
আসিফ। ফাইল ছবি
সম্প্রতি চাঁদে ভারত মহাকাশযানের সফল অবতরণ ঘটেছে। শুধু এই উপমহাদেশই নয়, এই ঘটনা পুরো মানবজাতিকে আলোড়িত করেছে।
৪০ দিনের অভিযান শেষে চাঁদে মহাকাশযানটি অবতরণ করেছে ২৩ আগস্ট ২০২৩; বাংলাদেশ সময় ৬টা ৩৪ মিনিটে। এর আগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া), যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মহাকাশযান চাঁদে অবতরণ করেছে। তবে চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের অবতরণের দিক থেকে ভারতই প্রথম দেশ। ভারতের সাম্প্রতিকতম উৎকর্ষের নজির এই চন্দ্রযান-৩। ১৪ জুলাই অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে চন্দ্রযান ৩-এর যাত্রা শুরু হয়।
এর আগে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর উদ্দেশে রওনা হয়েছিল চন্দ্রযান-২। ওই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামার কথা থাকলেও শেষমুহূর্তে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ল্যান্ডার বিক্রম চাঁদে টাচডাউনের চেষ্টা করলে ব্রেকিং সিস্টেমে কিছু অসংগতি ধরা পড়ে এবং চাঁদের বুকে ভেঙে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় চন্দ্রযান ৩-এর পরিকল্পনা করা হয়। মূলত চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ১৪ দিন পর পর দিন-রাত হয়। ফলে পরিকল্পনা ছিল এমনভাবে ভোর হতে না হতে ল্যান্ডার বিক্রম চাঁদের মাটি স্পর্শ করবে। দরজা খুলে বিক্রমের পেটের ভেতর থেকে রোভার প্রজ্ঞান বেরিয়ে আসে। শুরু হয় এক কর্মযজ্ঞ। সৌরশক্তি দ্বারা চালিত হওয়ায় সূর্যের আলো থাকা পর্যন্ত প্রায় ১৪ দিন পর্যন্ত সে কাজ চালিয়ে গেছে। বহু তথ্য-উপাত্ত পাঠিয়েছে, অনেক সম্ভাবনা আরোপ করেছে। ভারতের গবেষকদের নিরলস প্রচেষ্টায় পৃথিবীর মানুষ চাঁদের দক্ষিণ মেরু সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে। এদিকে ১০ আগস্ট রুশ মহাকাশযান লুনা-২৫ শেষ ধাপে চাঁদের বুকে নামতে গিয়ে ভেঙে পড়ায় ভারতের এই অভিযান বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। এটা বাস্তবায়নে অর্থনৈতিকভাবে অনেক কম খরচ হয়েছে।
ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো এখন যুগান্তকারী প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছে। বর্তমানে ইউরোপ ও রুশ মহাকাশ সংস্থার তত্ত্বাবধানে চাঁদে স্থায়ী বসবাসের ঠিকানা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। বেসরকারিভাবে চাঁদ ও মহাকাশে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে অনেক কোম্পানি। মানববসতি স্থাপনের আশাবাদে ‘মুন ভিলেজ’ তৈরির পরিকল্পনাও করছেন তারা এবং সেটা থ্রিডি প্রিন্টারে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চাঁদে মানুষের জীবনধারণের উপযোগী বাসস্থানের অবকাঠামো তৈরি করার কাজে রোবট ব্যবহার করা হবে। আমরা ভালোভাবেই বুঝতে পারছি, এক সময় ‘চাঁদের শহর’ থেকেই মহাকাশের বিভিন্ন প্রান্তে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা হবে।
তবে সমস্যা হচ্ছে- চাঁদ অভিযানে পুরো মানবজাতিকে একীভূত দেখতে পাচ্ছি না বরং বিভাজন বাড়ছে। কেউ কারও তথ্য-উপাত্তকে শেয়ার করতে দিতে চাচ্ছে না, যা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির অন্তরায়। প্রত্যেক রাষ্ট্রের বিজয় পতাকা ওড়ানো হচ্ছে, সঙ্গে অন্তত জাতিসংঘের একটা পতাকাওতো দরকার, না হলে পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব কেমন করে হবে?
এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ, চাঁদে প্রথম মানব পদার্পণের ঘটনা। রাষ্ট্রসংঘের পরিবর্তে শুধু মার্কিন পতাকা লাগানোতে বিষয়টা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। তবু আর্মস্ট্রং-এর কণ্ঠ থেকে কিছু কথা বেড়িয়ে এসেছিল, যা মানবজাতির প্রতিনিধিত্বকারী বক্তব্য- ‘এটি একজন মানুষের জন্য ক্ষুদ্র একটি পদক্ষেপ; কিন্তু মানবজাতির জন্য বিশাল অগ্রযাত্রা।’
মূলত ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই অ্যাপোলো-১১ মহাকাশযানে মোট তিনজন চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছেন। মাইকেল কলিন্সকে কক্ষপথে মূল নভোযানে রেখে ঈগল চন্দ্রযানে আর্মস্ট্রং ও অ্যাডউইন বাজ অলড্রিন অবতরণ করেন। আর মাইকেল কলিন্স কক্ষপথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, যথাসময়ে তাদের আবার তুলে নেওয়ার জন্য। ঈগল থেকে বেরিয়ে চাঁদে দ্বিতীয় পা রেখেছিলেন অ্যাডউইন অলড্রিন। অলড্রিন চাঁদের বিস্তীর্ণ সৌন্দর্য দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘অভাবনীয় নির্জনতা’।
চাঁদে একটি প্রতিফলক রেখে এসেছিলেন নভোচারীরা, যা দিয়ে পৃথিবী থেকে লেজার লাইটের মাধ্যমে চাঁদের দূরত্ব পরিমাপ করা যায়। পায়ের ছাপ রয়েছে, তাদের ফ্লাগের প্রমাণও রয়ে গেছে। আরও অনেক ধরনের সন্দেহের অবসান ঘটানোর পরও বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির দুর্বলতায় অনেকেই একই প্রশ্ন তোলেন : ‘চাঁদে মানুষ রাখেনি পা’ বলে। বিশ্বাসও করেন অনেকে। বাণিজ্যের কারণে অনিয়ন্ত্রিত প্রাযুক্তিক বিকাশ মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে; বিজ্ঞানকে দেখেছে প্রযুক্তির মোড়কে জাদুর যন্ত্র হিসেবে। ফলে বিজ্ঞানের প্রক্রিয়া বা যৌক্তিকতা সমাজ নিতে পারেনি, আস্থাও গড়ে ওঠেনি।
অথচ চাঁদে মনুষ্যনির্মিত যন্ত্র পদার্পণের পর ৬০ বছরের পথ আমরা অতিক্রম করেছি। বিজ্ঞানের অভাবিত অগ্রগতি ঘটেছে। দেশের ঊর্ধ্বে উঠে পৃথিবীবাসী হতে পেরেছি। লাখো মানুষ শরণার্থী হয়ে জলে-স্থলে-মরুভূমিতে ঘুরে ফিরছে, দেশ বলে তাদের কিছু নেই, অথচ তারাতো পৃথিবীরই অধিবাসী। এদিকে চাঁদে যা পাওয়া যেতে পারে : পানি, সোনা, প্লাটিনাম ও দুর্লভ ধাতু; যে সম্ভাবনা চন্দ্রযান-৩ আরও ভালোভাবে ইঙ্গিত দিয়েছে। তাই বর্তমান প্রাযুক্তিক উন্নয়নে অনেক দেশ অভিযান চালাতে চায়।
জাপানের কোম্পানি আইস্পেস ‘চাঁদ-পৃথিবী পরিবহন প্ল্যাটফরম’ নামের একটি পরিকল্পনা নিয়েছে, যার মাধ্যমে তারা চাঁদের মেরুতে অভিযান চালাতে চায়। তা হলে অলড্রিনের চাঁদের সেই ‘অভাবনীয় নির্জনতা’ কি টিকে থাকবে নাকি পৃথিবীর এই একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহটি বাণিজ্যিক আর রাজনৈতিক জমি ও সম্পদ দখলের লড়াইয়ে পরিণত হবে?
স্নায়ুযুদ্ধের সময় মহাকাশ অভিযান শুরুর পর পরই মহাকাশের নানা বস্তুর মালিকানার বিষয়টি একটি ইস্যু হয়ে ওঠে। যখন নাসা তাদের প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশযান চাঁদে পাঠানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তখন জাতিসংঘে বহির্জগতের মহাকাশচুক্তি নামের একটি চুক্তিপত্র গ্রহণ করে। ১৯৬৭ সালের ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য। সেখানে বলা হয়, পৃথিবীর বাইরের মহাশূন্যে, চাঁদ এবং অন্য যেসব বস্তু রয়েছে, সেখানে কোনো দেশ দখল বা অন্য কোনোভাবে নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করতে পারবে না। ১৯৭৯ সালে চাঁদ ও মহাশূন্যের অন্যান্য বস্তুতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সমঝোতা প্রস্তাব আনে জাতিসংঘ, যেটি ‘মুন অ্যাগ্রিমেন্ট’ নামে বেশি পরিচিত। সেখানে মূল বিষয়গুলো ছিল- এসব কর্মকাণ্ড হতে হবে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে এবং কোনো মহাকাশ স্টেশন বানাতে হলে আগে জাতিসংঘকে অবশ্যই জানাতে হবে, কেন এবং কোথায় তারা সেটি বানাতে চায়।
উল্লেখ্য, চন্দ্রযানের ল্যান্ডারের নাম বিক্রম হওয়ার পেছনে ভারতের মহাকাশ সাফল্যের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। বিক্রম ১৯৪৭ সালে মহাকাশ বিজ্ঞানের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত ‘ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ সংস্থাই ইসরোর পূর্বসূরি। আরও বহু সংস্থার সঙ্গে জন্মলগ্ন থেকে জড়িয়ে রয়েছে বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের নাম। ল্যান্ডারের পেটের ভেতর ছিল রোভার প্রজ্ঞান। প্রজ্ঞানের ওজন ছিল ২৬ কিলোগ্রাম। রোভারটির নামকরণ হয়েছে ‘সংস্কৃত’ শব্দ ‘প্রজ্ঞান’ থেকে, যার অর্থ- প্রজ্ঞান বা জ্ঞান। এই জ্ঞান বৃহত্তর মানবসমাজের একীভূত হওয়ার প্রতীক হয়ে উঠুক।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা, সম্পাদক, মহাবৃত্ত