Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

দিলু রোডে ‘গোধূলির প্রেম’ করল কারা

Icon

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৩, ১৬:১১

দিলু রোডে ‘গোধূলির প্রেম’ করল কারা

আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি

সিনেমার ওপর একটা লেখা লিখতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল যে আমাদের দিলু রোডের বাসাতেই ১৯৬৩/৬৪ সালের দিকে একটা সিনেমার শুটিং হয়, নাম ‘গোধূলির প্রেম’। রিলিজ হয় ১৯৬৫ সালে। নায়ক ছিলেন আমিনুল হক, যিনি দেশের প্রথম ছবি মুখ ও মুখোশ ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন। আর নায়িকা ছিলেন চিত্রা সিনহা, পরে বিয়ে করে চিত্রা জহির হন।

আমার মনে আছে একটা গোটা সিনেমার শুটিং হচ্ছে, কিন্তু পাড়ার ভেতর কোনো ঝামেলা হয়নি, এমনকি বিশাল কোনো ভিড়ও না। এখন এটা বোধহয় সম্ভব না। ওটা অতীতেরও আগের ঘটনা।

দুই
দিলু রোড একটা মিশ্র অর্থনীতির পাড়া, তবে প্রধানত উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা যায়। আমরা থাকতাম ৩১, দিলু রোডে, আর আমার নানা-মামারা থাকতেন পাশের বাড়িতে। আমরা উঠি ১৯৫৭ সালে। সবার সঙ্গে সবার ভালো সম্পর্ক ছিল পাড়ায়। কয়েকটা খালি জমি ছিল, তাতে ক্রিকেট খেলা হতো। সবাই খেলত, তাই মিলমিশ ছিল অনেক বেশি। বোধহয় এই কারণে ১৯৭১ সালে কোনো বিপত্তি হয়নি কারও। কেউ কারও বিরুদ্ধে লাগেনি। বাইরের লোক এসে যুদ্ধের পর দখল নিতে চেয়েছে, অসহায় মানুষের ওপর অগ্রহণযোগ্য কাজ করেছে, কিন্তু একাত্তর ছিল এ ধরনের ঝামেলা মুক্ত। এখন সকল পাড়ার কাঠামো, রসায়ন দুটোই পাল্টে গেছে।

তিন
আমাদের পাড়ায় যেটা ‘সিলেটিদের বাড়ি’ বলে পরিচিত তাতে থাকতেন সিনহা বাবু। আমি জানি না কী করতেন, তবে তার মেয়ে যে অভিনয় করেন এটা শুনতাম। আমার আগ্রহের জায়গা নয়। তবে তিনি বেশ বিখ্যাত এটা জানতাম। অথচ চলা-ফেরার মধ্যে কোনো ঠাটবাট নেই। সন্ধ্যার দিকে পাড়ায় হাঁটতেন, ওনার বাবা আমার নানার সঙ্গে কথা বলতেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে। একদিন নানা এসে বললেন যে, সিনহা বাবুর বন্ধু নাকি আমাদের বাড়িতে শুটিং করতে চায়। আমাদের সাদা দোতলা বাড়ি, তাতে বড় একটা ব্যালকনি ছিল। বাগান ভেলিয়া গাছ মাটি থেকে উঠে দোতলার সঙ্গে হাত মেলাতো ওই ঝুল বারান্দায়। হয়তো সে কারণেই পছন্দ হয়। আজকাল বহু বাড়িতে হরহামেশা শুটিং হয়। তখন এর চল এত হয়নি। আমার বাবা-মা যে কী কারণে রাজি হলেন জানি না, কিন্তু হয়ে গেলেন। একদিন শুরু হলো ‘গোধূলির প্রেম’। 

চার
মনে আছে এর প্রোডিউসারের নাম ছিল আব্দুল হামিদ। ওনার সঙ্গে অনেকগুলো এক টাকার নোটের বান্ডিল থাকত। গুনে গুনে টাকা দিতেন শুটিং কালে, নানা কাজে। পরিচালক ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তার বেশ কিছু নামি ছবি ছিল। আমিনুল হক, চিত্রা সিনহা বাদে ছিলেন ‘নবাব’ আনোয়ার হোসেন। আর ছিলেন কমেডিয়ান সোনা মিয়া। বাকিদের নাম মনে নেই। আমার সবচেয়ে বেশি খাতির হয় ক্যামেরাম্যান সাধন রায়ের সঙ্গে।

পাঁচ
গুগল সার্চ দিয়ে শিরিন বেগম নামটি পেলাম, কিন্তু ওনাকে মনে নাই। এক ভদ্রলোকের কথা খুব মনে পড়ে, নামটা নয়। তিনি মেয়ের বাবার ভূমিকায় ছিলেন। নিজ জীবনে ছিলেন রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার, শখের অভিনেতা। খুব সজ্জন মানুষ। বারবার বলতেন ওদিকে গেলে আমাকে খবর দেবেন। আমার পথে পড়ে, দেখা করব। তখন মানুষের অহমিকা একটু কমই ছিল। আমার বাবা রাশভারী মানুষ ছিলেন, সবার সাথে আড্ডা দিতেন না। তিনিও এনাদের সাথে কথাবার্তা বলতেন। একদিন শুটিংকালে চিত্রা আর আমার মা, অনেকক্ষণ বসে গল্প করলেন দেখলাম। আসলে তিনি স্টার ছিলেন না, যেন পাড়ার মেয়ে। এই বিষয়টা এখন কম। আমার মাকে একবার যখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইন্ডিয়ান এক চ্যানেলের হয়ে, “যুদ্ধের বছর, বাড়িতে এতজন হিন্দুকে আশ্রয় দিতে ভয় লাগেনি?” তিনি রেগে গিয়েছিলেন। বলেন, “আমরা তোমাদের মতো না, ওরা আমাদের লোক।” এখন আমাদের মানে রাজনৈতিক দলের লোক, পাড়ার-সমাজের মানুষ নয়।

ছয়
অভিনয় করা যে এত কষ্টের, সেবারই দেখলাম। রাতের সিন। ছবিতে আনোয়ার হোসেন ভিলেন, সে চিত্রা সিনহাকে চায়, কিন্তু চিত্রা চায় আমিনকেই। কিছু একটা দৃশ্য ছিল। কিন্তু কী কারণে জানি না, রিশুট চলতেই থাকে। কষ্ট কারে কয়। বাপরে বাপ! দারুণ ধৈর্য লাগে। গানের একটা দৃশ্য হলো। ছাদে বসে আমিন গোধূলির গান লিপসিং করলেন। গানটি কী ছিল মনে নাই। তবে সবচেয়ে মজার ছিল কমেডিয়ান সোনা মিয়ার একটি দৃশ্য। মামাদের বাড়ির সামনের লনে শুটিং চলছে, বেশ কিছু অতিথিও রয়েছে। কিন্তু “সাইলেন্স” বলার পরও কোনো লাভ হয়নি। এত হাসছিল সবাই যে সাউন্ড বন্ধ করেন পরিচালক, বলেন ডাবিং করতে হবে। সোনা মিয়া কই, উনার ইতিহাস কি জানি না। কারো জানা থাকলে জানায়েন। 

সাত
এর কিছুদিন পর আমাদের বাড়িতে শুটিং শেষ হয়। তারা চলে যান, জীবন স্বাভাবিক হয়। একদিন হঠাৎ মা বলেন এফডিসি থেকে দাওয়াত করেছে শুটিং দেখতে যেতে। আমরা দারুণ খুশি, গেলাম মা’র সাথে। গিয়ে দেখি আমাদের বাড়ির যে ব্যালকনি তা প্রায় হুবহু তৈরি করা হয়েছে। খুব মজা লেগেছিল।

আট
আমার সাথে খাতির ছিল ক্যামেরাম্যান সাধন রায়ের। তিনি একদিন তার পাশে বসিয়ে ক্যামেরা চালাতে দেন একটু। একদিন কথা বলতে বলতে বলেন, “এই ছবি হিট হবে না।” কেন তিনি ভাবলেন জানি না। আসলেই হিট হয়নি, ১৯৬৫ সালে রিলিজ পায়। তবে কিছু মানুষ পছন্দ করেছিল যে উর্দু ছবির ভিড়ে বাংলা ছবি, এটা সাধুবাদ যোগ্য।

নয়
দুইটা উপরি ঘটনা বলি। ছোটবেলা থেকে গান শিখতাম, সেটা বন্ধ হয়ে যায় স্কুলের কারণে। নানা ভাই সাধন রায়কে একজন গানের মাস্টারের কথা বলেন। ঠিক হয়, কিন্তু বাবা করাচি বদলি হওয়ার ফলে আর এগোয়নি, আমার গানের জীবনের ইতি ঘটে।

অন্য ঘটনাটি আরও মর্মান্তিক। ঠিক কে রেকমেন্ড করেছিল জানি না। তবে একদিন চিত্রা সিনহার বাবা এক লোককে নিয়ে হাজির। তারা আমাকে সিনেমার অফার দেয়। ‘ইয়ে ভি এক কাহানি’ নামের এক উর্দু ছবির নায়কের ছোটবেলার চরিত্রে। বলার দরকার আছে যে আমি বেশ গাপ্পুস গাপ্পুস ছিলাম? নায়ক ছিলেন হারুন, যাকে বেবি আইসক্রিম কোম্পানির মালিক হিসেবে অনেকে চেনেন/চিনতেন। বাবা না করে দিলেন। আমার ফিল্ম ক্যারিয়ার সেখানেই শেষ। বাধ্য হয়ে সাংবাদিক মাস্টার, আরওা কত কী! না হয় হিরো আফসান হতাম। 


লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫