Logo
×

Follow Us

মুক্তবচন

বিজয় দিবস: বাঙালির বিজয়গাথার স্বাক্ষর

Icon

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:০১

বিজয় দিবস: বাঙালির বিজয়গাথার স্বাক্ষর

মহান বিজয় দিবস। প্রতীকী ছবি

১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। এই বিজয় দিবসে আমরা উপনীত হয়েছিলাম ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করে ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে। এর সঙ্গে আমরা হারিয়েছি আমাদের অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষজনকে।

আসলে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরো সময়জুড়েই আমরা অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে যেমন হারিয়েছি, তেমনি হারিয়েছি অজস্র সাধারণ মানুষকে। সেই কারণে সংখ্যাটা ৩০ লাখে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় কত মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী তা এই পরিসংখ্যানে উঠে আসে। 

২৫ মার্চের সেই ভয়াবহ রাতে যখন ঘুমন্ত, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাক সেনারা আক্রমণ করে. তখন বিলম্ব না করে সেই সময়ের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ সরাসরি অস্ত্র হাতে, কেউ আবার মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক এবং নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার ভাষণে যেমন বলেছিলেন, যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, এই বক্তব্যটির প্রতিফলন ঘটায়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে যেমন বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম আর তারপর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি যখন বললেন আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, তখন আর কারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি, এখন আমাদের একটাই করণীয়- পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করা, তাদের ওপর আক্রমণ চালানো এবং দেশকে স্বাধীন করা। 

বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষণার পর থেকে দীর্ঘ ৯ মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যে বিজয় দিবস আসে, তা আমাদের কাছে অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষার একটি দিন। কিন্তু সেই দিন বিজয়ের পরিপূর্ণ স্বাদ আমরা গ্রহণ করতে পারিনি। কারণ বঙ্গবন্ধু তখনো আমাদের থেকে অনেক দূরে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। সবাই অপেক্ষা করছিল কখন বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন। এরপর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ যখন বঙ্গবন্ধু সত্যিই বাংলাদেশে ফিরে এলেন, তখন আমরা স্বাধীনতার আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করার সুযোগ পেলাম।

বঙ্গবন্ধু লন্ডন, নয়াদিল্লি হয়ে বাংলাদেশে ফিরে এলেন। লন্ডনে যখন সেই সময়ের বাংলাদেশি প্রতিনিধিবৃন্দ সংবর্ধনা জানানোর জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি এসে গেছি, এখন আর তোদের কোনো ভয় নাই। অর্থাৎ আমরা যেমন মনে করতাম তিনি আমাদের পাশে থাকলে কোনো ভয় নাই, বঙ্গবন্ধুও তেমনি বিমান থেকে নেমে সবার উদ্দেশে বললেন, আমি এসে গেছি। 

১০ জানুয়ারি ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে তিনি সরাসরি চলে গেলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অর্থাৎ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে জনসমুদ্রে ভাষণে তিনি পাকিস্তানের বন্দি জীবন-যাপন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ কীভাবে গড়ে তুলবেন সেসব কথাই বললেন। একটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়, নয় মাস পরে যে তিনি দেশে ফিরলেন, তিনি তার পরিবার পরিজনের সঙ্গে দেখা করা, বা তাদের খোঁজখবর নেওয়া এসবের প্রয়োজন বোধ করলেন না। এতেই বোঝা যায় জাতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে প্রতিশ্রুতি, দায়িত্ববোধ-কতটা গুরুত্বের সঙ্গে তিনি তা নিয়েছিলেন। সেদিনের সেই ভাষণে তিনি বাঙালিকে আরও উজ্জীবিত করলেন। 

তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে তা রক্ষা করা অনেক বেশি কঠিন। সে কঠিন কাজের দায়িত্ব তিনি আবারও দিলেন জনগণের কাছে। পরে আমরা জানি বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ শাসন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ৭৫-এর অভিশপ্ত ১৫ আগস্ট তিনি সপরিবারে নিহত হন। কিন্তু এই সাড়ে তিন বছরে তিনি বাংলাদেশকে যেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন তা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতে পারি। সেই সময় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় কিন্তু এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ছিল। এমনকি তখন গণচীনের মাথাপিছু আয়ের চেয়েও আমাদের বেশি ছিল। 

আজকে আমরা সত্যিই অনেক দুর্ভাগা যে জাতির পিতা আমাদের জন্য তার সমগ্র জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন তাকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ১৬ ডিসেম্বরে তিনি আবার সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গেলেন এবং আবার বিশাল জনসমুদ্রে ভাষণ দিলেন। সেই ভাষণে তিনি বাংলাদেশের এক বছর পূর্তিতে বলেন দশ মাসে তিনি জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দিয়েছেন এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে তা কার্যকর হয়েছে। 

তিনি সেদিনের ভাষণে বলেছিলেন, অনেক দেশের পক্ষেই এত অল্প সময়ের মধ্যে সংবিধান দেওয়া সম্ভব হয়নি, কিন্তু আমরা দিয়েছি। এই সংবিধান শহীদের রক্তে লেখা, এই সংবিধান আমাদের আত্মপরিচয়ের; যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আজ থেকে এই গণপ্রজাতন্ত্রের মালিক যে জনগণ সেটি সংবিধানে স্থান পেয়েছে। 

এবারের বিজয় দিবস আমরা উদযাপন করছি সাধারণ নির্বাচন সন্নিকটে রেখে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আমরা নির্বাচনে উপনীত হব। যদিও এই সাধারণ নির্বাচন নিয়ে অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে, তবে আশা করি বাঙালি যেভাবে নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে ঠিক তেমনিভাবে যত বাধা বিঘ্নই থাকুক, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের পরবর্তী প্রতিনিধিদেরকে নির্বাচন করা হবে। আমরা জানি এই নির্বাচনকে ঘিরে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র আছে। শুধু আজকে নয়, এই ষড়যন্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই চলছে। কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্রই বাঙালিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। যে অদম্য বাঙালির জাতির নেতা বঙ্গবন্ধু, সে জাতি কখনো থেমে থাকতে পারে না। এই বিজয় দিবসে আমরা আরও একটি বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা চাই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও বাস্তবায়নে যারা এগিয়ে থাকে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মধ্য দিয়ে যারা এই দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে চায় তারা আবার নির্বাচিত হয়ে দেশ শাসনের দায়িত্ব নেবেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সেটি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলারই রূপান্তর। আমাদের গন্তব্য হোক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর এই দেশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল। এই নিকষ কালো অন্ধকারকে আরও ঘনীভূত করার জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের কোনো বিচার করা যাবে না এরকম একটি আইন সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল। এ অন্ধকার দূর করার জন্য আমাদের দীর্ঘ ২১ বছর আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে। পরে বঙ্গবন্ধু হত্যার এবং মুক্তিযুদ্ধের অপরাধীদের বিচার আমাদের কিছুটা কলঙ্কমুক্ত করেছে। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। 

আমরা বছরের প্রতিটি দিনই বাঙালির বিজয় হিসেবে দেখতে চাই। বঙ্গবন্ধু সংবিধানে যে ২২টি মৌলিক মানবিক অধিকারের কথা বলে গেছেন, সে অধিকার বাস্তবায়ন আমাদের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। বিজয় দিবস যখন আমরা উদযাপন করতে চাই, তখন প্রতিটি বাঙালির মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে চাই। এই অধিকার নিশ্চিত হবে তখন যখন সংবিধানে মানুষের যে অধিকারের কথা বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, জনগণ তাদের সেই অধিকার অর্জন করতে পারবে।


লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫