Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

বিশ্ব অর্থনীতির ক্রান্তিকালে চীনের উত্থান

তথ্য বিকৃতি অথবা বাণিজ্য কৌশল

Icon

গাজী তানজিয়া

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২০, ১৬:৩৮

বিশ্ব অর্থনীতির ক্রান্তিকালে চীনের উত্থান

করোনা মোকাবেলা ছাড়াও বিশ্ব মিডিয়া এখন যে বিষয়টি নিয়ে সরব তা হলো, করোনা আতঙ্কের জেরে গোটা বিশ্বের একাধিক শেয়ার মার্কেট যেখানে ধরাশায়ী সেখানে চীনের মার্কেটের অবাক করার মতো পরিসংখ্যান। করোনাভাইরাস আদৌ কোনো দেশের তৈরি জৈব অস্ত্র কি না, তা নিয়ে জল্পনা উঠতেই বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে, এটা কোনো ল্যাবে তৈরি হয়নি। এ ভাইরাস থেকে সেরকম কোনো প্রমাণ এখনো মেলেনি। তবে এই ভাইরাসের হানায় যেখানে বিশ্বের একের পর এক দেশের অর্থনীতির পতন হচ্ছে এবং শেয়ার মার্কেট ধসে যাচ্ছে, সেই পরিস্থিতিতে চীন নিজের ধসে যাওয়া শেয়ার মার্কেটকে চাঙ্গা করে তুলছে করোনা হানার পর থেকেই। এটা কীভাবে সম্ভব হলো, তা নিয়ে রহস্য দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এ সম্পর্কে দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী স্লাভোই জিজেক এ সময়ে চীনের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে নাকোচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘সেখানে যেহেতু গণতন্ত্র নেই তাই তথ্য বিকৃতি ঘটতে পারে। তিনি বলেছেন সেখানে একজন জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ দরকার।’

তথাপি চীনের ভাষ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বরে চীনের সাংহাই কম্পেজিট ইনডেক্স ২,৯১৫ পয়েন্টে ছিল। তখনো অবশ্য চীন করোনাভাইরাস হানার খবর প্রকাশ্যে আনেনি সেভাবে। এরপর করোনা আতঙ্ক দানা বাঁধতে থাকে। পরে ১৩ জানুয়ারি চীনের সাংহাই কম্পোজিট ইনডেক্স পৌঁছে যায় ৩ হাজার ১১৫ পয়েন্টে। এরপর চীনের করোনা হানা নিয়ে বিশ্বজুড়ে ত্রাস ছড়ায়। যার ফলে অল্প পরিসরে সাংহাই কম্পোজিট ইনডেক্স পড়ে যায় ৩ হাজার ৯৫ পয়েন্টে। অথচ এতবড় বিপর্যয়ের পর চীন গত সপ্তাহেই শেয়ার মার্কেট চাঙ্গা করে সাংহাই কম্পোজিট ইনডেক্স রাখতে পেরেছে ২০ হাজার ৭২২ পয়েন্টে। নিঃসন্দেহে যা চীনের অর্থনীতিতে বড় দিক। অন্তত করোনা আক্রমণে যখন সমস্ত অর্থনীতি ধসে যাচ্ছে সেই সময়ে। অথচ করোনাভাইরাস আতঙ্ক শুরু হওয়ার পর থেকে একের পর এক দেশ নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে বিশ্ব থেকে। স্টেডিয়ামের খেলা থেকে শুরু করে বড় বড় সব বৈশ্বিক আয়োজন বন্ধ হয়ে যাওয়া। স্কুল, কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমে আসা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার জন্য লোকসান বাড়ছে বিশ্বের বড় বড় এয়ারলাইন্সগুলোর। ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে বিশ্বের সব বড় বড় প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিনই ধস নামছে প্রধান সব শেয়ারবাজারে। জে পি মর্গান বলেছেন, পরপর আগামী দুই প্রান্তিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দেবে। 

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সংগঠন ওইডিসি জানিয়েছে, চলতি বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১৯ সালের তুলনায় অর্ধেক কমে আসবে। ওইডিসি সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাঞ্জেল গুরিয়া এটিকে একবিংশ শতাব্দীর সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ‘ধাক্কা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, এই সংকট এখন মজুরিতে চলেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে, বিশ্বজুড়ে সরবরাহ চেইন নষ্ট হয়ে গেছে। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় হলেও যে কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হচ্ছে, তাতে অর্থনীতি এক নজিরবিহীন ‘ডিপফ্রিজ’ অবস্থায় চলে যাচ্ছে। সেখান থেকে উত্থান সহজ হবে না। সম্ভবত অর্থনীতি আর আগের অবস্থায় ফিরে আসবে না। আর অন্যদিকে এমন বহু অধ্যায়ের পর গত কয়েক দিন আগেই চীন জানিয়েছে, তারা তাদের বাজারে ১৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (লিক্যুইডিটি ওয়ার্থ) বিনিয়োগ করতে পেরেছে। যা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, চীনের শেয়ার মার্কেট উত্থান পতনের মধ্য দিয়েও পোক্ত অবস্থানে আছে। যেখানে অর্থনীতি ঘিরে আতঙ্ক জার্মান থেকে জাপানে। ভারতীয় মুদ্রা ক্রমাগত পতনের দিকে যাচ্ছে। আমেরিকার নাগরিকদের মধ্যে আত্মরক্ষার্থে অস্ত্র কেনার ধুম পড়ে গেছে। এশিয়ার শেয়ার মার্কেটগুলোতে কার্যত রক্তস্নান চলছে। তেমন পরিস্থিতিতে চীনের বহাল তবিয়তে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় চীনের শেয়ারবাজার এতটাই পোক্ত জায়গায় পৌঁছেছে, যা বিনিয়োগকারীদের কাছে স্বর্গ হিসেবে দেখা দিয়েছে। করোনা মোকাবেলায় চীন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক করোনা শনাক্তকরণ কিট সরবরাহের মাধ্যেমে, মাস্ক রফতানির মাধ্যমে সচল রাখছে (যদিও তা ত্রুটিপূর্ণ)। তবুও এর মধ্যে রয়েছে পুঁজি রফতানির বাণিজ্য সচল রাখার এক সুগভীর আগ্রাসী কৌশল।

সমাজতন্ত্র বিষয়টিকে চীন তাদের নিজস্ব কায়দায় সংজ্ঞায়িত করেছে। চীনের মতো পুঁজিবাদী সমাজতান্ত্রিক দেশে যে ধরনের বাণিজ্য বা রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করা সম্ভব, কোনো গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে হয়তো তা সম্ভব নয়। 

তাইতো সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মানুষ কর্মহীন হতে পারে করোনা হানায়। সেই পরিস্থিতিতে চীনকে ঘিরে ব্যবসায়িক বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আর সে কারণেই গোটা বিশ্বের তীক্ষ্ণ নজরও চীনের দিকে। যে দেশ করোনার আঁতুরঘর হিসেবে পরিচিত তারা কীভাবে এত বড় সংকটেও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে ফেলল? যেখানে বাকি দেশগুলো ধরাশায়ী! 

আজ এই বিশ্ব মহামারির কালে দর পতনের কারণে বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার কব্জায় নিচ্ছে চীন। অনেকের ধারণা, সারাবিশ্বের পুঁজির দখল নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যের মোড়ল হয়ে উঠতে চায় তারা। পুঁজির মোহে হোক, তথ্য গোপন করে হোক, যে কোনো কারণেই এমন কিছু ঘটে থাকলে ইতিহাস সেটা ক্ষমা করবে না। 

সেক্ষেত্রে স্লাভো জিজেক যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা আমলে নিলে হয়তো বিশ্বে অন্যরকম কিছু ঘটতে পারে। তিনি বলছেন, ‘আমাদের উচিত পুঁজিবাদকে একটু ভিন্নভাবে মোকাবেলা করা। কীভাবে সেটা? পুঁজিবাদের কিছু ইতিবাচক কলা-কৌশল রয়েছে, সে সব কলা-কৌশলের সঙ্গে সমাজতন্ত্রকে সমন্বয় করে সমন্বিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা শুধু করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের জন্যই নয়, বরং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সংকটকালেও এই সমন্বিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা দরকার।’

সুতরাং এ ক্ষেত্রে বলা যায়, করোনা-উত্তরকালে আমরা হয়তো এক ভিন্ন বিশ্ব দেখতে পাবো। যেখানে পৃথিবী ভেদাভেদ, দখলদারিত্ব আর যুদ্ধের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকবে না। হয়ে উঠবে এক সমন্বিত বিশ্ব।

গাজী তানজিয়া

কথাসাহিত্যিক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫