
জিয়াউদ্দীন আহমেদ। ফাইল ছবি
বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত অবস্থায় ১৯৯৮ বা ১৯৯৯ সালে আমি লালদীঘি ময়দানের উত্তর পাশে হাবিব ব্যাংক বা ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম শাখা পরিদর্শন করি। শাখা ব্যবস্থাপক পাকিস্তানি, আলাপ আলোচনায় ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। দুপুরে ভাত খাওয়ার টেবিলে হালকা কথাবার্তার মধ্যে শাখা ব্যবস্থাপক বললেন, ‘স্যার, পাকিস্তানে এখনো নবজাত শিশুর কানে আমরা আজান দেওয়ার পাশাপাশি শিশুকে ভারতবিরোধী হওয়ার কথা বলি।’ ভারতবিরোধিতা বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানেরাও করেন, যার উলঙ্গ প্রকাশ ঘটেছে বিশ্ব ক্রিকেটে ভারতের পরাজয়ের পর।
খেলায় ভারতকে সমর্থন করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, ভারতের পরাজয়ে আনন্দ করা যাবে না তাও কিন্তু নয়। তাই বলে আনন্দ-উল্লাসে বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দেওয়াও যথার্থ বলে মনে হয় না। ভারতের পরাজয়ে আমরা ‘ঈদ’-এর আনন্দ উপভোগ করব কেন? ভারতের বিরুদ্ধে ‘কলাগাছ’কে সমর্থন দেওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠবে কেন? বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে কেবল একাত্তর দিয়ে বিবেচনা করলে ভারত ভুল করবে। একাত্তরে ভারত আমাদের এক কোটি বাঙালিকে আশ্রয় দিয়েছে, ১১ হাজার ইন্ডিয়ান সৈন্য আমাদের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে, ভারতের সেনারা প্রাণ না দিলে হয়তো আমাদের অবস্থা হতো গাজার হামাস বা পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের মতো, ধুঁকে ধুঁকে ৭৫ বছর ধরে যুদ্ধ করতে হতো। সবই সত্য। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরাও ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাবে- এমন প্রত্যাশা করা ঠিক নয়।
‘পাকিস্তান ভাঙার’ জন্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা দায়ী করে ভারতকে। তারা মনে করে ভারত নিজ স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সমর্থন দিয়েছে। হিন্দুবিদ্বেষের চরম বহির্প্রকাশ দেখেছি ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়; তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেক হিন্দুকে গুপ্তচর হিসেবে গণ্য করা হতো, হিন্দুরা যে পাকিস্তানের নাগরিক তা বাঙালি মুসলমানদের আচরণে মনেই হতো না। গুপ্তচর নাম দিয়ে আমাদের এলাকার বহু হিন্দুকে তখন পুলিশের হাতে তুলে দিতে দেখেছি। তবে হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ প্রথম শুরু হয় ১৯৪৬ সালে। মুসলিম লীগের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণায় ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’ হয়ে গেল; এই দাঙ্গায় কলকাতায় যত মানুষ খুন হলো, যত সম্পত্তি ধ্বংস হলো, অতীতে তার নজির মেলে না। মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস মেনে নিল যে, দেশভাগই একমাত্র সমাধান। এই দাঙ্গার মাধ্যমে হলো হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে হিংসার গোড়াপত্তন।
যে মানুষগুলো প্রতিবেশী হয়ে যুগ যুগ ধরে সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাস করেছে, সেই মানুষগুলোই ধর্মের ভিন্নতায় এক মুহূর্তে পরস্পর পরস্পরের শত্রু হয়ে গেল, একজন আরেকজনের কল্লা কেটে উল্লাস করল। ভারতবর্ষে বিভাজিত ধার্মিকদের রক্তের এই হোলি খেলা আর থামেনি। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল, দুটি ধর্মের লোকদের জন্য আলাদা আলাদা ভূমি বরাদ্দ হলো, বাপ-দাদার ভিটে ত্যাগ করে শুধু ধর্মের কারণে ভিন দেশে অজানা পরিবেশে নতুন করে ঘর বাঁধতে হলো।
হাজার হাজার পরিবার ঘটিবাটি নিয়ে হিজরত করল, কিন্তু ভারতকে মুসলমানশূন্য বা পাকিস্তানকে হিন্দুশূন্য করা গেল না। এজন্যই মাওলানা আবুল কালাম দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘোরবিরোধী ছিলেন। দ্বিজাতি তত্ত্ব হচ্ছে, হিন্দু এবং মুসলমান ভিন্ন জাতি, তারা এক সঙ্গে একই ভূমিতে বাস করতে পারে না।
ভারতবর্ষ ভাগের সময় সৃষ্ট এই ঘৃণা ও বিদ্বেষ দিন দিন বংশ পরম্পরায় তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। ভালো-মন্দ নির্বিশেষে ভারতবিরোধিতায় কিছু বাঙালি বিনা কারণে বেশ আনন্দ পায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত নাজেহাল হলে, চীন ধমক খেলে, নেপাল বা মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের বন্ধন শিথিল হলে, ক্রিকেট খেলায় হেরে গেলে তারা খুশি হয়, ‘পৈশাচিক’ উল্লাসে মেতে ওঠে এবং এভাবে তারা ‘পাকিস্তান ভাঙার’ প্রতিশোধ নেয়। প্রকৃতপক্ষে তারা ভারতের সাহায্যে সেক্যুলার বাংলাদেশের জন্ম মেনে নিতে পারছে না। এই মেনে না নেওয়াটা তারা প্রকাশ করে বাবরি মসজিদ, ফারাক্কা বাঁধ, করিডর আর সীমান্ত হত্যার ঘটনাকে হাইলাইট করে। এই সকল ঘটনার কথা বলে ভারত বিরোধিতার নেপথ্যে যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব আছে তা তারা আড়াল করতে চায়। এই সকল কর্মকাণ্ডের জন্য ভারতের সমালোচনা হতেই পারে, কিন্তু এই সকল কর্মকাণ্ড কখনো পাকিস্তানের ধর্ষণ আর গণহত্যার সমতুল্য নয়।
ভেবে আশ্চর্য লাগে, যে দেশটি বাংলাদেশের গণহত্যা এবং অসংখ্য নারীর ধর্ষিতার দায়ে দণ্ডিত সেই পাকিস্তানের জয়ে এ দেশের কিছু মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়, উচ্ছ্বসিত হওয়ার পেছনে আবার হাজার খানেক যুক্তি দাঁড় করায়। পাকিস্তানপন্থি বাঙালিদের কেউ কেউ এতটাই ধর্মান্ধ যে, পাকিস্তানের পতাকা, জার্সি নিয়ে বাংলাদেশ ভার্সেস পাকিস্তান খেলায় বাংলাদেশের মাটিতে, নিজের দেশকে সমর্থন না করে পাকিস্তানকে সমর্থন করে।
যারা বাংলাদেশবিরোধী তারা ভারতবিরোধী হবে না তা শুভেন্দু বাবু আশা করেন কেন? ‘পাকিস্তান ভাঙার’ কারণে সৃষ্ট ক্ষোভের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধর্ম। বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশে ধর্মান্ধ উগ্রপন্থিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। ভারতের গেরুয়া পোশাকের রাজনৈতিক আন্দোলন হিন্দু মৌলবাদীদের উগ্র হতে ইন্ধন জোগাচ্ছে। সেই আন্দোলন সংক্রামক রোগের মতো বাংলাদেশের উগ্র ধার্মিক মুসলমানদেরও আক্রান্ত করেছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ওয়াজ। কিছু ওয়াজি মাওলানা যেভাবে হিন্দু এবং তাদের দেবদেবী নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ও অশালীন বক্তব্য দেয় তা শ্রোতাদের হিন্দুবিদ্বেষী করে তুলছে। চীনপন্থিরা শুধু ধর্মবিদ্বেষী নয়, ভারতবিদ্বেষীও, কারণ ভারত চীনের শত্রু। চীনপন্থিরাও তাই ভারতের পরাজয়ে আনন্দ পাওয়ার কথা।
নাস্তিক আর উদার মানসিকতার লোক ছাড়া প্রায় সব লোকেরই সম্প্রদায়প্রীতি রয়েছে। সম্প্রদায় প্রীতির কারণেই ভিন দেশের ভিন জাতির মোঘল সম্রাটদের আমরা প্রশংসা করি। তুর্কি-আফগান সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ১৭ জন অশ্বারোহী দিয়ে লক্ষ্মণ সেনকে তাড়ালেন, আমরা এই বিজয়ে গর্ব বোধ করি; লক্ষ্মণ সেনের পেছনের দরজা দিয়ে পালানোর দৃশ্য কল্পনা করে আমরা খুশি হই। কারণ একটাই এবং তা হচ্ছে সম্প্রদায়প্রীতি। বস্তুত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রভাবই অনেক বাঙালির মধ্যে নেই, অনেকের থাকলেও তাদের ভারতবিদ্বেষ যায়নি।
কিন্তু ভারতে চিকিৎসা নিলে ক্রিকেট খেলায় ভারতকে সমর্থন করবে এই উপলব্ধি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কেন হলো জানি না। বাঙালি মুসলমানের ভারতবিরোধিতার আরও একটি কারণ রয়েছে, এবং তা হচ্ছে রাজনীতি। এ দেশের হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে বেশি পছন্দ করে। তাই আওয়ামী লীগ বিরোধী মানুষগুলো হিন্দুবিরোধী। ভারতও আওয়ামী লীগকে বেশি বিশ্বাস করে, এটাও আওয়ামী লীগ বিরোধীদের রাগের কারণ। এ ক্ষেত্রে ভারত নিজের স্বার্থেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে; কারণ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ভারতের বিচ্ছিন্নবাদী সশস্ত্র গ্রুপগুলো সক্রিয় ছিল, তারা ক্ষমতায় এলেই বাংলাদেশে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসের তৎপরতা বেড়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেই ভারতীয় সশস্ত্র গ্রুপের জন্য আনা কয়েক ট্রাক অস্ত্র জব্দ করা হয়েছিল। এ ছাড়াও বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ বিরোধীদের নাখোশ করেছে এবং তা ক্রিকেট খেলার মধ্যে প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের জনমানসের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। কারণ ধীরে ধীরে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক রূপ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ভারত এবং বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ধর্মে আচ্ছন্ন, তারা ধর্ম দিয়েই সব কিছু বিচার করে। খেলা নিয়ে বিরোধিতা বা সমর্থন অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু তা যদি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচ্য হয় তাহলে তা শঙ্কার কারণ, যা সমূলে উৎপাটন হওয়া জরুরি।
লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।