জাতীয় সংসদ নির্বাচন
জাতিসংঘের কতটা ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে?

জাফর খান
প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৩, ১৪:৩৬

ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নানান দেশে বেশ কিছু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেগুলো আবার সাধারণ কোনো পরিস্থিতিতে নিশ্চয় হয়নি। বিশেষ কিছু প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে কিংবা দেশের নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতার ফসল হিসেবে জাতিসংঘকেই দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন করতে হয়েছিল। কিন্তু যুগ পাল্টেছে, সময়ে এসেছে পরিবর্তনের হাওয়া, জনগণ হয়েছে অনেক সচেতন। বিশ্ব এগিয়েছে বহুদূর আর পুরো বিশ্ব এখন মানুষের হাতের মুঠোয়।
এহেন পরিস্থতিতে বাংলাদেশে কতটা কার্যকরী হবে বা হওয়ার কোনোরকম সম্ভাবনা আদৌ আছে কী না আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটির নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন করার, সেটি আজকের আলোচ্য বিষয়। যা খুঁজতে কিছু তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষকদের মতামত জানা জরুরি। বিবিসি বাংলার একটি বিশ্লেষণের সঙ্গে আমাদের চিন্তার যোগসূত্র স্থাপন করে বিষয়টি আলোচনার প্রয়াস রাখে।
স্নায়ুযুদ্ধ শেষে কম্বোডিয়ার সরকারের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি করে জাতিসংঘ। সেটির বদৌলতে খেমাররুজসহ যুদ্ধরত তিন দল ওই চুক্তির আওতায় জাতিসংঘের একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেদেশে নির্বাচনেরও আয়োজন করে। যেখানে ভোট পড়েছিল ৮৯.৫৬ শতাংশ। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ইন্দোনেশিয়া থেকে পৃথক হওয়া পূর্ব তিমুরের গণভোটও অনুষ্ঠিত হয়েছিল । আর সেটাও হয়েছিল আরেকটি যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। নামিবিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে একসময় জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তাদের নির্বাচন করেছে।
তাহলে বুঝা যাচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই যুদ্ধ কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা ভৌগলিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন আসার ফলেই এমন বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল সংসস্থাটি।
প্রশ্ন হলো- আমাদের দেশে এখনও কী এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? আপাত দৃষ্টিতে এমন পরিস্থিতি আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। সেক্ষেত্রে কতটাই বা যৌক্তিক হতে পারে অনেকের এমন দাবি যে, আমাদের দেশেও সংস্থাটির তত্ত্বাবধানে নির্বাচন দরকার?
এদিকে গত এক দশকে জাতিসংঘের এমন ভূমিকারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এমনকি নীতিমালাতেও এসেছে অনেক পরিবর্তন।
এবারে দেখা যাক, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা মতবিরোধের জের ধরে কোন দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের উদাহরণ আছে কী না?
আমরা জানি, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন করতে প্রস্তাব এসেছে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে মার্কিন কংগ্রেসের ১৪ জন একটি চিঠির মধ্যদিয়ে। আর এখান থেকেই বিতর্কের শুরু।
মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা চিঠিটি এমন এক সময় পাঠালেন যখন বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে তুমুল মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, জনগণ যাতে করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের পছন্দমত প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন তেমন সুযোগ সৃষ্টির জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে চিঠি দিয়েছিলেন কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য।
কিন্তু জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কোন দেশের নির্বাচন অনুষ্ঠিত বলতে আসলে কী বোঝানো হয়? বিশ্বের কোন কোন দেশে এভাবে নির্বাচন হয়েছে ও কী প্রক্রিয়াতেই জাতিসংঘ এরকম নির্বাচনের আয়োজন করে থাকে?
জাতিসংঘ কর্তৃক নির্বাচনে সহায়তার পদ্ধতি
সাধারণত কোন দেশের নির্বাচনে জাতিসংঘের কেমন ভূমিকা হতে পারে, আর সে ভুমিকার রুপটি কী হবে, এ নিয়ে গত বছরের পহেলা ফেব্রুয়ারি একটি নীতিমালা তৈরি করেছে জাতিসংঘ।
ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্ট: সুপারভিশন, অবজারভেশন, প্যানেল অ্যান্ড সার্টিফিকেশন শিরোনামের ওই দলিলে নির্বাচনে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের নির্বাচনে সহায়তা সংক্রান্ত দলিলপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, কোন দেশের নির্বাচন জাতিসংঘ শুধুমাত্র তখন তত্ত্বাবধান করতে যাবে যদি ওই দেশ সহায়তার অনুরোধ করে থাকে বা নিরাপত্তা পরিষদে বা সাধারণ পরিষদে এ সংক্রান্ত কোন প্রস্তাব পাস করা হয়।
কোন দেশের নির্বাচনে কয়েকভাবে জাতিসংঘ সহায়তা করতে পারে। কখনো কখনো এসব পদ্ধতি একসাথেই কার্যকর হতে পারে, আবার পৃথক পৃথকও হতে পারে। এসব পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে:
• জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের আয়োজন
• নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো
• বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ ও নজরদারির ব্যবস্থা করা
• নির্বাচন সম্পর্কে স্বীকৃতি দেওয়া বা না দেওয়া
এসবের বাইরে কারিগরি সহায়তা, নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাজে সহায়তার মতো বেশ কিছু কাজও জাতিসংঘ করে থাকে। আর এসব লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রয়োজনে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন, শান্তি রক্ষা এবং বিশেষ রাজনৈতিক মিশনও পরিচালিত হতে পারে। কিন্তু চাইলেই জাতিসংঘ এসব করতে পারবে না, সেজন্য অবশ্যই নিরাপত্তা পরিষদ বা সাধারণ পরিষদের ম্যান্ডেটের পাশাপাশি ওই দেশের সমর্থনও থাকতে হবে।
জাতিসংঘের দলিলে বলা হয়েছে, ‘’কোন দেশের রাজনৈতিক জটিলতার কারণে সেদেশের নির্বাচন আয়োজনে সরকার জাতিসংঘের সহায়তা চাইলেই হবে না, সেজন্য অবশ্যই ওই দেশে জাতিসংঘের এরকম দায়িত্ব পালনে জনগণের সমর্থন থাকতে হবে।‘’
জাতিসংঘের ওয়েবসাইটেই বলা হয়েছে, যদিও একসময়ে নির্বাচনে পর্যবেক্ষণ করার মতো মূল দায়িত্বগুলো পালন করতো জাতিসংঘ, কিন্তু বর্তমানে এটা খুব কমই করা হয়। বরং নির্বাচন আয়োজনে দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি সক্ষমতা বৃদ্ধিতেই বিশেষ সহায়তা করা হয়।
বিভিন্ন দেশে যেভাবে নির্বাচনে ভূমিকা রেখেছে জাতিসংঘ
ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স: সুপারভিশন, অবজারভেশন, প্যানেল অ্যান্ড সার্টিফিকেশন নীতিমালায় বলা হয়েছে, কখন কোন দেশের নির্বাচনের প্রধান অনুষঙ্গগুলো জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আয়োজন করা হবে।
১৯৫০ এবং ষাটের দশকে যখন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হতে একের পর এক দেশ স্বাধীনতার জন্য গণভোটের আয়োজনের শুরু করে, তখন থেকে জাতিসংঘের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়।
আর সেখানে জাতিসংঘ মূলত নিশ্চিত করার চেষ্টা করে থাকে, যাতে সবাই বিনা বাধায় নিজের মতামত ভোটের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন। সে সময় জাতিসংঘের একজন তত্ত্বাবধানকারী কমিশনার বা ছোট একটি প্যানেল বা কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচনের কাজ তদারকি করা হয়। মূলত সেই দেশের কর্মকর্তারাই নির্বাচনের কাজ করেন, কিন্তু এই কমিশন নজরদারিসহ পরামর্শ ও পর্যালোচনা করে থাকে। আর নির্বাচনের প্রতিটি ধাপ সম্পন্নের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কমিশনের অনুমোদন লাগে। কিন্তু সহসাই এ ধরনের কাজে জড়িত হয় না জাতিসংঘ।
সবশেষ এমন নির্বাচন আয়োজিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে নামিবিয়ায়। এছাড়া ২০০১ সালের পূর্ব তিমুরের পার্লামেন্টারি ও ২০০২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জাতিসংঘের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের আরেকটি মাধ্যম পর্যবেক্ষক দল পাঠানো, যদিও এটাও এখন খুব একটা পাঠায় না সংস্থাটি। এজন্যও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বা নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন লাগে। পর্যবেক্ষক দল নিজেরা সরাসরি নির্বাচনের কোন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন না, কিন্তু যথাযথভাবে নির্বাচন হচ্ছে কিনা, সেটা নজরদারি করতে তারা সক্ষম। আর এটির ভিত্তিতেই নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু এবং অবাধ হয়েছে, সেই বিষয়ে সরাসরি জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় পর্যবেক্ষক দল।
আবার এই পর্যবেক্ষণের যে মতামত দেয়া হবে, তাতে আইনগত কোন বাধ্যবাধকতা অবশ্য রাখা হয় না। কিন্তু ওই নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য, তা অনেকাংশে এই মতামতের ওপর অবশ্য নির্ভর করে থাকে।
তবে যেসব দেশের নির্বাচনে জাতিসংঘ কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে, সেসব দেশে সাধারণত পর্যবেক্ষক মিশন পাঠায় না জাতিসংঘ।
এর আগে বুরুন্ডিতে ২০১৫ সালে এবং ফিজিতে ২০০১ সালে এরকম পর্যবেক্ষক মিশন প্রেরণ করেছিল জাতিসংঘ।
এরকম ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের অনুমোদন ছাড়াও ওই দেশের সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানাতে হয়।
২০২০ সালের নভেম্বরে ইরাকের নির্বাচনে সেদেশের সরকারের অনুরোধেই পর্যবেক্ষক মিশন পাঠিয়েছিল জাতিসংঘ। অবশ্য ইরাকের নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালী করে গড়ে তুলবার জন্য ২০০৪ সাল থেকেই জাতিসংঘের একটি দপ্তর কাজ করে আসছে।
এ প্রসঙ্গে বার্মিংহ্যাম ইউনিভার্সিটির ডেমোক্রেসি বিভাগের অধ্যাপক নিক চিজম্যান বলেন, সাধারণত ইউএনডিপি বা অন্য সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করে জাতিসংঘ। কিন্তু সরাসরি কোন দেশের নির্বাচনে ভূমিকা রাখার ঘটনা খুবই বিরল। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর নির্বাচন ইস্যুতে সাধারণত বড় দাতাদেশগুলো কিংবা আঞ্চলিক সংস্থাগুলো বরং এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। সাধারণত রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যে নিজেদের জড়াতে চায় না জাতিসংঘ।
ইতিহাস বলছে, আফগানিস্তানে ২০০৪-২০০৫ সালের নির্বাচন এবং ইরাকে ২০০৫ সালের নির্বাচনে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ মিশন সহায়তা করেছিল। দুই বছর আগে ইরাকে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নির্বাচন নিয়ে অবিশ্বাস আর অনাস্থা চরমে পৌঁছেছিল তখনো সেদেশের অনেক রাজনৈতিক দল এমন আহবান জানিয়েছিল। যদিও তাতে সাড়া মেলেনি।
দেখা যায়, ভেনিজুয়েলায় ২০২১ সালের নির্বাচনে এরকম বিশেষজ্ঞ প্যানেল পাঠিয়েছিল জাতিসংঘ। এর আগে ২০১৭ সালে নিউ ক্যালিডোনিয়ায়, ২০০৯, ২০১২, ২০১৪ ও ২০১৭ সালে আলজেরিয়ায়, ২০১০-২০১১ সালে সুদানে ও ২০০৮ সালে নেপালে এরকম বিশেষজ্ঞ প্যানেল পাঠায় সংস্থাটি।
তবে কোন দেশের নির্বাচন কেমন হলো, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নির্বাচন কমিশনই ফলাফলের সনদ দিয়ে থাকে। কিন্তু কখনো বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বা নিরাপত্তা পরিষদ মহাসচিবকে সনদ দেয়ার অনুরোধ জানাতে পারে।
নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশ না নিলেও এর মাধ্যমে আসলে জাতিসংঘ ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির বিষয়টিকে ইঙ্গিত করে থাকে। আর এমন সনদের ক্ষেত্রেও জাতিসংঘ মহাসচিবের অবশ্য সাধারণ পরিষদ বা নিরাপত্তা পরিষদের ম্যান্ডেট দরকার হয়।
দেখা যায়, নব্বইয়ের দশকের আগের নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরনের সনদ দিতো জাতিসংঘ। অ্যাঙ্গোলা, এল সালভাদর, হাইতি, নিকারাগুয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মোজাম্বিকের নির্বাচন নিয়ে ‘সার্টিফিকেট’ ইস্যু করেছিল জাতিসংঘ। আর ২০০৭ সালের পূর্ব তিমুরের ও পরে আইভরি কোস্টের ২০১০ সালের নির্বাচন নিয়েও যখন বিতর্ক তৈরি হয়, তখন সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য বলে সনদ দিয়েছিল জাতিসংঘ।
এছাড়াও কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান, আফগানিস্তান বা ইরাকের মতো দেশগুলোয় সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে প্রয়োজনীয় কারিগরী সহায়তা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে জাতিসংঘ।
অধ্যাপক নিক চিজম্যান বলছেন, কোন দেশের নির্বাচন ঠিকভাবে না হলেও সাধারণত সেখানে জাতিসংঘের তরফ থেকে খুব শক্ত কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। পর্যবেক্ষকরা প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি দাতাদেশ বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকে। কিন্তু জাতিসংঘের তরফ থেকে সেরকম বিবৃতি বা প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে জাতিসংঘের ভূমিকা রাখার আসলেই কী সুযোগ আছে?
আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা কূটনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে বিশ্বের দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধে যেহেতু জাতিসংঘ সরাসরি কোন হস্তক্ষেপ করে না সেহেতু এমন সুযোগ কম। তবে অনেক সময় সংস্থাটি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু সেখানে সফল না হলেও তাদের কিছু করার থাকে না।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ভাষ্য, বিশ্বের যেসব দেশের নির্বাচনে জাতিসংঘ ভূমিকা রেখেছে, সেখানে কিছু আলাদা পরিস্থিতি ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতার অভাব বা কোন এক পক্ষ পরাজিত হয়েছে, সেই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ সেখানে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে তো সেই পরিস্থিতি নেই। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন নিয়ে জাতিসংঘের বর্তমানে কিছু করণীয় আছে বলে আমি দেখিনা।
তাহলে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া হোসেনের এমন মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে আমাকে কিন্তু আলোচনার শুরুতেই যেটির অবতারণা করেছিলাম সেখানেই ফিরে যেতে হয়। আমি বলেছিলাম, আমাদের দেশে এমন কোনো অস্বাভাবিক, অস্বস্তিকর বা গৃহযুদ্ধ কিংবা তার চেয়েও ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, যেখানে জাতিসংঘ সরাসরি তাদের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন করে থাকার মানসিকতা নিয়ে অপেক্ষায় বসে রয়েছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক তৌহিদ হোসেন কিন্তু আরও বলছেন যে, কংগ্রেসম্যানদের চিঠিও এখনি বিশেষ কোন বার্তা দেয় না। কারণ জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি কাজ করেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অধীনে। কংগ্রেসের সদস্যদের এই চিঠির বিষয়ে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানাবেন। সেখান থেকে কোন সিদ্ধান্ত এলে তখন তিনি জাতিসংঘে প্রস্তাব তুলতে পারেন। যদিও এরকম কোন সম্ভাবনা আপাত দেখা যাচ্ছে না। আবার সেসব প্রস্তাবে চীন বা রাশিয়ার মতো দেশ ভেটো দিলে তা সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল হয়ে যাবে।
তবে অনেক সময় বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক বিরোধে জাতিসংঘের বিশেষ দূত বা মহাসচিবের দূত মধ্যস্থতা করে থাকেন। তাহলে এখানেও স্পষ্ট, যদিওবা এমন কোন প্রস্তাব জাতিসংঘে ওঠেও আর সেখানে যদি চীন বা রাশিয়ার মত পরাশক্তি ভেটো প্রদান করে তবে আর প্রস্তাবটি গৃহীত হবে না। এক্ষেত্রে বাঙ্গালদেশের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার বন্ধুসূলভ সম্পর্ক হয়তবা এমন প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও এমন দেশগুলোর সমর্থন এ প্রস্তাবের সঙ্গে যোগ হবে না, তা কিন্তু বেশ দৃশ্যমান।
এর আগে বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কেন্দ্রিক অচলাবস্থা কাটাতে ঢাকায় তিন দফায় এসেছিলেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তখন তিনি বলেছিলেন, তার সফরের লক্ষ্য ছিল উভয় দলকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা। তিন দফায় ঢাকায় এসে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আলোচনার পরেও বিরোধের কোন সমাধান হয়নি। বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পুনরায় সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারি মহাসচিব মিরোস্লাভ জেনকার সাথে বৈঠক করলেও পরবর্তীতে এ নিয়ে বিএনপি বা জাতিসংঘের তরফ থেকে কোন বক্তব্য প্রকাশ্যে আসেনি।
আর কিছুদিন আগে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সংলাপের কথা বলে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতা। সেই বক্তব্য সরকারি দল থেকে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের মাত্র কয়েকমাস বাকি থাকলেও কোন পক্ষ থেকেই জাতিসংঘের মধ্যস্থতার বিষয়টি নিয়ে কোনো আহবান বা উদ্যোগ নেওয়ার জন্য পীড়াপীড়িও করেনি এখনও। অন্যদিকে জাতিসংঘের তরফ থেকেও এমন কোন ইঙ্গিত মেলেনি।
কূটনীতিক বিশ্লেষক ও বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মত, এক কথায়- কোনো পক্ষ হতে জাতিসংঘের কাছে চিঠি পাঠানো মানেই কিন্তু এমন নয় যে , জাতিসংঘের মতো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কোন দেশের রাজনৈতিক মতবিরোধে হস্তক্ষেপ করে ফেলবে। বরং সরকার না চাইলে বিরোধীদের পক্ষেও জাতিসংঘের কাছে সরাসরি আবদারের কোন পরিস্থিতি আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নানা কর্তা ব্যক্তিরা আবার বলে আসছেন তারা একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন দেখতে চান। তারা কোনো দল না আসলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না এমন কথা তারা বলছেন না। কিংবা এও বলছেন না, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এমনকি সম্প্রতি বাংলদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেন, তত্বাবধায়কের কোন ইস্যু নিয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। বরং মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন পিটার হাস। তাহলে সকল তথ্য ও বিশ্লেষণের আলোকে দেখা যাচ্ছে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়টি দেশের সকল কুশীলব রাজনীতিবিদদের একান্ত প্রচেষ্টায় কোনো মতবিরোধ থাকলেও একটি সুস্থ পথ তৈরি করে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে আরও নির্বিঘ্ন করে তুলতে দেশের জনগণের কথা ভেবে কীভাবে সকল দল মিলে একটি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় সে ব্যবস্থাই এদেশের জনগণের একমাত্র চাওয়া।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা