
আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি
সেদিন এক বন্ধু দুঃখ করে বলল যে, “বাঙালি সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আজ আর কেউ ‘বাঙালিয়ানা’-তে আগ্রহী নয়। আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি ছাড়া দেশ টিকবে কী করে? এক দিন ছিল যখন আমরা দলে দলে গান করতে করতে শহীদ মিনার যেতাম, পহেলা বৈশাখ পালন করতাম, হাজার বছরের বাংলা গান গাইতাম। রমনা তখন আমাদের ছিল। পহেলা বৈশাখ বাংলার প্রাণকেন্দ্র।” তার কথায় আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না, কারণ এখন মানুষ শহীদ মিনারে গেলে উদযাপনের চেয়ে কখন জ্যাম ঠেলে বাসায় ফিরতে পারবে সেটা নিয়ে বেশি চিন্তা করে। স্থান-কাল-পাত্র সব কিছু পাল্টে দেয়। আমাদের সংস্কৃতি।
দুই
পরিবর্তন শুধু হচ্ছে না, সাথে বাড়ছে বিভাজন, বিভক্তি। ফেসবুকে এর অনেক উদাহরণ। যেমন আজকাল প্রায় সব মানুষই ট্রল করে, ধার্মিক থেকে নাস্তিক, জঙ্গি থেকে সুশীল। আমরা অসহিষ্ণুতা বেছে নিয়েছি আত্মরক্ষার একটি অস্ত্র হিসেবে। একে অন্যকে সহ্য করতে ভয় পাই পরিসর হারানোর ভয়ে। এটাই এখন সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম সূত্র। গানটা শুনে গালি দেওয়াটা জরুরি। গানটা বড় না গালিটা বড়?
তিন
সংস্কৃতি সমাজের পরিবর্তনের সূচক। এটা শুধু পাল্টায় না, পরিস্থিতির কারণে এমন পাল্টে যায় যে চেনা যায় না। গান বাজনা কবিতা উপরি কাঠামোর বিষয়, মূল হচ্ছে সামাজিক ব্যবহার। অর্থাৎ বাঙালিয়ানা অনাদি কালের নয়, এটাও স্থানিক, কালীন। কোনো গান নয়, কেন গান গায়?
চার
কালচারকে পেঁয়াজের সাথে তুলনা করা হয়। গান, বাজনা, খাওয়া, পোশাক এমনকি ভাষা বা ধর্মচর্চা সামাজিক বাস্তবতার প্রকাশ। মূল বিষয় হলো জীবনের নানা তাগিদ মেটাতে কে কীভাবে ও কেন কোনো সামাজিক ব্যবহার বেছে নেয় বা নিতে বাধ্য হয়। মূল কথা আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা। তার মনস্তত্ত্বে নির্মাণ। বিপদে বা আনন্দে মানুষ কী করে, কেন করে, কীভাবে। ঠিকানা ‘ছায়ানটে’ নয়, সমাজের আচার ও নিয়মে।
পাঁচ
ডাচ নৃবিজ্ঞানী হফস্টেড এই বিষয় নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তার মতে, ৬টি মূল সূত্র আছে সামাজিক কালচারের। এই সূত্রগুলো সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে।
১, একটি সমাজ আর্থ-সামাজিক বৈষম্য কতটা মেনে নিতে প্রস্তুত।
২. সমাজ কি যুক্ত না ঢিলেঢালাভাবে সাজানো। ব্যক্তিরা শুধু নিজেদের এবং তাদের নিকটবর্তী পরিবারের যত্ন নেয়, না অন্যদেরও।
৩. সমাজ পুরুষত্ব কৃতিত্ব, বীরত্বের দিকে জোর দেয় নাকি নারীর মতো যত্নশীলতার দিকে, নরম না কঠোর সমাজ।
৪. সমাজ অনিশ্চয়তা পরিহার করে না ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। এরা কোনোভাবে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে।
৫. সমাজ কি ঐতিহ্য ভিত্তিক না বাস্তববাদী?
৬. সমাজ কি ভোগবাদী না সংযমবাদী? সামাজিক শাসন কেন্দ্রিক না উপভোগ কেন্দ্রিক?
এই মডেলটির ইতিবাচক বিষয় হলো, এটি সামাজিক আচরণভিত্তিক। তবে এটির ‘নারী-পুরুষ’ ভিত্তিক ধারণা বাস্তব নির্ভর নয়, আদি বিশ্বাস/ধারণাভিত্তিক। তা ছাড়া এটা বিশ্বায়ন এবং ডিজিটালাইজেশন যুগের আগে সৃষ্ট। যার ফলে বর্তমানের সাথে ফারাক লক্ষণীয়।
তবে তালিকাটি গবেষণা কাজ শুরু করতে কাজে লাগানো যায়, কিন্তু সবাইকে নিজ সমাজের বাস্তবতা থেকে সূত্র উদ্ধার করতে হবে।
বাংলাদেশের কী হাল?
আমি একটি গবেষণা প্রকল্পে জড়িত যারা সংস্কৃতির প্রধান উপাদানগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে। প্রথম ধাপে যে সব সূত্রগুলো পাওয়া গেছে তার চিত্র এ রকম-
১. মানুষ প্রথমে টিকে থাকার জন্য অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করে, তারপর আরামদায়ক জীবন যাপনের জন্য এবং শেষে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আকাক্সক্ষা দ্বারা চালিত হয়। তিন ধাপে তিন কিসিমের সংস্কৃতি চর্চা ও সামাজিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। গ্রামের সনাতনী ঐতিহ্য, বাঙালিয়ানা বা ধর্মীয় ভাবনা মূল নয়। জীবিকার নিরাপত্তা সন্ধান ও অধিক অর্জন প্রধান সামাজিক নিয়ন্ত্রক।
২. লোকেরা অভ্যন্তরীণ/সামাজিক/গৃহস্থালি পরিসরে পরিবর্তন এবং ঝুঁকি গ্রহণে আগ্রহী নয়, কিন্তু জীবিকার ক্ষেত্রে উচ্চ ঝুঁকির পক্ষে।
৩. সমাজ একই সাথে সামষ্টিক, গোষ্ঠী চালিত এবং পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে ব্যক্তিবাদীও বটে। পুরাতন নেটওয়ার্ক চলে গেলে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে কর্ম ও ভোগ কেন্দ্রিক নতুন সম্প্রদায় এবং গোষ্ঠী তৈরি হয়।
৪. প্রাতিষ্ঠানিক/সরকারি এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক/বেসরকারি কাঠামো বিচ্ছিন্ন নয়। কিন্তু একই সাথে আলাদা ও স্বায়ত্তশাসিত। অংশগ্রহণকারীদের লাভ, কম লাভ বা ক্ষতির আশঙ্কার উপর ভিত্তি করে সামাজিক সংযোগ বৃদ্ধি বা হ্রাস পায় একে অন্যের সাথে ।
৫. বর্ধিত আয়ের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ও গোষ্ঠীবদ্ধ সামাজিক সুবিধার ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে। পরিবারগুলো নিজেরাই বিভিন্ন প্রয়োজনগুলো অনেকটা মেটাতে পারে। এর ফলে সামাজিক নির্ভরতা ও বন্ধন হ্রাস পেয়েছে, যদিও নেটওয়ার্কিং বৃদ্ধি পেয়েছে।
৬. সমাজে লিঙ্গ ভিত্তিক মূল্যবোধগুলো এখন কম, কারণ মূল চাবিকাঠি যা অর্থনৈতিক পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে সেগুলো পাল্টেছে ও প্রথাগত লিঙ্গভিত্তিক ধারণা দুর্বল হয়ে পড়েছে। কারণ নারী শ্রম বাজারে অধিক প্রবেশ করছে এবং নিজেদেরকে সবল এবং রুজি অর্জনকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।
৭. রাজনৈতিক পণ্য হিসেবে ইতিহাসের আনুষ্ঠানিক প্রচার সত্ত্বেও লোকেরা যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মতভাবে অতীতের সাথে মোকাবিলা করে। লোকেরা বাস্তববাদী অর্থাৎ যারা ইতিহাস ব্যবহার বা প্রত্যাখ্যান করে যেটাতে তাদের সুবিধা হয়। চিরায়ত সংস্কৃতি ভাবনা দুর্বল হয়েছে।
৮. ভোগ প্রবণতা এবং সামাজিক ঐতিহ্য রক্ষা প্রবণতা, পরস্পরবিরোধী হলেও আরামে একসাথে বসবাস করে। সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য নানা ধরনের ‘চর্চা’ প্রচলিত। তবে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আচারের প্রদর্শন গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে ব্যক্তিগত জীবনে অনুশাসনের উল্টোটা চর্চা করে যদিও প্রকাশ্যে নয়। মানুষ সকল ধরনের আনুষ্ঠানিক এবং দৃশ্যমান আচার-অনুষ্ঠান বেশি পালন করতে আগ্রহী ।
বাংলাদেশিয়ানা?
সামাজিক বিভাজনগুলো একাধিক, সেটা শ্রেণি হোক বা নগর গ্রাম বা ঐতিহ্যগত লিঙ্গ বিভাজনের মতো। বাংলাদেশের উপরি কাঠামোর সাংস্কৃতিক চর্চা সর্বজনীনতা নয়, বৈচিত্র্যের দিকে ধাবমান।
সমাজ পাল্টাচ্ছে এবং একক সংস্কৃতি নয় একাধিক মিশ্র ধারা আসছে। নতুন মধ্যবিত্ত তৈরি হচ্ছে ব্যাপক হরে। বিশেষ করে অভিবাসনকে কেন্দ্র করে। তারা এই পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান শক্তি। তাদের সংখ্যা এক কোটির ওপর এবং তারা আর্থিকভাবে সবল। অতএব...
এই নতুন বাস্তবতা কি ‘বাংলাদেশিয়ানা’?
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক