উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ সংকট

মো. হায়দার খান সুজন
প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২০, ১২:৪৪

বাঙালি জাতির জাতীয় জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রাপ্তির সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের অব্যবহিত পূর্বের বছরে আমরা পালন করছি সেই মহান স্থপতির জন্মশতবর্ষ। যিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় জেল খেটে কাটিয়েছেন জাতির মুক্তির আশায়। যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন নিপিড়ন-নির্যাতনমুক্ত, দুঃখ-ক্লেশহীন, স্বাধীন, সার্বভৌম ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, স্বনির্ভর বাংলাদেশের। আমরা উদযাপন করছি মুজিববর্ষ।
ব্রিটিশ শাসনোত্তর চব্বিশ বছরের শোষণ-নিপীড়নে ক্লিষ্ট যে দেশের জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি সত্তরের দশকেও ছিল ৩.৭ তা সর্বশেষ দশকে উন্নীত হয়েছে ৬.৬ এ। পঁচাত্তর পরবর্তী একুশ বছরের অমানিশার পরেও নব্বইয়ের দশক থেকে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি প্রতি দশকে বেড়েছে এক শতাংশ হারে। সত্তরের দশকের ৭১ শতাংশ দারিদ্র্যের হার এখন বিশ শতাংশেরও নিচে। মানুষের গড় আয়ু পার করেছে সত্তরের গণ্ডি। শিক্ষার হার বেড়েছে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতাও বেড়েছে অনেক। দেশ এগিয়ে চলছে উন্নত সমৃদ্ধশালী অর্থনীতির বিনির্মাণে। যার অবকাঠামোর উন্নয়নে গ্রহণ করা হচ্ছে বড় বড় মেগা প্রকল্প। চোখের সামনেই দিনে দিনে বাস্তব হয়ে উঠছে স্বপ্নের পরিকল্পনা সমূহ। ফলস্বরূপ স্বীকৃতি এসেছে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদার।
তবে মাত্র এক-দুইটি সেক্টরের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল অর্থনীতির উন্নয়ন সবসময়ই বেশ ঝুঁকির মধ্যে থাকে। যেকোনো ধরনের দুর্যোগ তাকে ব্যাপকভাবে পিছিয়ে দিতে পারে। পপুলেশন ডিভিডেন্টের সুবিধা সংবলিত বাংলাদেশের অর্থনীতিও অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে আছে তৈরি পোশাক শিল্প এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উপর। অন্য সেক্টর সমূহ এখনো বিকাশমান পর্যায়েই রয়েছে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়ার সাথে সাথে বেড়ে চলেছে আয় ও সম্পদের বৈষম্যও। জাতি দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অভিশাপ মুক্ত হলেও দুর্ভাগ্যে পতিত হয়েছে অতিধনী উৎপাদনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে। বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিকে হটিয়ে দিয়েছে ধনকুবের উৎপাদনের হারে। যদিও ‘অসমতা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়’ ধারণার প্রথম প্রকাশ করেন পুঁজিবাদের সমর্থক, মার্কিন অর্থনীতিবিদ কাজনেট তার ‘ইনভার্টেড ইউ হাইপোথেসিস’ বা ‘কাজনেট কার্ভ হাইপোথেসিস’ তত্ত্বে। কিন্তু তার সে তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে ‘নায্যতাসহ প্রবৃদ্ধি’ অর্জনের মাধ্যমেই উন্নতি করছে এশিয়ারই দুটি পুঁজিবাদী অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়া এবং দুটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চীন ও ভিয়েতনাম।
সমসাময়িককালে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি ছাড়াও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে সমন্বয়হীনতা, সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ আশানুরূপভাবে না বাড়া, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণসহ বিভিন্ন অস্থিরতা, সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত বিশাল সুনীল অর্থনীতির বাস্তবিক ব্যবহার শুধুমাত্র মন্ত্রণালয়াধীন একটি সেল গঠন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকা, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে গবেষণামুখি করার চ্যালেঞ্জ, গবেষণাকে উদ্ভাবনের পর্যায়ে নিয়ে তার বাস্তবিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর চ্যালেঞ্জ ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতির কালো থাবা সত্ত্বেও উন্নয়নের পথে দৃপ্ত প্রত্যয়ে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের সামনেই এখন কভিড-১৯ সংকট।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে একে একে লক-ডাউন হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যার ব্যতিক্রম নয় এখন বাংলাদেশেও। যার প্রভাবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প ও বৈদেশিক মুদ্রার আয়। সংক্রমণের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তথা উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থাও। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে দেশ হয়তো অচিরেই মুক্তি পাবে কিন্তু এর অর্থনৈতিক আঘাত কতটা ব্যপক হবে তা নির্ভর করবে দেশের সুদূরপ্রসারি নীতি-কৌশল ও কূটনৈতিক তৎপরতার উপর।
করোনাভাইরাস উত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে দেশের পোশাক শ্রমিকদের। বাঁচাতে হবে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও। আপদকালীন সময়ের সংকটকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা সুযোগ সন্ধানীদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রাখতে হবে। সংকটের উত্তোরণে সমন্বয় ঘটাতে হবে সরকার, জনগণ ও দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থার।
এই সকল ক্ষেত্রেই সমম্বয় ঘটিয়ে উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ এবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রেও রোল মডেল হয়ে উঠবে সেই প্রত্যাশায় সকলকে জানাচ্ছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সুস্থ ও নিরাপদে থাকতে সকলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোয়ারেন্টিন সম্পর্কিত নিয়মসমূহ মেনে চলুন। সংকট কাটিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক সমৃদ্ধির উচ্চতর সোপানে।
লেখক: মো. হায়দার খান সুজন
প্রভাষক, ডেভেলপমেন্ট এন্ড পোভার্টি স্টাডিজ বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।