
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন এ অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়, তখন তারা ভারতবর্ষকে ভেঙে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি ভিন্ন রাষ্ট্র তৈরি করে যায়। ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তান একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়। বহুজাতিক এই রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতিসত্তাসমূহের অধিকার জন্মলগ্ন থেকেই উপেক্ষা করা হয়। রাষ্ট্রে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ আরোপের অশুভ প্রয়াসের ফলে জাতিসমূহের আকাঙ্ক্ষা অবহেলিত হতে থাকে। দমন-পীড়ন প্রসার লাভ করতে থাকে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হন। তারই পরিণতিতে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সব বিরোধী রাজনৈতিক দল ও স্বাধীনতা যুদ্ধে উত্থিত জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান কাঠামোর অধীনে নির্বাচিত গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের দিয়ে আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করে।
আক্ষরিক অর্থে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে ঘোষণা করা হলেও ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তান আমলের শাসন কাঠামোসহ সব আইন কানুন অব্যাহত রাখা হয়। যে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের জন্ম, সেই রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন কোনো রূপে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হলো না। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও ঘটল না কোনো মৌলিক পরিবর্তন। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠার যে আকাঙ্ক্ষা উত্থিত হয়েছিল, তা কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনগণ পেল না। প্রতিষ্ঠিত হলো রুশ-ভারতের ওপর নির্ভরশীল আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ সম্পৃক্ত এক নয়া উপনিবেশিক, আধা সামন্তবাদী রাষ্ট্র ও সরকার। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর রুশ-ভারতের পরিবর্তে সরকারের মধ্যে মার্কিন নির্ভরতা প্রাধান্য পেল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রায় ৫০ বছরে সামরিক-বেসামরিক শাসনের ধারাবাহিকতায় বৃদ্ধি পেয়েছে- দারিদ্র, বেকারত্ব, আর শ্রেণি বৈষম্য। সংকুচিত হয়েছে- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকারের সুযোগ। প্রসার ঘটেছে- দুর্নীতি, দুঃশাসন, দলীয়করণ ও লুটপাটতন্ত্রের। দেশি-বিদেশি শাসক-শোষক গোষ্ঠীর দুর্নীতি, লুটপাট আর ক্ষমতার স্বার্থে জনগণের বাক্-স্বাধীনতা ও সব গণতান্ত্রিক অধিকারকে সংকুুচিত করা হয়েছে।
বিভিন্ন কৌশলী পদক্ষেপ ও তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক’ ছলনার কারণে নয়া-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জনগণের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রকট দ্বন্দ্ব, যা সচরাচর দৃশ্যমান হয় না, উপলব্ধি করা যায়। বহু ক্ষেত্রেই নয়া-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের লুম্পেন বুর্জোয়া শ্রেণি দেশের জাতীয় সম্পদ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে নগ্নভাবে লুণ্ঠন করাসহ অভ্যন্তরীণভাবে কৃষক-শ্রমিক-জনগণের ওপর নির্মম শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও লুম্পেন বুর্জোয়াদের লুণ্ঠন ও শোষণের ক্ষেত্রটি সমার্থক হয়ে গেছে। জনগণ স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারছে যে, তারা আজ অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া, লুটেরা বুর্জোয়াদের দ্বারা দুর্নীতি ও তীব্র শোষণে জর্জরিত।
সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা কখনই উৎপাদনমুখী শিল্প বা উৎপাদনমুখী বিনিয়োগে পুঁজিকে ব্যবহার করতে দিতে চায় না। বাংলাদেশের সস্তা শ্রমের কারণে পোশাক শিল্পে জাতীয়ভাবে সাম্রাজ্যবাদী সহায়ক শিল্প গড়ে উঠেলেও, সেখানে বহুজাতিক পুঁজির উপস্থিতি ক্রমাগত বাড়ছে। এটা উল্লেখ করা বোধ হয় যৌক্তিক হবে যে, রফতানিকৃত পোশাক শিল্পের ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রায় ৭৫ শতাংশ মূল্যের মালামাল, ফ্যাব্রিক্স ও এক্সেসরিজ পোশাক রফতানির আদেশকারী দেশ কিংবা ওই দেশ কর্তৃক নির্ধারিত অন্য কোনো দেশ থেকেই আমদানি করার বাধ্যবাধকতা আছে। সাম্রাজ্যবাদী দেশের সহায়ক শিল্প বিবেচনায় ‘দর্জির’ ঠিকাদারি হিসেবে নিযুক্ত হওয়া শ্রম দাস ব্যতিরেকে এটাকে এদেশের ‘জাতীয় শিল্প’ হিসেবে গণ্য করা যায় না।
পোশাক শিল্পে একজন শ্রমিক সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করলেও বেতন দেওয়া হয় শুধু ওই টুকনই, যা দিয়ে সে খাদ্য কিনে আর ওই কয়টা দিন বেঁচে থাকবে শুধু তার মালিকের বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কাপড়টি ঠিকমতো সেলাই করে আরও মুনাফা বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে। বিদেশি ক্রেতা এবং আমাদের লুম্পেন মালিকরা যৌথভাবে ৪০ লাখ শ্রমিকের উদ্বৃত্ত মূল্য শুধু নিষ্ঠুরভাবে লুণ্ঠনই করছে না, শর্তানুযায়ী বিদেশি ফ্যাব্রিক্সসহ আরও অনেক মালামাল বিদেশ থেকে আমদানি করায়, সব দেশীয় শিল্পও ইতিমধ্যে ধ্বংসের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে। এরা প্রকৃত অর্থে বিদেশ থেকে কাপড় কিনে তা সেলাই করার জন্য শ্রমিক নিয়োগের ঠিকা নেয়। এদের কোন যুক্তিতে শিল্পপতি বলা হবে? এরা সাম্র্রাজ্যবাদী ও ধনিক দেশের নিয়োজিত শ্রমিক নিয়োগের ঠিকাদার নয় কি? যারা নিজেদের ‘শিল্পপতি’ বলে দাবি করছে এবং শিল্পপতির নাম ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে।
এখন আমরা গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার হাল হকিকতটা দেখে নেই। আজ বাংলাদেশের গ্রামের মাত্র ১৫ শতাংশ মালিকের হাতে রয়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ জমির মালিকানা, যার পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ ৬৬৬ হাজার ৮০৩ একর। তার মধ্যে মাত্র ০.০১৫ শতাংশ জমির মালিকের হাতে আছে প্রায় ৬.০ শতাংশ জমি; যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ লাখ ৬১ হাজার ৬২ একর। আর ৮৫ শতাংশের বেশি গ্রামীণ জনগণ ভূমিহীন হয়েছে; যাদের কোনো জমি নেই অথবা নামমাত্র জমি রয়েছে।
অতি সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে শেষ সম্বল ভূমিটুকু বেঁচে ভূমিহীনের সংখ্যা আরও ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে, তা ৯০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ভূমিহীন ও ক্ষেতমজুরের সংখ্যা গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের প্রায় ৬০ শতাংশ। সমীক্ষা অনুযায়ী ৩৫ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮৮ লাখ এবং তাদের জীবিকার প্রধান ক্ষেত্র কৃষি। তবে এ সংখ্যার সঙ্গে আয় ও ব্যয়ের এক বিরাট পার্থক্যের কারণে প্রায় সমসংখ্যক এসব পরিবারের সদস্যরাও অস্থায়ী মজুর হিসেবে শ্রম দেয়। সারাদেশের কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত প্রায় ১৬০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে এই ৮৮ লাখ মানুষের সঙ্গে উল্লিখিতসংখ্যক পারিবারিক অস্থায়ী শ্রমিকরাও কৃষি উৎপাদন ক্ষেত্রে তাদের জীবিকা অর্জন করেন।
বাংলাদেশ একটি কৃষি ও নদী নির্ভর সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ। ভূমি সংস্কার হয়নি বলে এবং কৃষিব্যবস্থায় আধুনিক পদ্ধতি অনুসৃত না হওয়ার ফলে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির আর্থিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নদী, বন্যা বা খরার ওপর প্রচণ্ডভাবে নির্ভরশীল। বার্ষিক উৎপাদনে সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করেই বলা যায়, এখনো কৃষি অথবা কৃষিখাতের সংশ্লিষ্টতা খাত থেকেই বার্ষিক আয়ের শতকরা প্রায় ৬০ শতাংশ অর্জিত হয়। সরকারি হিসাবে কৃষি খাতের এ অবদানের কথা স্বীকার করা না হলেও বার্ষিক জাতীয় উৎপাদনে ভূমিকা রাখে এমন অনেক উপাদান এবং অর্থকরী কার্যাবলির বিরাট একটি অংশই অর্জিত হয় কৃষি, খাদ্যপণ্য, ফল-ফলাদি, বনজ সম্পদ, হাঁস-মুরগি, মৎস্যসম্পদ, গবাদি-পশু অর্থাৎ উপরে বর্ণিত যাবতীয় কৃষিকাজ থেকেই।
কাজেই বার্ষিক জাতীয় আয়ের এ অংশটুকু অবশ্যই কৃষিখাতের আয়ের অংশ। মোটকথা কৃষি ও কৃষিসম্পৃক্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে এদেশে অবিরাম একটি মহা অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে। আর এ কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত থাকে প্রায় ১২ কোটি লোক। কাজেই অবধারিতভাবে বলা যায়, রাষ্ট্রের সবচেয়ে অর্থ আয়কারী খাত হলো- কৃষি খাত। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনিক দেশগুলো এবং তাদের এদেশীয় পদলেহী বুর্জোয়া লুটেরা পুঁজিপতি শাসক-শোষক শ্রেণির লোভাতুর দৃষ্টি সে দিকেই নিবদ্ধ।
এটা স্পষ্ট যে, কৃষি এবং গ্রামীণ অর্থনীতিই হচ্ছে- এদেশে প্রধান আয়করী খাত। এটা প্রতীয়মান যে, কৃষি এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে অচলায়তনের সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য কৃষি ব্যবস্থাকে আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করে ভূমি ব্যবস্থাকে ভেঙে চুরমার করে কৃষি ব্যবস্থার এক আমূল সংস্কার করতে এক সুতীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তখন শুধু কৃষকরাই মুক্তি পাবে না, এ দেশের ছাত্র-যুবক-নিপীড়িত মেহনতি জনতাও এক নিষ্ঠুর শোষণমূলক ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। আর তখন এ দেশে কায়েম হবে একটি সত্যিকার স্বাধীন গণতান্ত্রিক শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা। এ আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে ‘চাষ যার, জমি তার’ এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সব কৃষি ব্যবস্থাকে পর্যায়ক্রমে সমবায়ের আওতায় আনলে বর্ণাঢ্য অর্থনীতির এক নতুন বাংলাদেশের সৃষ্টি করা যাবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতা এ চেতনা নিয়েই অংশগ্রহণ করেছিল।
বি ডি রহমতুল্লাহ
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ