Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

ছাপানো টাকায় সরকারের ঋণ

Icon

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১১:০৩

ছাপানো টাকায় সরকারের ঋণ

জিয়াউদ্দীন আহমেদ। ফাইল ছবি

আমার ভাতিজা শামীম আহমেদ জিতু আমাকে শিরোনামোক্ত বিষয়ে একটি কলাম লেখার জন্য অনুরোধ করে। সে কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য নিয়ে পিএইচডি করছে; এক সময় বাংলা ইংরেজি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখত, এখন কানাডা থেকে নিয়মিত দৈনিক জনকণ্ঠে লেখে। আমি বহু বছর টাকশালের দায়িত্বে ছিলাম বিধায় সে এই কলাম লেখার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে।

বাংলাদেশের নামকরা অর্থনীতিবিদদের অনেকে টাকা ছাপানো বন্ধ করতে বলেছেন; তারা বলছেন, ছাপানো টাকা না থাকলে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাবে না। সম্ভবত কথাটি রূপকার্থে প্রয়োগ করা হচ্ছে। কারণ অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর সঙ্গে সরকারের ঋণ নেওয়ার সম্পর্ক একেবারেই নেই। টাকা ছাপানো হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক চাহিদার ভিত্তিতে; চাহিদা নিরূপিত হয় প্রয়োজন এবং অভিজ্ঞতার আলোকে। 

পুরাতন জরাজীর্ণ নোট প্রায় প্রতিদিন ধ্বংস করা হয়, ধ্বংসপ্রাপ্ত নোট নতুন ও প্রচলনযোগ্য নোট দিয়ে প্রতিদিন প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি প্রতিবছর সম্প্রসারণ হচ্ছে, পরিধি বড় হচ্ছে- অর্থনীতির সম্প্রসারণই নতুন অর্থ তৈরি করছে এবং এজন্যও প্রতিবছর অতিরিক্ত নোটের প্রয়োজন হয়। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নোটের সরবরাহে যাতে কখনোই ঘাটতি না হয় সেজন্য নতুন নোটের মজুদ গড়ে তোলা হয়। ক্লিন নোট পলিসির ওপর জোর দেওয়া হলে প্রচলনযোগ্য পুরাতন নোটও আর বাজারে ছাড়া হয় না, নতুন নোট বেশি ছাড়া হয়। নোটের চাহিদা নিরূপণে সরকারের ঋণের পরিমাণ আলাদাভাবে কখনো হিসাবে আনা হয় না। 

দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বা টাঁকশাল তার সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করে টাকা বা নোট ছাপায়। সবগুলো মেশিন ২৪ ঘণ্টা চালিয়েও টাঁকশালের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। ১৯৮১ সালে তৈরি ৫টি মেশিন দিয়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৫ বছর ধরে নোট উৎপাদন করা হয়েছে, একটি নোট মুদ্রণে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মেশিন ব্যবহৃত হয়, ২০০ টাকা মূল্যমানের নোটের জন্য লাগে চারটি মেশিন। নোটের কাঁচামাল আসে বিদেশ থেকে; কিন্তু কাঁচামালের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান মাত্র দুই-তিনটি। প্রাকৃতিক বা মনুষ্য সৃষ্ট কোনো কারণে কাঁচামাল সংগ্রহ বিলম্বিত হলে নোট উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং এই আশঙ্কায় নতুন নোট সব সময় ভল্টে মজুদ থাকে। মজুদ থাকে বিধায় সরকারকে দেওয়ার জন্য আলাদাভাবে নোট ছাপানোর প্রয়োজন হয় না। সরকার শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় না, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেও নেয়। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ ছাপানো টাকা নয়। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের অধিক মাত্রায় ঋণ গ্রহণের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহকে সংকুচিত করার সম্ভাবনা বাড়ে। 

সরকারের বাজেট ঘাটতি কত, কীভাবে এই ঘাটতি পূরণ করা হবে তা স্পষ্ট করে বাজেটে উল্লেখ করা থাকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা পূরণে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য ব্যাংক বহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। সরকার প্রতিবছরই ঋণ নিয়ে থাকে এবং তা পরিশোধ করে। এবার সরকার যে পরিমাণ ঋণ নেবে তা জিডিপির অংশ বিবেচনায় গত অর্থবছরের চেয়ে কম। স্থবির অর্থনীতিকে সচল করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারের ঋণের আবশ্যকতা রয়েছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বলেই সরকারকে ঋণ নিতে হয়। সরকারের আয়ের বেশিরভাগ আসে ভ্যাট, কাস্টম ডিউটি, আয়কর থেকে। কিন্তু আমাদের দেশে কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ১১ শতাংশ; নেপালে এই হার ২৪ শতাংশ, ভারতে প্রায় ২০ শতাংশ, মিয়ানমারে ১৬ শতাংশ এবং ইউরোপের দেশগুলোতে গড়ে এই হার ৪৭ শতাংশ। আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত এত কম বলেই সরকারকে ঋণ নিতে হয়। 

রাজস্ব আদায় কম হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে, যারা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই বিভাগে দুর্নীতি এত ব্যাপক যে, সরকারকে ভ্যাট, কর, কাস্টম ডিউটি কীভাবে কম দিতে হয় তার পথ এই বিভাগের লোকজন নাগরিকদের বাতলে দেয়। 

প্রয়োজনীয় রাজস্ব আদায় হয় না বলেই সরকারকে ঋণ করে ব্যয় করতে হচ্ছে। সরকারের ব্যয় সংকোচনের সুযোগ কম, উন্নয়নের যে সকল প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন এবং যে সকল অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে সেগুলোর অবকাঠামো নির্মাণে সরকারকে ব্যয় করতেই হবে, মাঝ পথে থেমে গেলে ইতোমধ্যে ব্যয়িত অর্থের আর কোনো আউটপুট থাকবে না। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার দিয়েছে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এখন বিদ্যুৎ অপরিহার্য অনুষঙ্গ, মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার দিয়ে দেশের উন্নয়ন পরিমাপ করা হয়। কিন্তু ঋণ না নিলে সরকারের বিনিয়োগ ক্ষমতা হ্রাস পাবে, অবকাঠামোর উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, মানসম্পন্ন অবকাঠামো না থাকলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও হ্রাস পাবে, বিনিয়োগ কমলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমলে উৎপাদন কমবে, উৎপাদন কমলে কর্মহীন লোকের সংখ্যা বাড়বে, রপ্তানি হ্রাস পাবে। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উৎপাদন বৃদ্ধির নিমিত্তে সরকারকে ঋণ নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা সম্প্রসারণমূলক নীতি গ্রহণ করতেই হচ্ছে। 

বাজেট পাস হওয়ার পরপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে অর্থের ছাড় শুরু হয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বরাদ্দ করা অর্থ খরচে নানাবিধ কর্মকাণ্ড শুরু করে। সরকার সারা বছর যে রাজস্ব আদায় করে তা জমা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে, সরকারের সকল ব্যয় পরিশোধও হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। সরকারের পক্ষে লেনদেন শেষ করে দিন শেষে প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সঙ্গে দেনাপাওনা নিষ্পত্তি করে। সরকারের পক্ষে জমা বেশি হলে ঋণ সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয় না, জমা কম হলে ঋণের উদ্ভব ঘটে। লেনদেনে প্রতিদিন ঘাটতি হলে ঋণ বাড়তে থাকে। সরকারের অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের কোনো চেক ডিজঅনার করতে পারে না। তাই বাজেটে যে ঘাটতি আছে তা পূরণ করতে সরকারকে ঋণ নিতেই হবে। তবে সরকার যদি মনে করে, যে কাজ বা প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেই কাজ বা প্রকল্পের গুরুত্ব কমে গেছে বা একেবারেই নেই, তখন সরকার সেই প্রকল্প বাদ দিয়ে ব্যয় কমাতে পারে। 

সরকার ঋণ নিলে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ে; মূল্যস্ফীতি হয়। মূল্যস্ফীতি রোধে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমানোর নানাবিধ কলাকৌশল প্রয়োগ করা হয়। বাজারে অর্থ সরবরাহ কমে গেলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও হ্রাস পায়, তখন মানুষ ব্যয় করতে হিসাবি হয়ে ওঠে। মানুষ ব্যয় করার ক্ষেত্রে হিসাবি হয়ে গেলে জিনিসপত্রের বিক্রি কমে যায়, বিক্রি কমে গেলে উৎপাদক লোকসানের সম্মুখীন হয় এবং অধিক উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসে। মূল্যস্ফীতি কমানোর আরেকটি পথ হচ্ছে উৎপাদন বাড়ানো; কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও সীমিত জমি উৎপাদন বাড়ানোর প্রধান প্রতিবন্ধক। এ ছাড়াও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সময়ের প্রয়োজন হয়। বাজারে পণ্যের জোগান বাড়ানোর আরেকটি পথ হচ্ছে বিদেশ থেকে আমদানি। কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত পণ্য এনে বাজারে জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। 

বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি; জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরিব লোকগুলোর অসহায়ত্ব বেড়ে গেছে। সরকার এ ক্ষেত্রে কম দামে গরিবদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা নিয়েছে, এই ব্যবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমবে। এ ছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় লক্ষ লক্ষ নিঃস্ব পরিবারকে সরকার বিনা পয়সায় খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে এবং এর মাধ্যমে গরিব এবং নিঃস্বদের কাছে মূল্যস্ফীতি কিছুটা সহনীয় হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, সার, কৃষি সরঞ্জাম প্রভৃতি খাতে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সমাজের সবচেয়ে দুর্বল মানুষদের জন্য সরকারের লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা ফলপ্রসূ হয়েছে। মূল্যস্ফীতি রোধে বর্তমান প্রেক্ষিত বিবেচনায় সরকারের এই সকল পদক্ষেপ সঠিক ও যথোপযুক্ত; তাই সরকারের ঋণ দরকার। 

সরকারের অর্থায়নে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য; কিন্তু তাই বলে খিচুড়ি রান্না শেখার জন্য বিদেশে যাওয়ার খরচ বহন করা গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়াও প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আনয়ন জরুরি, ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা অর্জন আরও বেশি জরুরি। সরকারি অর্থের চুরি, ডাকাতি বন্ধ সম্ভব হলেও সরকারের ঋণ কমবে। ঘুষ আর দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হলে প্রকল্প ব্যয় কমে যাবে, প্রকল্প ব্যয় কমে গেলে সরকারের ব্যয় কমবে, সরকারের ব্যয় কমলে সরকারের ঋণও কমবে, সরকারে ঋণ কমলে সরকারের ঋণের জন্য অর্থনীতিবিদদের কথিত টাকা ছাপানোর আর প্রয়োজন হবে না।

লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫