
আবু নাসের অনীক। ফাইল ছবি
“বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল--/পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান॥” ১৯০৫ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানটি লিখেছিলেন। তিনি ভাবতে পারেননি এই বাংলার বায়ু-জলই একসময় এই জনপদের মানুষের প্রাণহানীর একটি অন্যতম কারণ হয়ে দাড়াঁবে। আমরা এখন আর নির্মল-বিশুদ্ধ বায়ু শ্বাসের জন্য গ্রহণ করতে পারছি না। যে বায়ু আমরা গ্রহণ করছি তা ব্যাপক মাত্রায় দূষিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন দূষিত বায়ুর দেশ হিসাবে বিশ্বে দ্বিতীয়। আর রাজধানী ঢাকা বায়ু দূষিত শহরগুলোর মধ্যেও দ্বিতীয় অবস্থানে।
বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালে এ পর্যন্ত দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ২৯ হাজার ৪৭৬ (ওয়ার্ল্ডোমিটার-২৬ আগষ্ট,২০২৩)। অন্যদিকে প্রতি বছর শুধুমাত্র বায়ুদূষণেই মৃত্যুর সংখ্যা দেড় লক্ষাধিক। বৈশ্বিক বায়ুমান নিয়ে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার তাদের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০১৯ সালে দূষিত বায়ুর কারণে বাংলাদেশে ১ লাখ ৭৪ হাজার মানুষ মারা গেছে। সে বছরে অল্প বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ২০ শতাংশই ঘটেছে দূষিত বায়ুর কারণে। প্রতিটি শিশুর আয়ু ৩০ মাস করে কমে যাচ্ছে শুধু বায়ুদূষণের জন্য।
বাংলাদেশে একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের ৫টি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে, সেগুলো হলো: বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), এনও২, সিও, এসও২ ও ওজোন (ও৩)। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’ প্রকাশিত বৈশ্বিক বায়ুর মানসংক্রান্ত প্রতিবেদনে বিশ্বে ২০২২ সালে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর তালিকায় বাংলাদেশের নাম পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে পিএম–২.৫-এর মাত্রা ছিল ৬৫ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম। ১৭ মার্চ,২০২৩ সকাল ৯টায় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই)-এর সবশেষ আপডেটে দেখা যায়, ঢাকার স্কোর ১৫৭, যা অস্বাস্থ্যকর অবস্থা রয়েছে। ঢাকা ছাড়াও গাজীপুরের শ্রীপুরের বাতাসের মান ২৫৮, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। আর কুমিল্লার স্কোর ঢাকার সমান ১৫৭। নতুন এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। আদর্শ মাত্রার মধ্যে আছে মাত্র ১০টি জেলার বায়ুর মান।
বায়ুদূষণের শারীরিক ও মানসিক প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের দূষণ-প্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ বাসিন্দা বিষণ্ণতায় ভুগছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রা থেকে ১% দূষণ বাড়লে বিষণ্ণতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ২০ গুণ বেড়ে যেতে পারে। গবেষণায় বলা হয়, ঢাকায় সারা দিনে একজন যে পরিমাণে দূষিত বায়ু গ্রহণ করেন, তা প্রায় দুটি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতিকর।
জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক দূষণকারীগুলির মধ্যে রয়েছে কণা পদার্থ (PM), কার্বন মনোক্সাইড (CO), ওজোন (O3), নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO2) এবং সালফার ডাই অক্সাইড (SO2)। এই বিভিন্ন দূষণকারীর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। কিছু দূষণকারীর জন্য, এমন কোন প্রতিকার ব্যবস্থা নেই যার মাধ্যমে বিরূপ প্রভাব ঠেকানো সম্ভব হয়।
পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM) বলতে বোঝায় সালফেট, নাইট্রেট, অ্যামোনিয়া, সোডিয়াম ক্লোরাইড, ব্ল্যাক কার্বন, খনিজ ধূলিকণা বা পানির সমন্বয়ে গঠিত নিঃশ্বাসযোগ্য কণা। PM বিভিন্ন আকারের হতে পারে এবং সাধারণত তাদের অ্যারোডাইনামিক ব্যাস দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়, পিএম ২.৫ এবং পিএম ১০ নিয়ন্ত্রক কাঠামোতে সবচেয়ে সাধারণ এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগি।
পিএম ফুসফুসের গভীরে এবং রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করতে সক্ষম যার ফলে কার্ডিওভাসকুলার (ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ), সেরিব্রোভাসকুলার (স্ট্রোক) এবং শ্বাসযন্ত্রে প্রভাব পড়ে। দীর্ঘমেয়াদী এবং স্বল্প-মেয়াদী উভয় প্রভাবে কণার সংস্পর্শে কার্ডিওভাসকুলার এবং শ্বাসযন্ত্রের রোগ থেকে অসুস্থতা এবং মৃত্যু ঘটে। এটি বায়ু দূষণের সংস্পর্শে আসার স্বাস্থ্যের প্রভাবগুলি মূল্যায়নের জন্য সর্বাধিক ব্যবহৃত সূচক। বায়ুদূষণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত ঝুঁকির কারণ এবং এজন্য প্রতি বছর প্রায় ৭ মিলিয়ন মৃত্যু ঘটে।
নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO2) হল একটি লালচে-বাদামী গ্যাস যা পানিতে দ্রবণীয় এবং একটি শক্তিশালী অক্সিডেন্ট। NO2 এর পরিবেষ্টিত উৎসগুলি হচ্ছে শিল্প এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়াতে জ্বালানীর উচ্চ তাপমাত্রার দহন ও পরিবহনের জ্বালানী দহনের ফলে হয়।
নাইট্রোজেন অক্সাইডের (NOx) গৃহস্থালীর উৎসগুলির মধ্যে রয়েছে এমন জিনিস যা জ্বালানী পোড়ায় যেমন গ্যাস-কয়লা-কেরোসিন এমন চুলো ইত্যাদি। নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের প্রভাবে শ্বাসনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং শ্বাসযন্ত্রের রোগ বাড়িয়ে তোলে।
গ্রাউন্ড-লেভেল ওজোন (O3) ধোঁয়ার একটি প্রধান উপাদান। এটি পরিবহন ও শিল্প থেকে নির্গত ধোঁয়ার মধ্যে কার্বন মনোক্সাইড এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx) এর সাথে আলোক রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে গঠিত হয়। আলোক-রাসায়নিক প্রকৃতির কারণে, রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ার সময় ওজোনের সর্বোচ্চ মাত্রা দেখা যায়। অত্যধিক ওজোনের প্রভাবে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও ফুসফুসের কার্যকারিতা হ্রাস করে এবং ফুসফুসের রোগ হয়।
কার্বন মনোক্সাইড (CO) হল একটি বর্ণহীন, গন্ধহীন গ্যাস যা কাঠ, পেট্রোল, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং সাধারণ চুলা, খোলা আগুন, চুল্লির মতো কার্বনসিয়াম জ্বালানীর অসম্পূর্ণ দহনের ফলে উৎপন্ন হয়। পরিবেষ্টিত বাতাসে কার্বন মনোক্সাইডের (CO) প্রধান উৎস হল যানবহন।
কার্বন মনোক্সাইড ফুসফুসের টিস্যু জুড়ে এবং রক্ত প্রবাহে ছড়িয়ে পড়ে, যা শরীরের কোষগুলির জন্য অক্সিজেনের সাথে আবদ্ধ করা কঠিন করে তোলে। অক্সিজেনের এই অভাব টিস্যু এবং কোষের ক্ষতি করে। কার্বন মনোক্সাইডের সংস্পর্শে শ্বাস নিতে অসুবিধা, ক্লান্তি, মাথা ঘোরা এবং অন্যান্য ফ্লু-এর মতো লক্ষণ দেখা যায়। কার্বন মনোক্সাইডের উচ্চ মাত্রার প্রভাব মারাত্মক হতে পারে।
সালফার ডাই অক্সাইড (SO2) একটি বর্ণহীন গ্যাস যা পানিতে সহজেই দ্রবণীয়। এটি প্রধানত শিল্প এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানীর দহন থেকে উদ্ভূত হয়। SO2-এর প্রভাবে অ্যাজমা এতোটা ভয়াবহ হয় যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
ওজোন, দূষণ সৃষ্টিকারী কণা ও ধুলার কারণে কম বয়সীদের মধ্যে ১ থেকে ৪ বছর বয়সী শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে ৬০ থেকে ৯৫ বা এর বেশি বয়সীদের মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজের (জিবিডি) মতে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত রোগে মৃত্যুর হার ২০১৯ সালে আগের ২০ বছরের তুলনায় ৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের (একিউএলআই) মতে, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকার বাসিন্দারা গড়ে আট বছরের আয়ু হারাচ্ছেন।
বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রধান উৎস বা কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ধারাবাহিকভাবে বৃক্ষনিধণ, চলাচলের অযোগ্য যানবহন, কয়লানির্ভর বিদ্যুতকেন্দ্র, ইটভাটা, শিল্পকারখানা, সড়কের ধুলা এবং ভবন নির্মাণ। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি থেকে নির্গত কার্বনের পরিমাণও বেড়েছে। মূলত গাড়ির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, ভেজাল জ্বালানির ব্যবহার, ট্রাফিক–ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এমনটি ঘটছে।
শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরে এই অরাজকতার কারণে বায়ু দূষণ ঘটছে এমনটি নয়। ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য প্রায় ৩০ ভাগ দায়ী ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা অতি সূক্ষ্ম পদার্থ। ঢাকায় পরিবেশবিষয়ক একটি গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সার্বিকভাবে বায়ুদূষণের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে হলে বাস্তবায়নযোগ্য ও কার্যকর নীতিমালা তৈরি করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ীর ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে, যানবহনের ফিটনেসের বিষয়ে আরো কড়াকড়ি আরোপ করা, নির্মান কাজের সময় ব্যবহ্ত সামগ্রীর রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ হতে হবে, অবৈধভাবে চালু থাকা ইটের ভাটা বন্ধ করতে হবে। কয়লানির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির পেছনে বিনিয়োগ করলে বায়ুদূষণ কমবে, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি প্রশমিত হবে।