Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

কথা ও কাজ

Icon

আবদুল লতিফ মাসুম

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬

কথা ও কাজ

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লোগো। ফাইল ছবি

জনগণ চাক বা না চাক নির্বাচন কমিশন আগামী ৭ জানুয়ারি ২০২৪ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ‘সাংবিধানিক’ বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়েছেন। ২৮ অক্টোবরের অপ্রিয় ঘটনাবলির পর বিএনপিকে ছাড়াই আওয়ামী লীগ নির্বাচনের সমস্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছে। ওবায়দুল কাদেরের বহুল কথিত এই খেলায় কোনো টিম খেলতে রাজি নয়। তাই তাদের খেলার সাথি জোগাড় করার জন্য নানা কৌশল অনুসরণ করতে হচ্ছে। ভয়-ভীতি, মামলা-হামলা এবং বস্তা বস্তা টাকা দিয়ে ব্যক্তি ও দল ক্রয়ের প্রতিযোগিতা চলছে। 

অনেক পুরনো কাল থেকেই বাঙালি জনগোষ্ঠীর সুবিধাবাদী চরিত্রের সুনাম আছে। আকবর আলী খানের সাম্প্রতিক গ্রন্থ ‘ছলনা জালের রাজনীতি’তে এর কিঞ্চিৎ বর্ণনা আছে। সম্রাট বাবর তার আত্মজীবনী ‘তুজুক-ই-বাবর’-এ উল্লেখ করেছেন, বাংগাল নামে যে দেশটি আছে সেখানে একজন পাগলও যদি লাফ দিয়ে বলে ‘আমি রাজা’, তাহলে তার সমর্থনেও লোক জুটে যায়। জনশ্রুতি আছে সুবেদার শায়েস্তা খান বাংলাদেশের জোয়ার-ভাটা দেখে জনচরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। এই আছে এই নেই- সে দেশ নাকি বিশ্বাসযোগ্য নয়। যা-ই হোক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ২৮ অক্টোবরের ঘটনাবলির পর একটি চমৎকার আহ্বান জানিয়েছেন। 

জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘কে কতদূর দৌড়াতে পারেন ও জনগণ কাকে ক্ষমতায় দেখতে চায়, জানতে আসুন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি।’ তিনি নিশ্চিত করেছেন আগামী নির্বাচন যে অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি বারবার নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমরা নির্বাচন করব। এ ক্ষেত্রে আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করব না। আমরা চাই, নির্বাচন কমিশন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করুক। তিনি বলেন, তাদের ভোট চুরি করার দরকার নেই, কারণ আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপও একই চিত্র তুলে ধরেছে। সরকারপ্রধান বলেন, তাই আমরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেব। তিনি দেশবাসীকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আপনি আপনার ইচ্ছেমতো ভোট দিতে পারেন। 

দুই
গ্রামবাংলার লোকেরা মজা করে বলে, রাজনীতির মধ্যে পলিটিক্স ঢুকছে। আবার কেউ কেউ ভিলেজ পলিটিক্সের উদাহরণ দেন। ভিলেজ পলিটিক্স মানে মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা বানানো। মামলা-মোকদ্দমা, অন্যায়-অত্যাচার ও প্রতারণা-প্রচারণা, এ সবই ভিলেজ পলিটিক্স। আওয়ামী লীগ ন্যাশনাল পলিটিক্সকে ভিলেজ পলিটিক্সে রূপান্তর করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্রামীণ পর্যায়ের নির্বাচনেও এরা ‘পলিটিক্স’ ঢুকিয়েছে। এর আগে কখনো ইউনিয়ন কাউন্সিলর নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয়নি। ২০১৫ সালের পর থেকে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন- ইউনিয়ন কাউন্সিল, উপজেলা পরিষদ ও জেলা কাউন্সিলের নির্বাচন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। তাই তো ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনের সময় স্লোগান শোনা গেছে, ‘চেয়ারম্যান ওপেনে মেম্বার গোপনে।’ অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের মতো চেয়ারম্যানের ভোটও প্রকাশ্যে নৌকায় দিতে হবে। আমার গ্রামের একজন সহজ-সরল মানুষ আমাকে বলেছিল, ‘আপনে কি আমাগো চেয়ারম্যানডা অইতে পারেন না?’ নিজেই উত্তর দিচ্ছে, ‘না, আপনে অইতে পারবেন না, আওয়ামীলীগ যে ভোট দিতে দেয় না। তবে আপনে মেম্বার অইতে পারবেন। অইলে মোগো উপকার অয় আর কি!’ রবীন্দ্রনাথের ‘ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলি’কে আওয়ামী লীগ বড় বড় অশান্তির জায়গায় পরিণত করেছে। যেখানে তারা ‘আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশঝাড় যেন ছিল তারা আত্মীয় হেন’- এখন তারা মারামারি, কাটাকাটি ও রাজনৈতিক ঝগড়াঝাঁটিতে গ্রামকে শত্রুতার ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। 

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই যে, যেখানে নগর থেকে, রাজধানী থেকে- লোকেরা রাজনীতি শিখবে, সেখানে উলটো গ্রামের লোকদের ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ঢুকে গেছে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে। পৃথিবীর কোনো দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে এ রকম লক্ষ লক্ষ মামলার কোনো উদাহরণ নেই। মিথ্যে মামলা, গায়েবি মামলা, সন্ত্রাসী মামলা, আজব মামলা, গজব মামলা আরও কত কী! এখন এই বাংলাদেশে নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে অন্তত ৫০ লক্ষ লোক মামলার বেড়াজালে আটকে আছে। পুলিশ গ্রামে গ্রামে গিয়েও তাদের গ্রেপ্তার করছে। প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি-জামায়াতের এমন কোনো সক্রিয় নেতাকর্মী নেই যে আতঙ্কে বসবাস করছে না। গোটা বাংলাদেশই যেন এক জেলখানা। 

২০১৪ সালে যখন ভোটবিহীন নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ এলো তিনি আশ্বস্ত করলেন ‘এটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন, শীঘ্রই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ সে নির্বাচন কখনোই অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০১৮ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমায় বিশ্বাস করুন।’ তিনি সে বিশ্বাসের কী জবাব দিয়েছিলেন আমরা দেখেছি। ২০২৪ সালের সমাগত নির্বাচন নিয়ে তারা নানা ধরনের খেলা খেলেছেন। ওবায়দুল কাদের আসলেই খেলা শব্দটিকে খেলায় পরিণত করেছেন। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্মম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল তাদের জন্য একটি সুবিধাজনক ব্যাসার্ধ নির্ণয় করেছে। ২৮ অক্টোবরের আগে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশনা দ্বারা পরিচালনার পরিবেশ ছিল না। একই সঙ্গে প্রশাসন ও পুলিশে দোলাচল সৃষ্টি হয়েছিল। বিচার বিভাগ সুপারসনিক গতিতে বিএনপি নেতাদের শাস্তি দিয়ে মহাপারঙ্গমতার পরিচয় দিচ্ছে। ২৮ অক্টোবরের আগে যে ভারসাম্যের ইঙ্গিত মিলছিল- তা এখন নষ্ট হয়েছে। এই সুযোগ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এখন তারা একটি নতুন কারসাজি শুরু করেছে, ভোট পেছানো। রাজনৈতিক সমঝোতা হলে এবং বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে নির্বাচন কমিশন পুনঃতফসিলের বিষয়টি বিবেচনা করবে। ওবায়দুল কাদেরের বহুল কথিত খেলা এটি। 

তিন
কাকতালীয়ভাবে এই মন্তব্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের অপূর্ব মিল লক্ষ করা যায়। ২৮ অক্টোবর থেকে ২৮ নভেম্বর ২০২৩ প্রতিদিনের সংবাদ এবং চ্যানেলগুলোর প্রচারিত প্রতিবেদন দেখলে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের যথার্থতা প্রমাণ হবে। তিনি খেলোয়াড়ের হাত-পা বেঁধে তাকে বলছেন দৌড়ান। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এমন কোনো নেতা বাকি নেই যারা তথাকথিত দরকষাকষিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। বিএনপিকে উপদেশ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। কখনো বলছেন, আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাদের অংশগ্রহণ করা উচিত। আবার কেউবা শক্তিশালী বিরোধী দল হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তার মানে হচ্ছে বিএনপি বিরোধী দল হওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছে। চিরকালই ক্ষমতায় থাকবে আওয়ামী লীগ। এর দ্বারা তারা কয়েকটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। প্রথমত পাশ্চাত্যকে তারা দেখাতে পারবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে। দ্বিতীয়ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ রয়েছে। তৃতীয়ত তাদের ক্ষমতায় আরোহণকে আইনানুগ দেখাতে পারবে। চতুর্থত তারা যে সংবিধান সংবিধান বলে চিৎকার করছে তার সারবত্তা প্রমাণ করতে পারবে। পঞ্চমত নির্বাচনী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাস্তবতা নাকচ করতে পারবে। 

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আওয়ামী লীগ কিছু দলছুটকে রাজি করাতে পেরেছে। যারা বলছে, বিএনপির নির্বাচনের বিকল্প নেই। তারা তাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নেতিবাচক কথাগুলোকে ইতিবাচক টোনে বলছেন। তারা বলছেন বিএনপি ছাড়া আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এককভাবে লড়ার কারও ক্ষমতা নেই। তারা বিএনপির স্থানীয় নেতৃত্বকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তোষামোদি, খোশামোদির মাধ্যমে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে মুক্ত করার অপস্বপ্ন দেখাচ্ছে। বিএনপির অপভ্রংশ এনপিপি নামের দলটি ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। গোটা জাতির সামনে এটা পরিষ্কার যে, সরকার বিএনপির বিভাজন, দরকষাকষি, ভীতি ও লোভ দেখিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন সম্ভব করার পাঁয়তারা কষছে। তবে ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’-দিল্লি এখনো অনেক দূর।

লেখক: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, Mal55ju@yahoo.com

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫