
এম আর খায়রুল উমাম। ফাইল ছবি
টাঙ্গাইল-আরিচা মহাসড়কে কাটা হচ্ছে শতবর্ষী ফলদ ও বনজ গাছ (৫ জুন ২০২৩), একটি গাছ কাটলে ১০টি গাছ লাগাতে হবে- হাইকোর্ট (১৪ জুন ২০২৩), গাছ নিয়ে দুই মেরুতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন (১০ জুন ২০২৩), বরিশালে ঝুঁকিপূর্ণ দেখিয়ে শতবর্ষী শতাধিক গাছ কাটার পাঁয়তারা (৩১ জুলাই ২০২৩) গত দুই মাসের কয়েকটি পত্রিকায় উঠে আসা শিরোনামের দিকে দৃষ্টিপাত করলে একটা বিষয় নির্দ্বিধায় বলা যায়, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার প্রধান বলি বৃক্ষ। যত উন্নয়ন প্রকল্প তত বৃক্ষ নিধন। তা সে সড়ক কিংবা অবকাঠামো নির্মাণ হোক, প্রকল্পের প্রথম কাজ গাছ কেটে জায়গা তৈরি করা।
সত্যি কথা বলতে আমাদের পরিকল্পকরা বিকল্প চিন্তা করতে পারেন বলে মনে হয় না। আজকের চরম আবহাওয়া, মানুষের জীবনে তার ক্ষতিকর প্রভাব দৃশ্যমান, কিন্তু পরিকল্পকরা পিছনে ফিরে তাকাচ্ছেন না।
বিশ্ব উষ্ণায়নে বাংলাদেশের অবদান সামান্য তা সবাই জানে। কিন্তু পরিবেশ উষ্ণায়নের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় কিন্তু আমাদের দেশের অবস্থান উপরের দিকেই। তাই আমজনতা হিসেবে আমরা পরিবেশের খুব একটা ক্ষতি না করলে কী হবে, জাতিগত পাপের ফলস্বরূপ পরিবেশ আমাদের ক্ষতি করবেই। ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে দেশের প্রায় ১৭ শতাংশ নিম্নভূমি সমুদ্রের নোনা পানিতে ডুবে যাবে। অতীতেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, মহামারী বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে হানা দিত। কিন্তু বর্তমানে নিয়মিত বিরতিতে ঘটে চলা প্রাকৃতিক বিপর্যয় বিশ্বজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
বিশ্ব নেতারা পরিবেশ রক্ষায় একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন, যদিও তা এখনো সর্বসম্মতভাবে মানা হচ্ছে না। পরিবেশ রক্ষা কোনো একক দেশের পক্ষে সম্ভব নয় আর বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তো নয়ই। কিন্তু আমাদের পক্ষে অসম্ভব জেনে তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকাও যাবে না। পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এমন কাজ থেকে সরে আসা প্রয়োজন। মনে রাখা প্রয়োজন পরিবেশ রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে পানি আর গাছ। দুর্ভাগ্য আমাদের, দেশের পরিকল্পকরা সবচেয়ে বেশি উদাসীন এই দুটো বিষয়ে। এই তো কয়েক দিন আগের কথা। যশোর-বেনাপোল সম্প্রসারণ কাজ চলমান। সড়কের পাশে ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী গাছগুলো কেটে ফেলার উদ্যোগে এলাকাবাসী প্রতিবাদ জানায়। বিকল্প পন্থায় সড়ক সম্প্রসারণের দাবি তোলে। কিন্তু পরিকল্পকরা বিকল্প পথে না গিয়ে এমন প্রক্রিয়ায় সড়ক নির্মাণে ব্রতী হয় যাতে শতবর্ষী গাছ রক্ষা করে সাধ্য কার? প্রকল্প বাস্তবায়নকারীরা গাছগুলোকে দুর্বল করে ফেলার সকল পন্থা অবলম্বন করে এবং এলাকার কিছু মানুষ অবিলম্বে গাছগুলো কেটে দুর্ঘটনার হাত থেকে তাদের বাঁচানোর দাবিতে মানববন্ধন করে। এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এদিকে সাধারণ মানুষ যখন এই গাছগুলো রক্ষায় আন্দোলন করছিল সেই সুযোগে যশোর-খুলনা সড়ক সম্প্রসারণের নামে আড়াই হাজারের বেশি গাছ পরিকল্পকদের ভোগে চলে গিয়েছে।
শুধু সড়ক যোগাযোগ নয়, অবকাঠামো নির্মাণের জন্য গাছকে প্রথম টার্গেট করা হয়ে থাকে। ৯০০ একর জায়গায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য কয়েক হাজার বর্গফুট খালি জায়গা পাওয়া গেল না।
সরকারি থেকে ব্যক্তিগত পর্যায় কোথাও সবুজ রক্ষার তাগিদ নেই। ইট-পাথরের কারখানা তৈরির প্রতিযোগিতার মধ্যেই রয়েছে সবাই। আজ সোহরওয়ার্দী উদ্যান রক্ষা পাচ্ছে না। ভবিষ্যতে রমনা পার্কের শরীরে হাত পড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আরও একটি শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সরকারের উন্নয়ন অগ্রগতির কারণে বৃক্ষনিধন বা অন্য কোনো ক্ষতির বিষয়ে সামান্য তথ্য প্রমাণসহ প্রতিবাদ হলে দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী বিশেষজ্ঞরা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের সময় সাধারণ মানুষ দেখেছে এহেন বাদ-প্রতিবাদ। যেহেতু দেশের সাধারণ জনগণ দেখেছে এক সময়ের বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে পোল্ডার স্লুইচ গেট নির্মাণ জনজীবনের জন্য কেমন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। আজ সব বাধাকে অবহেলা করে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি ওই এলাকায় বেসরকারি পর্যায়ে শিল্প প্রতিষ্ঠা চলমান। ২০ বছর পর যদি সুন্দরবনের ক্ষতি শুরু হয় তবে সেসময়ে যারা উন্নয়ন ও অগ্রগতির দায়িত্বে থাকবেন তারা আবার শত সহস্র কোটি টাকার সুন্দরবন রক্ষা প্রকল্প করবেন। এভাবেই দেশের বনভূমি উন্নয়ন ও জনসংখ্যার চাপে প্রতিবছর কমছে। বেসরকারি পরিসংখ্যান দাবি করে দেশে মাত্র সাত শতাংশ বনভূমি অবশিষ্ট আছে। অবস্থা অনেকটাই এরকম, দেশে বনভূমি না থাকলেই কী হবে?
রাজধানী ঢাকায় আবাসিক এলাকা হিসেবে যেসব অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছিল, যে সামান্য খোলা জায়গা রাখা হয়েছিল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় তা রক্ষা করা যায়নি। অবশিষ্ট জায়গা দখলের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আধুনিকায়নে নেওয়া ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্পেরও অনিবার্য কার্যক্রম হিসেবে রয়েছে গাছ কাটা। স্বাধীনতার আগে প্রকৌশলীদের সাংগঠনিক দপ্তর এবং স্বাধীনতার পর শিশুপার্কের জন্য এ উদ্যান তার অনেক সবুজ হারিয়েছে। বর্তমানে স্মৃতিস্তম্ভের জন্য বাকি সবুজটুকুও হারাতে বসেছে। এ উদ্যান এত ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী তার গুরুত্ব বিবেচনা করে যদি আন্তর্জাতিক মানের স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়, তবে উদ্যান তার চরিত্র হারিয়ে ফেলবে। মনে রাখা জরুরি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনেক গাছে জাতির জনক থেকে শুরু করে অনেক জাতীয় নেতার স্পর্শ ছিল। এখানে গাছ কাটা মানে শুধু সবুজ নয়, জাতীয় নেতাদের হাতের স্পর্শও মুছে ফেলা।
এক সময় ইরাকে সড়ক নির্মাণকালে মসজিদ, কারখানা, বাজার বাড়ি ঘর কোনো কিছুকে গুরুত্ব দেওয়া হতো না। সড়কের গুণগত সুবিধা প্রাধান্য পেত। সেই কুর্দি অঞ্চলে তাদের প্রিয় নেতা এক গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিতেন বলে সড়ককে দূরে সরিয়ে নিয়ে প্রিয় নেতাকে সম্মান জানানো হয়েছে।
যশোর রোডের গাছগুলোও বাংলাদেশের প্রসব যন্ত্রণাকে বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাই এই গাছগুলো কাটার আগে ১০ বার ভাবার প্রয়োজন।
লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ