই ক্ষুদ্র ঋণে নিমজ্জিত থাকে। গ্রামের গরিব বা শহরের খেটে খাওয়া অনেককেই দেখা যায় ঋণ করে ফ্রিজ, টিভি ইত্যাদি বিলাসী পণ্য কিনতে। যাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সামান্য জমি আছে কিন্তু জীর্ণ ঘরে থাকে, তারা একটু ভালো পাকা বাড়ির আশায় ঋণ নেয়। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই সাধ ও সাধ্যের বিরাট পার্থক্য থেকে যায়। ফলে নির্মাণ শুরু হয় ঠিকই কিন্তু শেষ হয় না। কিছু বছর পর যদি তাদের সামর্থ্য হয়ও বাড়িটি ব্যবহারোপযোগী করার, তত দিনে ইটে শ্যাওলা বা রডে মরিচা পড়ে তা মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়ে। সংস্থার তৈরি সাফল্যের যে রিপোর্ট ডোনার এজেন্সির কাছে পৌঁছায়, তাতে বাদ পড়ে যায় এসব গল্প, যার বেশিরভাগই ব্যর্থ। শুধু দরিদ্র নয়, মধ্যবিত্তদের মধ্যেও ঋণ করে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য যেমন- এসি, গাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যদি কেনার প্রবণতা আছে। যার প্রধান কারণ ক্রেডিট কার্ড। ক্রেডিট কার্ডের আবেদনের সময় ব্যক্তির সব সামাজিক ও অর্থনৈতিক তথ্য সংস্থার কাছে চলে যায়। সংস্থার সঙ্গে মূলত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রেতাদের চুক্তি থাকে যারা মানুষের প্রতিযোগিতামূলক লোভ ও ভোগবাদী প্রবৃত্তিকে ভিত্তি করেই ব্যবসা করে। যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নগণ্য শর্ত তারা বিজ্ঞাপনের সময় উপেক্ষা করে সেগুলোই তাদের লাভের উৎস। বিভিন্ন লোভনীয় পণ্যের অফার, ছাড়, ফ্রি, পুরস্কার ইত্যাদির ফাঁদে ফেলে সাধারণ মানুষকে আকর্ষণীয় সুযোগ গ্রহণ করতে বাধ্য করে যা নগদ বা সঞ্চিত টাকায় কিনতে হলে মানুষ কখনোই কিনত না। 

জীবনযাত্রার মান একবার বেড়ে গেলে তা আর নামানো যায় না। ফলে সামর্থ্যরে বাইরে গিয়ে বেশি ভোগ করার অভ্যাস তৈরি হয় এবং অভ্যাস ধরে রাখতে পরবর্তী সময় মানুষ চার্জ দিয়ে হলেও কার্ডটি ব্যবহার করে। বেশিরভাগ সময়ই গ্রাহকরা ‘মিনিমাম ডিউ পেয়েবল’ জাতীয় বার্তায় সুদের হিসাব রাখে না। উপেক্ষিত সেই শর্তের ষড়জালে আটকা পড়েই তারা বিন্দু বিন্দু থেকে সিন্ধু পরিমাণ আকণ্ঠ ঋণে নিমজ্জিত হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে জরিমানা যুক্ত হতে থাকে। কিন্তু অবস্থা যে কোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে। মানুষটি অসুস্থ হতে পারে, চাকরি চলে যেতে পারে, ব্যবসায় বড় ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু কিস্তিতে কোনো মাফ নেই। ব্যবহার না করলেও টাকা আদায় হবেই। 

ঋণের মাধ্যমে ব্যবসার পরিণতি ইভ্যালির ঘটনার মাধ্যমে কিছুটা প্রমাণ হয়েছে। এর বহু আগে আরও ভয়াবহ ঘটনার দৃষ্টান্ত আছে। আঠারোশ শতকে ইংরেজ সাউথ সি কোম্পানিতে প্রথমে ধনী ব্যক্তিরা শেয়ার কিনত। এটা ছিল ব্যাপক জনপ্রিয় কোম্পানি যেখানে সব ধরনের স্টক বিক্রি হতো আর শেয়ারের মূল্য দিন দিন বৃদ্ধি পেত। রাজা জর্জ, আইজ্যাক নিউটন, আলেকজান্ডার পোপ এবং অনেক বুদ্ধিজীবীও কিনত। পরবর্তীকালে ধনী গরিব সবাই কিনত। তখন এটা ছিল ঋণকে সম্পদে পরিণত করার গোপন সূত্র। কিন্তু ১৭২০ সালে বাবল আইন পাস করার পর ঋণগ্রস্ত মানুষ খুব বিপদে পড়ে যায়। যখন নগদ অর্থের সংকটে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন দেখা গেল প্রচুর মানুষ তাদের সারাজীবনের সম্পদ হারিয়েছে। শেষমেশ ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল আত্মহত্যার ঢেউ। 

মূলত ঋণের মাধ্যমে একজনের ব্যয়, চক্রাকারে আরেকজনের আয় সৃষ্টি করে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখে। তবে ঋণের ক্ষেত্রে এটি একটি অবভাসিক ধারণা অর্থাৎ একটি সংখ্যামাত্র যার কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মূল্য নেই। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ কোনো ব্যক্তিকে ব্যাংক থেকে দেওয়া হলে তা মূলত ওই ব্যক্তির। জনগণের জমানো ব্যাংকে সংরক্ষিত টাকাও অবভাসিক ধারণামাত্র। ঋণের মাধ্যমে যখন কিছু মানুষের খরচ বাড়ে, তখন কিছু মানুষের আয় বাড়ে, দ্রব্য বা সেবার মূল্য বাড়ে। তখন উৎপাদনের চেয়েও চাহিদা ও খরচ বাড়ে ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। তখন খুব কম মানুষের ঋণ গ্রহণের যোগ্যতা থাকে। ঋণের মাধ্যমে খরচ কমার ফলে কিছু মানুষের আয়ও কমে যায়। তখন আবার মুদ্রা সংকোচ বা মন্দা দেখা দেয়। তখন ব্যাংক আবার সুদের হার কমিয়ে দেয়। মূলত অর্থনৈতিক কর্মকা- নির্ভর করে ঋণ গ্রহণের যোগ্যতা ও দাতার ক্ষমতার ওপর। যারা কর্মঠ ও বুদ্ধিমান তারা ঋণ করে তাদের উৎপাদনশীলতা ও উপযোগিতা বাড়ায়। কিন্তু তাদের সংখ্যা কম। বেশিরভাগই কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের চক্রে জড়িয়ে পড়ে। ফলে দেশের সার্বিক ঋণের বোঝা বাড়ে। ব্যাংক খালি হয়ে যায়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে। কেউ ঋণ নিতে পারে না, ফলে সম্পদ বিক্রি শুরু হয়। স্টক মার্কেট, রিয়েল এস্টেট মার্কেট ধসে পড়ে। জামানতের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতারা বিপদে পড়ে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়। আয় কমতে কমতে এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে অর্থনৈতিক কর্মকা- চালানোর আর কোনো উপায় থাকে না। উল্লেখ্য, আমেরিকায় প্রচুর মানুষ দীর্ঘমেয়াদি ঋণে নিমজ্জিত থাকে, যেখানে সার্বিকভাবে আসলের চেয়ে সুদ অনেক বেশি এবং অনেক মানুষ মানসিক চাপে বিকারগ্রস্ত হয়ে যায় ।

এ ধরনের অবস্থা থেকে বাঁচার ৪টি উপায় আছে।

 ১. খরচ কমানো ২. ঋণ কমানো ৩. সম্পদের পুনঃবণ্টন 

৪. নতুন টাকা ছাপানো। 

স্পেন, ইতালি ও জাপান একসময় এ অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে ঋণের কিছু অংশ মওকুফ করা হয়ে থাকে। কিন্তু ঋণ পুনঃমার্জনের ফলে সম্পদের মূল্য ও আয় আরও কমে যায়, কারণ তখন আবার কিছু মানুষ ঋণগ্রহণের যোগ্য হয়ে ওঠে এবং সার্বিক ঋণের চাপ বেড়ে যায়; যা মুদ্রাস্ফীতিকে উৎসাহ দেয়। এ ক্ষেত্রে আয় কমে যাওয়া এবং বেকারত্বের ফলে জনগণের দেওয়া ট্যাক্সও কমে যাওয়ার ফলে সরকারের রাজস্বে টান পড়ে। আবার বেকারত্ব কমানোর জন্য সরকারের নতুন কর্মসংস্থানের স্থান, সুযোগ ও সক্ষমতা তৈরির পদক্ষেপ নিতে খরচ বাড়ে। তখন বাজেট ঘাটতি শুরু হয়। ঘাটতি পূরণ করতে সরকারকে হয় ট্যাক্স বাড়াতে বা বৈদেশিক ঋণ নিতে হয়, অথবা এমন কোনো পলিসি নিতে হয় যাতে সম্পদশালীদের বেশি ট্যাক্স দিতে হয়। তখন এই দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থায় ধনীরা সংকটে পড়ে। এই ডিপ্রেশনের ফলে জনগণ বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে। 

যখন সুদের হার শূন্য হয়ে যায় তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপাতে বাধ্য হয়। শূন্য থেকে নতুন টাকা যখন বিনিময় ছাড়াই বাজারে চলে আসে, সেটা মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করতে পারে। মানুষ এসব টাকা নিয়ে নতুন সম্পদ ও বন্ড ক্রয় করে যা ২০০৮ সালে আমেরিকায় ঘটেছিল। এ সময় সম্পদের মূল্য বাড়লে তারাই শুধু উপকৃত হয় যাদের সম্পদ আছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সরকারের বন্ড কেনে এবং মানুষের কাছ থেকে পণ্য ও সেবা ক্রয়ের মাধ্যমে তাদের হাতে টাকা ছাড়ে তবে মানুষের ঋণের বোঝা ধীরে ধীরে কমতে পারে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি কর্মসংস্থান তৈরির পদক্ষেপের নিমিত্তে সরকারকে নতুন টাকা দেয়, তাহলে মানুষের আয় বাড়তে পারে এবং সরকারের ঋণের বোঝা কমতে থাকে। 

টাকা ছাপানো বেশ সহজ। দেশের মোট টাকার পরিমাণ দেশের মোট সম্পদের সমান হওয়ার কথা। নতুন টাকা ছাপালে একই পণ্য আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়। এবার কিছু মানুষ যদি প্রচুর টাকা ঋণ নিয়ে ডলারে কনভার্ট করে দেশের বাইরে সম্পদ গড়ে বা খরচ করে অথবা সামান্য টাকার ব্যবসা করে ঋণখেলাপি করে তবু ওই টাকার হিসাব দেশে থাকে। অর্থাৎ ওই টাকা বস্তুত দেশে নেই কিন্তু হিসাবে আছে। এমন অবস্থায় টাকা ছাপালে মুদ্রাস্ফীতি হয়। তাই টাকা ছাপানোর আগের সময়টা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এখানে সঠিক ভারসাম্য দরকার। 

টাকা ছাপানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে খুব সূক্ষ্মভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যাতে দেশের আয় বৃদ্ধির হার যেন দেশের সার্বিক ঋণের ওপর ধার্যকৃত সুদের হারের চেয়ে সামান্য বেশি হয়। অর্থাৎ আয় যেন ঋণের চেয়ে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য জার্মানি একসময় বেশ ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যাতে আয় বৃদ্ধির হার ধীরে ধীরে বাড়ে এবং ঋণের বোঝা কমতে থাকে। কিন্তু দ্রুত আয় বাড়লে ঋণগ্রহণও দ্রুতগতিতে বাড়ে এবং ঋণের বোঝা বেড়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের চক্র শুরু হয় যেটা সাম্যাবস্থায় আসতে আরও অনেক বছর লেগে যায় তাই তিনটি ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। 

১. ঋণকে আয়ের চেয়ে বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না, ২. উৎপাদনের চেয়ে বেশি আয় হতে দেওয়া যাবে না, ৩. উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সবরকম পদক্ষেপ নিতে হবে।

ইতোমধ্যে উৎপাদনশীলতার ব্যাপারে দেশের মানুষকে সচেতন হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই এই সংকট মোকাবিলায় অলসতা ও ভোগবিলাসিতার পৃষ্ঠপোষক ‘ঋণ প্রবণতা’ থেকে মুক্ত হওয়া আবশ্যক। কর্মমুখী শিক্ষা, উৎপাদনশীলতা, ব্যবসা, সৃষ্টিশীল শিল্প ইত্যাদির প্রতি তৎপরতা বৃদ্ধি করলেই শুধু ইতিবাচক অর্থনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব।

লেখক: স্থপতি

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫