Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ডেঙ্গু মহামারি নিয়ন্ত্রণে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

Icon

মুশতাক হোসেন

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৩, ১৩:১২

ডেঙ্গু মহামারি নিয়ন্ত্রণে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

মুশতাক হোসেন।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ এখন বাড়তির দিকে। গত বছর মৃত্যুর সংখ্যা বেশি ছিল। এ বছরও মৃত্যুর সংখ্যা দুইশ ছাড়িয়েছে। মনে রাখা দরকার, স্বাভাবিকের তুলনায় ডেঙ্গু রোগী যদি হঠাৎ করে বেড়ে যায়, তখন সংক্রমণ বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন হলে তাকে আমরা প্রাদুর্ভাব বলি। আর অনেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে তাকে আমরা মহামারি বলি। নিশ্চিতভাবে এটাকে মহামারি বলা যায়।

ডেঙ্গুর প্রকোপ শুধু শহরে সীমাবদ্ধ নেই; গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ গ্রামাঞ্চলেও শহরের মতো স্থাপনা ও অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে এখন। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে ফুল বা ফলের টব, যত্রতত্র ফেলে রাখা ডাবের খোসায় পানি জমছে। অনেকে বোতলজাত পানি অর্ধেক পান করে বোতলটি ফেলে দেন। টবে কিংবা বোতলের পরিষ্কার পানিতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা সহজেই বংশবিস্তার করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ৭০-৮০ শতাংশ এলাকায় এডিস মশা ছড়িয়ে পড়েছে। এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য দায়ী উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ডেঙ্গু মহামারি রোধ করা যাবে না।

মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু এখন আর উচ্চবিত্ত তথা বড় দালানে বসবাস করা বাসিন্দাদের রোগ নয়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এডিস মশা জন্মানোর সুযোগ বেশি থাকায় এতে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তরাও ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছে। একটি সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরীর সব লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে। এই আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না। উদাসীন থাকলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।

একসময় মনে করা হতো, বর্ষা এলেই ডেঙ্গু চোখ রাঙায়। কিন্তু ২০২২-২৩ সালে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাব, সারা বছর কমবেশি ডেঙ্গুর প্রবণতা ছিল। তাই এটি এখন আর মৌসুমি রোগ নয়। শীতকালেও যেভাবে এডিস মশার প্রজনন লক্ষ্য করা গেছে, তাতে এটি স্পষ্ট। এখন আমাদের দায়িত্ব মশা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা।

এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য বৃষ্টি একমাত্র উৎস নয়। এ কারণে পরিষ্কার পানি জমতে দেওয়া যাবে না। নির্মাণকাজ ও কৃষিকাজে পরিষ্কার পানি ব্যবহৃত হয়। এসব পানি কোথাও জমে থাকার সুযোগ পেলেই সেখানে এডিস মশার লার্ভা দেখা যায়। তাই শ্রমিক ও কৃষকদের সতর্ক থাকতে হবে। কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর কোথাও পানি জমে থাকতে দেখলে তা অপসারণ করতে হবে। অন্যথায় জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে স্থানীয়দের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ। মশক নিধনের দায়িত্ব এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত। বাস্তবতা হলো, একটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মশক নিধন, বিশেষ করে এডিস মশা নিধন করা সম্ভব নয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্য, কৃষিসহ যেসব মন্ত্রণালয় এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে।

আমাদের দেশে ডেঙ্গুর চারটি ধরন এই মুহূর্তে সক্রিয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধরনে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ভারতে পঞ্চম ধরন শনাক্ত হয়েছে। আমাদের দেশেও তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয়বার যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন, তাদের রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেশি। এ জন্য দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্তদের ব্যাপারে আলাদা যত্ন নিতে হবে।

এখন জরুরি ভিত্তিতে দুটি কাজ করতে হবে। যেসব জায়গায় ডেঙ্গু হচ্ছে সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। যেখানে জ্বরের রোগীরা এসে টেস্ট করাতে পারবে। সরকার বিনা পয়সায় তাদের টেস্ট করাবে। তিনটি টেস্ট করতে হচ্ছে একসঙ্গে। একেকটা ৫০ টাকা করে হলেও ১৫০ টাকা ব্যয় করতে হয়। এটি জনগণের ওপর চাপ হতে পারে। টেস্ট করার পর যেসব রোগীর অবস্থা খুব খারাপ নয়, মোটামুটি মৃদু লক্ষণের রোগী, তারা যেন মশারির নিচে থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে।

যাদের সক্ষমতা আছে, তারা বাসায় মশারির নিচে থাকবে আর যাদের সক্ষমতা নেই তারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যাবে। গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিকে থাকার ব্যবস্থা না থাকলেও উপজেলা হাসপাতালে আছে। শহরে সেরকম ব্যবস্থা নেই। যারা বাসায় থাকতে পারবে না, তাদের কমিউনিটি ক্লিনিকে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে যাদের ডেঙ্গুর লক্ষণ রয়েছে, বাচ্চা বা গর্ভবতী নারী, বয়স বেশি, দীর্ঘদিন ধরে অন্যান্য রোগে ভুগছেন, তাদের অবজারভেশনের জন্য হাসপাতালে রাখতে হবে।

মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল না হয়ে যদি এটা অন্য কোনো হাসপাতাল হয় যেমন- সিটি করপোরেশন হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল হলেও চলবে। এতে তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে। অবস্থা গুরুতর হলে তাদের সরাসরি মেডিক্যাল কলেজে পাঠাতে হবে।

যাদের অবস্থা আরও খারাপ, তারা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাবে। স্তরভিত্তিক চিকিৎসা দিলে একদিকে হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে, অন্যদিকে আমরা রোগীকে মশারির নিচে রাখতে পারছি। আরেকটি বিষয় হলো, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা দরকার। এতে অনেক মানুষ প্রয়োজন হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ১১ জন মানুষ। এটা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। প্রতি পাড়ায় স্বেচ্ছাসেবকসহ কাজ করতে হবে। তাদের কাজ হবে রোগী খুঁজে বের করা। রোগীদের খুঁজে বের করে তাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাবে। কোথায় পানি জমতে পারে সেটিও তারা স্থানীয় মানুষদের সাহায্য নিয়ে খুঁজে বের করবে। যেখানে পানি পরিষ্কার করা যায় না, সেখানে তারা কীটনাশক প্রয়োগ করবে। পানি পরিষ্কার না করে কীটনাশক প্রয়োগ করলে তা ফলপ্রসূ হবে না। আগে পরিষ্কার তারপর কীটনাশক। ম্যালেরিয়া নির্মূলের জন্য ৬০-এর দশকে ম্যালেরিয়া ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছিল, যা পরে আইইডিসিআরে রূপান্তর হয়। মশা যেন না ছড়ায় সে ব্যবস্থা নেবেন জনস্বাস্থ্য কীটতত্ত্ববিদরা। টানা পাঁচ বছর এ কাজগুলো করতে হবে, তাহলে কলকাতা শহরের মতো আমাদের শহরগুলো ডেঙ্গুমুক্ত হবে। গ্রামগুলোকেও ধীরে ধীরে এডিস মশা মুক্ত করতে হবে।

সিটি করপোরেশনের প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্রয়োজন। এখানে বিনামূল্যে রোগীদের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু শনাক্ত হবেন; কিন্তু ‘বিপদের চিহ্ন’ নেই তাদের সরাসরি বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া যাবে না। যদি তারা বাড়ি গিয়ে মশারির নিচে থাকার ব্যবস্থা করতে পারবে, তাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের নজরদারি নিশ্চিত করেই কেবল বাড়ি পাঠানো যেতে পারে। বাকিদের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক হাসপাতালে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে যাদের অবজারভেশনে রাখতে হবে, তারা হলো ঝুঁকিপূর্ণ বয়সী জনগোষ্ঠী। তাদের জন্য উপজেলা হাসপাতাল বা জেলা হাসপাতালে নিতে হবে। রোগীদের ভেতরে যাদের অবস্থা বেশি খারাপ এবং রক্তক্ষরণের আশঙ্কা আছে তাদের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের রোগীরা মেডিক্যাল কলেজে ভিড় করলে সুষ্ঠু চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। তিন স্তরে রোগী ব্যবস্থাপনা করলে আমরা লাভবান হব।

দেশে এতদিন ধরে ডেঙ্গু মোকাবিলায় যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটা অনেকটা গতানুগতিক ব্যবস্থায় নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটা হয়তো সাময়িক একটা রোগ, কিছুদিন পরেই চলে যাবে। ফলে কার্যকর বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো ব্যবস্থা কোথাও নেওয়া হচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গু রোগটা একেবারে জেঁকে বসেছে। যে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার, সেটা হচ্ছে না। এটা যে একটা মহামারি, সেরকম করে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

পাশের দেশ ভারতে আমাদের মতোও একই জলবায়ু কিন্তু সেখানে ডেঙ্গুর এমন প্রকোপ নেই। তারা অনেক দিন চেষ্টা করে এই জায়গায় এসেছে। সেখানকার সিটি কাউন্সিলর থেকে শুরু করে মেয়র পর্যন্ত সব সাধারণ মানুষ একসঙ্গে কাজ করেছে। তারা চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল, পাঁচ বছরের মধ্যে এডিস মশা নির্মূল করবে। আমরাও ষাটের দশকে ম্যালেরিয়া নির্মূল করেছি। এর আগে কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণে এনেছি। ফাইলেরিয়া নির্মূল করেছি। কাজেই ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশাকেও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। সমন্বিত পরিকল্পনা এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় জরুরি, যারা দায়িত্ব গ্রহণ করবে, তাদের যথেষ্ট অর্থ দিয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। জনগণকে আলাদা করে ভাবলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। শুধু সড়কে কীটনাশক ছড়িয়ে কাজ হবে না। আমাদের নজরদারি বাড়াতে হবে। কোথায় কতজন ডেঙ্গু রোগী আছে, তা বের করতে হবে। আমাদের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা বছরে তিনবার মশার সার্ভে করে। এটা সবসময় করতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, মশা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। সার্ভের মাধ্যমে এটি জানতে হবে। সর্বোপরি, সমন্বিত উদ্যোগ আর কার্যকরী কর্মকৌশল ছাড়া ডেঙ্গুর ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

লেখক: সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫