Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

হাসান হাফিজুর রহমান: স্মৃতি ও কবিতা

Icon

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৩, ১৬:০৮

হাসান হাফিজুর রহমান: স্মৃতি ও কবিতা

আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি

হাসান ভাইকে নিয়ে হয়তো আমার কোনো স্মৃতি নাই, আছে নিজেকে নির্মাণ করতে গিয়ে তাকে আমার স্মৃতির দুনিয়ায় টেনে আনা। সবটাই কাল্পনিক এক হাসান হাফিজুর রহমান যাকে আমি মনে করি ছিলেন। হতেও পারে, অথবা সবই সত্য। কিছু যায় আসে না। তিনি আমার জন্য সর্বকালেই থাকবেন এক। একই। আপনজন। 

দুই. ইউনিটিসিটির ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে (১৯৭৭ ) হঠাৎ করে পড়ুয়া জীবন শেষ হয়ে গেল, চাকরির প্রয়োজন দেখা দিল এবং জীবন একটি সম্পূর্ণ নতুন খেলায় ঠেলে দিল, যার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কেউ থাকেও না। চাকরি খোঁজা শুরু করলাম।

তিন. আমার বন্ধু মোরশেদ শফিউল হাসান-বাংলা বিভাগের ছাত্র-প্রথমে আমাকে ইতিহাস প্রকল্পের খবর দেয়। তার ওখানে চাকরি হয়েছে, আরও কয়েকজন ঢুকেছে। ‘ইতিহাস বিভাগের ছাত্র হিসাবে তোমার চান্স আছে।’ তার কাছ থেকে জানলাম কবি হাসান হাফিজুর রহমান ইতিহাস প্রকল্পের প্রধান ।

চার. তিনি শুধু সাহিত্যিক নন, একজন সাংবাদিক হিসেবেও বহুল পরিচিত । ‘দৈনিক বাংলাকে’ এক নম্বর করার পিছনে তার হাত অন্যতম প্রধান। পুলিশের গুলিতে যখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক দুই তরুণ মারা যায় ১৯৭৩ সালে, দৈনিক বাংলা পত্রিকা এই খবর জানিয়ে একটি টেলিগ্রাম প্রকাশ করে। এ কারণে উনার ও প্রয়াত তোয়াব খানের চাকরি যায় পত্রিকা থেকে। কিন্তু সাজা শাস্তি হয়নি। একজন প্রধানমন্ত্রীর অফিসে চলে যান আর হাসান ভাইকে মস্কো দূতাবাসে কূটনীতিক হিসেবে পাঠানো হয়। স্পষ্টতই তখনকার দিনকাল অনেক নরম ছিল, আজ হলে অন্য হাল হতো। তাও আবার সরকারি মালিকানার পত্রিকার পাতায় এই সব। তিনি ফিরে আসেন বছর দুয়েক পর, তারপর একসময় এই ইতিহাস প্রকল্পের দায়িত্ব পান।

পাঁচ. লাইন ঘাট বার করতে দুই দিন গেল আমার। তারপর প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে আমি পৌঁছে গেলাম হাসান হাফিজুর রহমানের অফিসে। মাহ্ফুজ ভাই উনার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘চাকরিটা দিতেই হবে।’ হাসান ভাই প্রথমে আপত্তি করেছিলেন কিন্তু শেষে মেনে নিলেন। আমি পরের দিন থেকে যোগদান করলাম। তখন জানিও না আমার গোটা জীবন চিরতরে পরিবর্তিত হতে চলেছে। আহা রে, যদি তারিখটি মনে রাখতাম।

ছয়. বন্ধনের সূত্র ইতিহাস চর্চা নয়, সাহিত্য 

হ্যাঁ, আমি একজন ইতিহাসবিদ হয়ে গেলাম, ভালো মন্দ যা-ই হোক এবং এটা লাইব্রেরির চেয়ার টেবিলে বসে নয়, হাতে কলমে শিখে। কিন্তু এটা যদি কাজের পরিসর হয়, মেধা প্রয়োগের পরিসর হয়, তবে আবেগের একটা জায়গা আছে-সাহিত্য। খুব ছোটবেলা থেকে আমি পাঠক। প্রতিদিন পড়েছি, ৫ থেকে ৫৫ বছর পর্যন্ত। অতএব দুদিন বাদে আলাপে যখন জয়েস বোর্হেস নিয়ে কথা বললাম, হাসান ভাই ভাবলেন নিশ্চয়, ছেলেটাকে চাকরি দেওয়া পুরাটা ভুল হয়নি। শুরু হলো গুরু-শিষ্যের আড্ডা। যেদিন বললাম শামসুর রাহমান ‘রৌদ্র করোটিতে’ বইতে ‘দুঃখ’ কবিতা আর ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার কাঠামো এক, তিনি বোধহয় প্রথম আমাকে সিরিয়াসলি নিলেন। যখন উনার কবিতা ও গল্প নিয়ে আলাপ করলাম, তখন মনের অন্দর মহলে জায়গা দিলেন আমায়। তার শ্রোতা নম্বর ওয়ান হয়ে গেলাম। 

সাত. আমার মনে আছে একদিনের কথা। অফিসে বসে আছি, তিনি ঘরে ঢুকলেন। আমাকে তিনি খুব গম্ভীর মুখে উনার ঘরে আসতে বললেন। আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, ব্যাপার কী? তিনি আমাকে দরজা লক করতে বললে আমি আরও ভড়কে গেলাম। নিশ্চয় চাকরি গন। তিনি তার চেয়ারে বসলেন এবং আমাকে বসতে বললেন। এর পর পকেট থেকে একটা কবিতা বার করে বললেন, “গত রাতে লিখেছি। বলো কেমন হয়েছে?” অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স কারে কয়!

আট. এটা একটি রুটিন হয়ে গিয়েছিল। আমি তার ‘শ্রোতা’, কবিতার সমঝদার ভোক্তা। এমনকি পরিবর্তনের পরামর্শও দিতাম, মাঝে মাঝে শুনতেন। এখন বুঝতে পারছি আমার স্ট্যাটাসটা কোথায় উঠে গিয়েছিল। ইউনিভার্সিটি করিডর থেকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবির শ্রোতা-উপদেষ্টা। অত বড় চাকরি আর করিনি কোনোদিন।

নয়. হাসান ভাইয়ের ডায়াবেটিস ছিল-এবং তিনি যে খুব নিয়ম মেনে চলতেন বলা যায় না। কিন্তু একদিন হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়। পিজিতে ভর্তি হলেন। দুই দিন পর অনুমতি পেলে দেখা করতে গেলাম। পাশে বসিয়ে বললেন, ‘বিছানায় যেদিন আনলো আমাকে আইসিইউ থেকে, সেদিন হঠাৎ করে বৃষ্টি নামলো। চারদিক ঠান্ডা, স্নিগ্ধ, সুন্দর। আমি বিছানায় শুয়ে আছি, এক আশ্চর্য শান্তিতে মনটা ভরে গেল। মনে হলো, আমার সময় হয়েছে, আমি প্রস্তুত। আমি মনে মনে বললাম, “আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক... (আমি প্রস্তুত, আমি হাজির... আমি হাজির...)” 

দশ. কয়েক দিন পর তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন কিন্তু শরীর তার ফেরেনি। অফিস করতেন কিন্তু ভালো ছিলেন না। ক্রমে খারাপ হতে হতে একসময় দেশে চিকিৎসায় যে কিছু হচ্ছে না সেটা বোঝা গেল। কারও প্রচণ্ড আগ্রহ দেখিনি উনার জন্য কিছু করার। একসময় সবাই ধরে নিলেন তিনি মারা যাচ্ছেন। শেষে বিদেশে পাঠাবার একটা ব্যবস্থা হলো, তাও অনেকটাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে, বিশেষ করে বেগম সুফিয়া কামালের চেষ্টায়।

এগারো. একদিন আমাকে বাসায় যেতে বললেন। হাঁটতে অসুবিধা, পা ফুলে ঢোল, কিডনি আক্রান্ত। আমাকে বসতে বললেন, আফসান, গত রাতে একটা কবিতা লিখেছি। ভাবলাম, তোমাকে শোনাই। তিনি পড়তে শুরু করলেন ‘মধ্য রাত আমার সাথে বড় বেশি কথা বলে...’ এটাই আমার শেষ স্মৃতি উনার কবিতা শোনার।

বারো. ২৫ অক্টোবর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে হাসান ভাইয়ের ওপর প্রকাশিত একটি বই নিয়ে আলোচনা করার এক আয়োজন করা হয়, আমি সেখানে ছিলাম। উনার মেয়ে এষা হাসানের সঙ্গে বহু বছর পর দেখা। আমি মাঝে মাঝেই হাসান ভাইকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেই নানা স্মৃতি নিয়ে। মনে পড়ল মস্কো থেকে আমাকে লেখা শেষ চিঠিটি। লিখেছিলেন ইতিহাস প্রকল্পের কাজ ঠিকঠাকভাবে শেষ করার জন্য আমি যেন কাজ করে যাই। চল্লিশ বছর পরও তিনি আমাকে যা করতে বলেছিলেন তা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মধ্য রাত আমার সাথে বড় বেশি কথা বলে... হাসান হাফিজুর রহমান, তার স্মৃতি, কবিতা।

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫