কপ২৮ ও আফ্রিকা জলবায়ু সম্মেলনের ভুলের পুনরাবৃত্তি না ঘটুক!

জাফর খান
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:৩৪

কেনিয়ার রাষ্ট্রপতি উইলিয়াম রুটো ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩-এ কেনিয়ার নাইরোবিতে কেনিয়াত্তা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে আফ্রিকা জলবায়ু সামিটে ভাষণ দিচ্ছেন। ছবি: রয়টার্স
দুবাইয়ে আর অল্প কিছুদিন পর শুরু হতে যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন কপ২৮। এক বছর পর আবারও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই সম্মেলনটি। বিশব্যাপী তাপমাত্রা কমিয়ে আনা, , গ্রীনহাউস গ্যাস গ্যাস নির্গমন হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে এবারের মঞ্চে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা আসবে বলে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সম্মেলনের পূর্ব মূহুর্তে জলবায়ু কর্মী আর সুশীল সমাজের ইতিবাচক দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে যাতে করে আসন্ন সম্মেলনে জলবায়ু নীতি পদ্ধতির একটি নায্যতা ভিত্তিক পরিবর্তন দেখতে পায় বিশ্ববাসী। এর ব্যত্যয় হলে কপ২৮ কোনো অর্থবহ অগ্রগতি ছাড়াই এক আষাঢ়ে গল্পের ডালিতে পরিণত হতে পারে।
ইতোমধ্যেই দেখেছি গ্লোবাল সাউথে ক্রমাগত উদ্বেগের মাত্রা উর্ধ্বমূখী। কারণ, যে ধনী রাষ্ট্র এবং জায়ান্ট কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কার্বন নিঃসরণের জন্য অধিক দায়ী তারা তাদের ব্যবসায়িক লাভে যেন প্রভাব না পড়ে এমন কিছু নীতিমালা প্রণয়নের জন্যই অধিকতর চাপ প্রয়োগ করবে। অন্যদিকে দরিদ্র যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে কম দায়ী তাদেরকে গুণতে হতে পারে ধনীদের ভুলের মাশুল!
অতীতে এরকমের প্রবণতা ইতোমধ্যেই পূর্ববর্তী জলবায়ু সমেলনগুলোতে পরিলক্ষিত হয়েছে। সম্প্রতি সেপ্টেম্বরের শুরুতে নাইরোবিতে হয়ে গেল আফ্রিকা জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন। সেখানেও এমন নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখা গেছে।
আফ্রিকা সম্মেলন দেশগুলোর সরকারসহ ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সুশীল সমাজের কয়েক হাজার প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। মূলত আফ্রিকা মহাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা, প্রশমন এবং কপ২৮’ র আগে জলবায়ু অর্থায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে একটি অভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছাতে সবার একমত হওয়ার একটি সুযোগ ছিল। অথচ সম্মেলন শেষে জারিকৃত চূড়ান্ত নথি নাইরোবি ঘোষণায় এমন ঐক্যমতের এবং আফ্রিকান দেশগুলোর স্বার্থ প্রতিফলনের চিত্র দেখা যায়নি।
যদিও এটা আশ্চর্যের ছিল না, কারণ উত্তরের দেশ এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে মিথ্যা সমাধানের আশ্বাস দেখিয়ে নামকাওয়াস্তে সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছিল একপেশি স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিকে মাথায় রেখে। ইতোমধ্যে আফ্রিকা মহাদেশের অনেক প্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তাদের পক্ষে সমর্থন আদায়ে স্বচ্ছতা এবং সমাধানের আহ্বান জানিয়ে আসলেও কার্যধারা প্রণয়নের সময় তারা ট্র্যাক থেকে অনেকটাই ছিটকে পড়েছিল।
ফলস্বরূপ নর্থ আফ্রিকান দেশগুলিকে তার গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এমন নীতির জন্য চাপ দেওয়ার পরিবর্তে সম্মেলনে এমন কিছু নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল যা আফ্রিকান দেশগুলোকে আরও ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। সেসময় কার্বন ক্রেডিট, অফসেটিং এবং ট্রেডিংয়ের মতো সমস্যাগুলো সমাধানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল যা মোটেই আফ্রিকানদের জন্য দরকারি নয়। বলা যায়, শান্ত্বনামূলক মিথ্যা কিছু সমাধানের পথ দেখানো হয়েছিল যা খুব একটা কার্যকরি ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ছিল না আফ্রিকার জন্য। আসলে তারা একটি নব্য ঔপনিবেশিক কৌশল গঠনের পথকে ত্বরান্বিত করে যেন নর্থের দেশসমূহের গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে। পাশপাশি আফ্রিকার ভূখণ্ড এবং মানুষের ওপর যাতে নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে।
কার্বন ট্রেডিং ধারণা হল এক জায়গায় কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন হবে আর তা পুষিয়ে নিতে অন্য জায়গায় "অফসেট" প্রক্রিয়ায় যেমন নতুন গাছ লাগানো বা প্রাকৃতিক পুনর্জন্মের জন্য বনরক্ষা ইত্যাদির মধ্যদিয়ে গ্লোবাল নর্থের বড় কার্বন নিঃসরণকারীকে দেশগুলোকে রক্ষার ব্যবস্থা। অন্যদিকে গ্লোবাল সাউথের প্রকৃতি-সমৃদ্ধ দেশগুলোকে বনাঞ্চল সংরক্ষণ বা সম্প্রসারণের জন্য অর্থ প্রদান করে শিল্প কারখানায় উন্নতি সাধনের পথ রুখে দেয়া। তবে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা তাদের জীবিকা ও খাদ্যের জন্য বন এবং জমির ওপর নির্ভরশীল।
কার্বন ট্রেডিং স্কিম মূলত কার্বন ক্যাপচারের নামে কার্যকরভাবেই জনগণকে তাদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করে অধিকার হরণের একটা পোক্ত ব্যবস্থা। এটি এরইমধ্যে ক্রমবর্ধমান কার্বন নির্গমন মোকাবেলায় ধনী রাষ্ট্র ও বড় প্রতিষ্ঠানের রক্ষাকবচ হতে চলেছে, যাতে করে তাদের কার্বন নির্গমনে খুব বেশি অসুবিধায় পড়তে না হয়। ক্যাপ এবং শেয়ার বর্তমানে জলবায়ু কর্মী এবং সুশীল সমাজের কাছে একটি বিকল্প মডেল হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। যেখানে আন্তর্জাতিক কার্বন ট্যাক্স আরোপিত করা হবে যাতে গ্লোবাল নর্থের দেশগুলো যারা কিনা জীবাশ্ম জ্বালানীর মাধ্যমে কার্বন নিষ্কাশন করে তাদের এবং এর প্রধান ভোক্তাদের প্রতিহত করতে পারে।
জীবাশ্ম জ্বালানি নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে এই করের আওতায় গ্লোবাল ‘গ্রীন নিউ ডিল‘ তহবিল বছরে ট্রিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় অর্থায়ন করতে সমর্থ হবে। আর এই তহবিলের ফলে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’র আওতায় ক্ষতি, অভিযোজন এবং প্রশমনের জন্য অনুদান প্রদানের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সহায়তার জন্য সার্বজনীন নগদ অর্থ দিয়েও সহায়তা করবে।
ক্যাপ এবং শেয়ার একটি এমন কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে যা জাতি ও রাষ্ট্রের উর্ধ্বেও কাজ করতে সক্ষম হবে। আর এটি জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রধান চাবিকাঠি এবং অনেক উপায়ে এটি দীর্ঘমেয়াদী সফলতা বয়ে আনতে পারে। এই মডেল বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত প্রগতিশীল হতে পারে। একইসঙ্গে আফ্রিকার সমস্ত দেশগুলোতে চরম দারিদ্র্য নির্মূলে স্থায়ী সমাধানের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। আর এ নীতিটি সার্বজনীন মৌলিক আয়ের পাশপাশি ন্যায়সম্মত একটি কর ব্যবস্থা আরোপে সহায়ক হতে পারে।
আমরা যখন কিনা কপ২৮-এর দিকে অগ্রসর হচ্ছি তখন কিছুটা থেমে একবার ভাবা উচিত যেন আফ্রিকা জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন কিংবা অন্যান্য জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলনগুলোর মত আর ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয়!
আসুন আমরা সমস্বরে কার্বনকে ‘না’ বলি। আমরা উত্তরের কাছে বন এবং জমি বিক্রি করতে নিরুৎসাহিত করি। আসুন আমরা জলবায়ু নায্যতাকে ‘হ্যাঁ’ বলি এবং জলবায়ু অর্থায়নের পথ সত্যিকার অর্থেই সুগম হোক এ লক্ষ্যে আওয়াজ তুলি।