আজ তেরশ্রী গণহত্যা দিবস: শহীদের তালিকায় নেই কোন নাম

আবু আলী সিনা
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৯

তেরশ্রী গণহত্যার স্মরণে স্মৃতিসৌধ।
আজ ২২ নভেম্বর। তেরশ্রী গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামস বাহিনীর ঘাতকরা তেরশ্রী গ্রামে এক নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। মাত্র ৫/৬ ঘন্টার বর্বরোচিত অপারেশনে তেরশ্রী গ্রামের সাবেক জমিদার ও তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষসহ ৪৩ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবং পরে গুলি করে হত্যা করে। জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায়চৌধুরীকে হাত পা বেঁধে পেট্রোল ঢেলে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ সময় তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমান এগিয়ে এসেছিলেন, জানতে চেয়েছিলেন নরঘাতকদের কাছে জমিদার বাবুকে হত্যা করা হচ্ছে কেন? নরঘাতকরা প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন সেদিন অধ্যক্ষের বুকে গুলি করে বেয়নেটের ফলা আমূল বিঁধিয়ে দিয়ে।
কিভাবে ঘটল হত্যাযজ্ঞঃ তেরশ্রী গ্রামটি মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানার শিক্ষা সংস্কৃতিতে অগ্রসরমান একটি গ্রাম। ১৯৪২ সানে প্রতিষ্ঠিত হয় মানিকগঞ্জ কলেজ তেরশ্রী, যা কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল, এখন যেটা সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ। এক সময় বাম রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল তেরশ্রী গ্রাম। ১৯৭১ সালেও ওই ধারাটি সূত্র ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ শুরু হয়েছিল ৭১ এর ২৫শে মার্চের পরেই। মানিকগঞ্জ শহর থেকে অন্তত ২০ কিঃ মিঃ দূরে তেরশ্রী গ্রাম।
১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর মধ্যরাতে ঘিওর থেকে এদেশীয় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সদস্যদের সহযোগিতায় সিধুনগর গ্রামের মধ্য দিয়ে শতাধিক পাকহানাদার বাহিনী ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তেরশ্রী গ্রামে পৌঁছায়।
তেরশ্রী গ্রামের মসজিদে তখন আযানের ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছিল ঠিক সেইসময় হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসররা তেরশ্রী গ্রামের সেনপাড়া কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে মিটিং করে। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে কিভাবে ‘অপারেশন ২২ নভেম্বর’ শুরু করবে।
শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর কেটে আস্তে আস্তে যখন পূর্ব আকাশে ফিকে লাল ফোটে ওঠে, ২২ নভেম্বরের কালভোরে তখনই হায়নার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে তেরশ্রী সেনপাড়ার মানুষের ওপর। শীতের সকালে অনেকেই তখনও বিছানায়। ঘুম ভাঙলেও লেপ কাঁথা মুড়িয়ে পরেছিলেন অধিকাংশ গ্রামবাসী। হঠাৎ গ্রামের একপ্রান্তে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে– আতঙ্কিত গ্রামবাসী কিছু বুঝবার আগেই হানাদার বাহিনী বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ শুরু করে। শুরু হয় ছোটাছুটি। আহাজারি আর আর্তচিৎকারে তেরশ্রী গ্রাম ডুবে যায় তখন নারকীয় তআণ্ডবএ; পাকবাহিনীর এদেশীয় সহযোগীরা দিনের আলো ফুটলে তাদের মুখে কাপড় দিয়ে ’মুখোশ’ পরে নেয়। কারণ তারা যাদেরকে হত্যা করছে তাদের মুখোমুখি হওয়ার মত সাহস তাদের ছিলনা। এছাড়াও ভবিষ্যতে সুবিধামত রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি তখনই তাদের মাথায় ছিল বলে ‘মুখোশ’ পড়েছিল সেদিন দেশীয় ঘাতকরা।
জ্বলতে থাকে বাড়ির পর বাড়ি। পাশাপাশি চলতে থাকে হত্যাযজ্ঞ। ঘাতকরা একে পর এক বেয়নেট চার্জ করে গুলি করে হত্যা করে ৪৩ জন গ্রামবাসীকে। বেলা ১২ পর্যন্ত চলে হত্যাযজ্ঞ। এরপর হানাদার বাহিনী ফিরে যায় ঘিওরে। পুরো তেরশ্রী গ্রামটি পরিণত হয় লাশের গ্রামে। পুরো গ্রাম জুড়ে বয়ে যায় রক্তের বন্যা। ওই সময় যারাই এই নারকীয় হত্যাকান্ড দেখেছেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। আমি ছিলাম দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া ৭/৮ বছরের দুরন্ত বালক, আরো অনেকের সাথে সেই ক্ষত-বিক্ষত লাশ, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শ্মশান করে দেয়া গ্রাম-বাজার ঘর-বাড়ি দোকানপাট অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলাম। পাকহানাদার বাহিনীর ভয়ে কোনো দূর গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলাম। মৃতদেহগুলো স্থানীয় লোকজন কোনোমতে সৎকার করে। অনেকটা গণকবরের মত।
১৯৯৮ সালের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কয়েকটি রাজনৈতিক দল, স্থানীয় কয়েকজন তরুণ এবং স্কুল শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় তেরশ্রীতে গঠন করা হয় একটি স্মৃতি পরিষদ। একই বছরে ২৭ ডিসেম্বর সেখানে একটি স্মৃতিসৌধের ফলক উন্মোচন করা হয়। ফলক উন্মোচন করেন শহীদ জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায়চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী গায়ত্রী দেবী চৌধুরানী। ১৯৯৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর তেরশ্রীতে আয়োজন করা হয় কলেজ একটি স্মৃতিচারণ সভা। তৈরি করা হয় কলেজ মাঠে শহীদ অধ্যক্ষ আতিয়ার মঞ্চ। প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র এবং মানিকগঞ্জের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের এবং স্থানীয় স্মৃতি পরিষদের সহযোগিতায় একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র তেরশ্রীতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়। কিন্তু পরে আর সেটি বাস্তবায়িত হয় নাই।
২০১২ সালে এই সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে তেরশ্রী হাই স্কুলের পাশে স্মৃতি ফলক উন্মোচন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব:) তাজুল ইসলাম, এবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হবে।
তেরশ্রী ট্রাজেডি দিবস এখনও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্থান পায়নি। ২৫ বছর পরেও পূর্ণ তালিকা সংগ্রহ করা হয়নি ৪৩ জনের, স্থানীয়ভাবে এ পর্যন্ত ৪৩ জনের মধ্যে ৩০ জনের নামের তালিকা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।
তারা হলেন– সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায়চৌধুরী, অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমান, স্থানীয় স্কুলের দপ্তরী মাখনচন্দ্র সরকার, যাদব চন্দ্র দত্ত, সাধুচরণ দাস, শ্যামল সূত্রধর, নিতাই চন্দ্র দাস, জগদীশ চন্দ্র দাস, সুধন্য চন্দ্র দাস, সুরেন্দ্রনাথ সাহা, প্রাণনাথ সাহা, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, সাধন কুমার সরকার, যোগেশ চন্দ্র দাস, রামচরণ সূত্রধর, রাধাবল্লভ নাগ, জ্ঞানেন্দ্র ঘোষ, যোগেশ সূত্রধর, মোঃ কছিম উদ্দিন, মোঃ গেদা মিয়া, একলাস মোল্লা, শ্যামাপ্রসাদ নাগ, নারায়ন চন্দ্র সুত্রধর, শচীন্দ্রনাথ গোস্বামী, যোগেশ দত্ত, গৌরচন্দ্র দাস, মোঃ তফিলউদ্দিন, মনীন্দ্র চন্দ্র দাস ও মোঃ তাজুদ্দিন।
লেখক: সাবেক বিজ্ঞান মিলনায়তন সম্পাদক, ডাকসু।