
আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি
আজকাল ঘৃণা বড্ড জনপ্রিয়। অনেকেই এই সব দেখতে দেখতে ক্লান্ত, কিন্তু এটা ঘৃণা আর বিদ্বেষের কাল। তা ছাড়া ফেসবুকের মতো ময়দান থাকায় এটা বাড়তে পারছে সহজে, আরামে। দল বেঁধে ঘৃণা চর্চার যে কালচার তৈরি হয়েছে এই দেশে সেটা থামবে না।
আমরা মানতে চাই না যে আমরা ঘৃণা পছন্দ করি। আজকাল বলিয়ে লিখিয়েরা এর বেশ চর্চা করে। তারা কিছু করতে পারে না, কারণ তারা নিজেরাও অসহায়। কত অসহায়, বোধকরি সেটাই প্রকাশ করে। অপ্রাপ্তির ক্ষোভ এই আগুন জ্বালায়। আমাদের চাওয়ার শেষ নাই, না পাওয়া কষ্টেরও না। তাই এই কাফেলা চলবেই। তবে সবলরাও ঘৃণা করে খুব হিসাব করে। তারা করে কিছু পেতে, জানে শেষে প্রাপ্তি হতে হবে। অতএব মানব ধর্ম যার যার, কিন্তু ঘৃণা সবার।
দুই
এটা একদিনে হয়নি, কিন্তু এটা আমাদের ভেতরে ছিল। না হয় ১৯৭১ সালে কী করে মানুষ লুটেরা হলো, নিরীহ মানুষকে ধরিয়ে দিল, এমনকি লোভের বশবর্তী হয়ে হত্যা পর্যন্ত করল? একটা ঘটনার উল্লেখ করি। কিছু ডাকাত কিসিমের লোক বর্ডার পার হওয়া মানুষদের লুট করত, কাছের এক গ্রামে লুকিয়ে রাখত এই লুটের মাল। একদিন ওই মাল সরিয়ে ফেলে গ্রামের আরেক বাসিন্দা, যে জানত বিষয়টা। প্রতিশোধ নিতে সেই ডাকাত নেতা পাক আর্মিকে খবর দেয় যে, এখানে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আছে। একদিন অতর্কিত আর্মি হামলা করে। অসংখ্য পুরুষ-জওয়ান, কিশোর, বুড়োকে হত্যা করে চলে যায়। সেই পাওয়া না পাওয়ার কষ্ট থেকেই সব শুরু হয়। এটা তো আমরা করেছি। সকল পরিসরে এই চর্চা এখন। আমাদের অনেকের ভেতরটা মসৃণ নয়, তাই ঘৃণার দরজা বেয়ে বারবার আঘাত করি, বলি, “বাড়ি আছেন? একটু দরকার ছিল।”
তিন
কিন্তু ভালোটাও ছিল। অসম্ভব সুন্দর ভালো, মাঝারি ভালো, নিত্যদিনের ভালো। না হয় এত মানুষ বাঁচল কী করে? এত মানুষ আশ্রয় পেল কীভাবে সেই বছর জান নিয়ে পালতে গিয়ে? আমরা নিজেরা দেখেছি অন্যের জন্য কত ত্যাগ করছে, পাশে দাঁড়াতে, এমনকি প্রাণ দিচ্ছে। আজকাল তেমনটা কি দেখা যায়? উত্তরটা ভালোভাবে খুঁজতেও দ্বিধা হয়। কী জন্য? কী পাব কে জানে? জেনে ধারণ করতে পারব? আমাদের মাঝে যেসব সম্পর্ক রয়েছে, তার ভিত্তি কী? আগে কী ছিল চাওয়া পাওয়ার কুরুক্ষেত্রে, কে বাঁচল, কে মরল? তাই ইদানীং স্মৃতি হাতড়াই, বা আশপাশের যা সুন্দর তার দিকে একটু বেশিক্ষণ তাকাই। কেমন আছে তারা সব?
চার
আমরা সত্তর দশকের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধের পর ইউনিভার্সিটির প্রথম ব্যাচ। যুদ্ধের বছরটা সবাই খুব দ্রুত বড় হয় বা হতে বাধ্য হই কারণ এত নিকট থেকে জীবন-মৃত্যু, বেঁচে যাওয়া-মরে যাওয়া সহজে দেখতে হয়! সে যুদ্ধে যাক আর না যাক। আমরা ভেবেছিলাম দোজখের গ্রাম পার হয়ে গেছি। কিন্তু আসলে তা বোধহয় না, কারণ আমাদের মাঝে দেখা দেয় নানা ধরনের সমস্যা, বিপর্যয়। নয়া বাংলাদেশ মাথায় ধারণ সহজ ছিল না। সহ্য করতে না পেরে অনেকেই ড্রাগ আসক্ত হয়। এটা যে কেবল যুদ্ধের কারণে তা নয়, যুদ্ধপরবর্তী সমাজে টিকে থাকা সহজ ছিল না। রাজনীতি ক্রমেই সাংঘর্ষিক হচ্ছিল। কিন্তু তার মধ্যেও সম্পর্কগুলো টিকে ছিল। আজকের দিনে একেবারেই অসম্ভব যেটা। তাই আজকে একটা স্মৃতি নিয়ে একটু আলাপ করব। প্রধান দুই কুশীলব দুই প্রধান শত্রুপক্ষের নেতা গোছের পাবলিক।
পাঁচ
অবশ্য গল্পে অন্য একটা অ্যাঙ্গেল আছে। প্রেম বিয়ে, এই সব আর কি। প্রধান পুরুষ চরিত্রের দুজনই ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট, ছেলে/প্রেমিক ভালো ছাত্র এবং শক্ত জাসদ ছাত্রলীগের নেতা, মেয়ে রাজনীতি না করলেও সমর্থক। প্রেম চলছে, বিয়ে হবে পাস করার পর। কিন্তু হঠাৎ ভালো ছেলে পাওয়ার পর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। মেয়ের বাবার ওপর কথা বলার সাহস নাই, আর ছেলে তখনো কিছু করে না। মেয়ের ভাইরা প্রেমের ব্যাপারটা জানলেও করার কিছু নাই। কারণ কোন যুক্তিটা দেবে? ছেলে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যায়, কী করবে বুঝতে পারছে না। শেষে যেদিন বিয়ে সেদিন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যে কিনা মুজিববাদী ছাত্রলীগের টপ নেতা বা তার চেয়ে কিছু বেশি কিছু তার কাছে যায়, সব কথা বলে। ‘এখন আমি কী করব?’ এমন অসহ্য মুহূর্ত জীবনে কম আসে।
ছয়
আধা ঘণ্টা লেগেছিল সবাইকে তৈরি হতে। বারো যুবা, ৬টা স্টেন, দুইটা গাড়ি। আধা ঘণ্টার আগেই পৌঁছে গেল বিয়েবাড়িতে। তখন মৌলভী সাহেব কর্মটি শেষ করতে যাচ্ছেন সবে। হঠাৎ বাড়ির মেইন সুইচ অফ হয়ে গেল। হা-হু হতে হতেই বাতি ফিরে এলো। সবাই আমন্ত্রিত নবাগতদের দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। সে দলের নেতা বলল, “এই ছেলে আর মেয়ের সম্পর্ক আছে। মেয়ে সহজ করে কিছু বলতে পারেনি বাড়িতে। তাই আমরা এসেছি। যদি মেয়ে রাজি থাকে, আমাদের ছেলের সাথে বিয়ে হবে। আর যদি না বলে আমরা তক্ষুনি চলে যাব, কথা দিলাম। মেয়েকে জিজ্ঞাসা করা হোক।” মেয়ে তার বেকার প্রেমিকের সাথে বিয়ে করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। বরপক্ষ অপমানিত হয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। পুরান বৌ আর নতুন বরের বিয়ে হয়ে যায়। পাক্কা ৫০ বছর আগের ঘটনা। পরের দিন জানতে পেরে আমরা সবাই খুব মজা পেয়েছিলাম। মেয়েকে-জামাইকে দুজনকেই চিনতাম। এমনকি যে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে, তাকেও।
সাত
আজ এমন ঘটনা ঘটবে? কেন এই গল্পটা বললাম? কারণ গত সপ্তাহে রাজনৈতিক কারণে এক বিয়ের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। কী আর করা। ঘৃণা, বিদ্বেষ, ক্ষোভের এত ডাকনাম।
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক